সরকার আব্বা কেন বিজিএমইকে টাকা দেয়?

পর্ব ১২

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : মে ০২, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো দশম পর্ব।

২৬ এপ্রিল ২০২১ সোমবার
আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে নগর ঢাকা। রাস্তায় থই থই করছে গাড়ি। আগের মতোই যানজট। ট্রাফিক পুলিশ আগের মতোই দু বাহু প্রসারিত করে জ্যাম সামাল দিচ্ছে। ফুটপাতজুড়ে অজস্র মানুষের স্রোত। বিকেলের দিকে অফিস থেকে বের হয়ে এসব চোখে পড়ল।

সাতাশ নম্বর পেরিয়ে এসে দেখলাম, ফুটপাতের উপর ভাসমান দোকানগুলোও খুলে গেছে। রমজান উপলক্ষে কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে সেগুলো। মানুষজন দেদারছে কাপড়ের আড়ালে চলে যাচ্ছে, চা-বিস্কুট এটা সেটা খাচ্ছে, আবার বেরিয়ে আসছে। জনজীবন একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

শুধু স্বাভাবিক হতে পারছে না বিজিএমইএ নামের প্রতিষ্ঠানটি। তাদের দুঃখ দুর্দশা শেষই হচ্ছে না। বেচারাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এত অভাব অনটনের মধ্যেও কারখানা খোলা রেখেছে তারা শুধুমাত্র দরিদ্র গর্মেন্টস কর্মীদের কথা চিন্তা করে। এত মহৎপ্রাণ গার্মেন্টস মালিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। সামনে ঈদ আসছে। এখন কর্মীদের বেতন বোনাস কীভাবে দেবে, এই নিয়ে তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষ নেই। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না। তারা নিজেরা না খেয়ে আছে তাতে সমস্যা নেই, আরও দু চার বছর তারা পেটে পাথর বেঁধে থাকতে প্রস্তুত আছে, কিন্তু কর্মীদের তো না খেয়ে থাকতে বলা যায় না। তাদের তো বেতন-বোনাস দিতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম, বিজিএমইএ কাঁদতে কাঁদতে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে, টাকা দিন, কর্মীদের বেতন দেব!

গত বছর করোনার একেবারে শুরুর দিকেই তারা সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা নিয়েছিল কর্মীদের বেতন বোনাস দেবে বলে। সেই টাকা কী করেছে কেউ জানে না। এরপর দফায় দফায় আরও বেশ কয়েকবার টাকা নিয়েছে। তবু তাদের অভাব শেষ হচ্ছে না। চোখের পানি শুকাচ্ছে না। এ যেন আব্বার বাড়ির আবদার।

ছোটবেলায় দেখতাম, মেয়েরা বিয়ের পর দুদিন পরপর বলত, আব্বা, আপনার জামাই মোটর সাইকেল কিনবে, টাকা দেন। আব্বা, আপনার জামাই স্যুট-প্যান্ট কিনবে, টাকা দেন। আব্বা, আপনার জামাই ব্যবসা করবার চায়, টাকা দেন। আব্বা… টাকা দেন, টাকা দেন, টাকা দেন। আব্বারা দেখতাম, শুকনো মুখে শুধু টাকা দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে।

সরকার আব্বা কেন বিজিএমইকে টাকা দেয়? সেই কারণ জানি, কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। বিকেলের আলো একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। ফুটপাতগুলো ভরে উঠছে ইফতারির পশরা নিয়ে। গতকাল থেকে খুলে গেছে শপিংমল। অনেক মানুষ বেরিয়েছে ঘর থেকে। যে পরিমাণ মানুষ বেরিয়েছে ঘর থেকে, সে পরিমাণ রিকশা নেই রাস্তায়। ফলে একটা রিকশাশূন্যতা তৈরি হয়েছে। অনেক মানুষ হন্যে হয়ে রিকশা খুঁজছে। বিশেষ করে রমণীকুল। একটা দুটো খালি রিকশা দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ছে সবাই। রিকশাওয়ালাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারছে। আড়ংয়ের গলি থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ভাড়া চাচ্ছে দেশশো টাকা!

আদিল প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ এইসব অসভ্য, মূর্খ, নীতিবিবর্জিত, সুপারফিশিয়াল মানুষদের কাণ্ড-কারখানা দেখলাম। মানুষ এমন তয় একবার পাইবার পর, নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর!

এই মানুষগুলোও কারো না কারো কাছে সোনার মোহর। ভেবে অসহায় বোধ করলাম। একটা বিষণ্ণ ঝিমধরা অনুভূতি নিয়ে আসাদ গেটের দিকে হাঁটা দিলাম।
কখন বাসায় পৌঁছলাম, মনে নেই। চলবে