সৈয়দ শামসুল হকের ৪ কবিতা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ

তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার মানচিত্রের ভেতরে
যার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তেরো শো নদীর ধারা;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার করতলে পাঙরাটির বুকে
যার ডানা এখন রক্ত আর অশ্রুতে ভেজা;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার তোমার নৌকার গলুইয়ে
যার গ্রীবা এখন ভবিষ্যতের দিকে কেটে চলেছে স্রোত;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার মাছধরা জালের ভেতরে
যেখানে লেজে মারছে বাড়ি একটা রুপালী চিতল;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার হালের লাঙলের ভতরে
যার ফাল এখন চিরে চলেছে পৌষের নবান্নের দিকে;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার নেহাই ও হাতুড়ির সংঘর্ষের ভতরে
যার একেকটি স্ফুলিঙ্গে এখন আগুন ধরছে অন্ধকারে;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার কবিতার উচ্চারণে
যার প্রতিটি শব্দ এখন হয়ে উঠছে বল্লমের রুপালী ফলা;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার দোতারার টান টান তারের ভেতরে
যার প্রতিটি টঙ্কার এখন ইতিহাসকে ধ্বনি করছে;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার লাল সূর্য্ আঁকা পতাকার ভেতরে
যার আলোয় এখন রঞ্জিত হয়ে উঠছে সাহসী বদ্বীপ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার অনাহারী শিশুটির কাছে
যার মুঠোর ভেতরে এখন একটি ধানের বীজ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার প্লাবনের পর কোমল পলিমাটিতে
যেখানে এখন অনবরত পড়ছে কোটি কোটি পায়ের ছাপ।

একেই বুঝি মানুষ বলে

নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।

আমার পরিচয়

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

একুশের কবিতা

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–

তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।।