স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘কুকুরবন্ধু’

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০২৪

ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথায় ঘুরছিল একটা কথা: ‘কুকুর মানুষের সহস্র সহস্র বছরের এমন এক বিশ্বস্ত বন্ধু, যে কখনো বিশ্বাস ভাঙেনি।’ ঘুমানোর জন্য যখন চোখ বন্ধ করলাম, অনন্ত শূন্যতায় ভেসে উঠল একটি কুকুরের মুখ। তার নাম বিনয়। সিলেটের বন্ধু হযরত বিনয় ভদ্র নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কুকুরটি নামে রেখেছেন বিনয়। কদিন আগে কুকুরটির মুখে কী একটা ঢুকেছিল। নাকি মুখে কোনো অসুখ হয়েছিল? খুব কষ্ট পাচ্ছিল বেচারা। কারা যেন তার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল তার সহায়তার জন্য। বিনয় ভদ্রের চোখে পড়ল সেই পোস্ট। তিনি এবং তার বন্ধুরা কুকুরটিকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। কুকুরটির চিকিৎসা করালেন। কুকুরটি এখন প্রায় সুস্থ। লম্বা জিব বের করেছে। বিনয় ভদ্র সেই জিব বের করা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন গতরাতে।

বিনয় ভদ্রকে ভালোবাসি তার স্বেচ্ছাচারী জীবন ও কুকুরপ্রীতির জন্য। ‘ইহযৌবন’ এ উদয় চরিত্রটিতে আছে বিনয়ের ছায়া। আছে তার কুকুরপ্রীতির কথা এবং লিখেছি বিনয়ের মদ্যপ্রীতির কথাও। উদয়কে উল্লেখ করেছি একজন বিশিষ্ট মদ্যকার হিসেবে। গদ্যকার, গল্পকার ও নাট্যকারের সঙ্গে মিলিয়ে মদ্যকার। তার মতে, যে মদ পান করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে সে মদ্যকার। আর যে মদের জন্য চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই করে এবং মাতলামি করে বেড়ায় সে মদ্যপ।

হেমিংওয়ে উদয়ের প্রিয় লেখক। তার প্রিয় কুকুরটির নাম সান্তিয়াগো। সে হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যন্ড দ্য সী’র সান্তিয়াগোর নামে নাম রেখেছে কুকুরটির নাম। তার অফিসকক্ষের ডানের দেয়ালে একই ফ্রেমে সে এবং তার প্রিয় কুকুর সান্তিয়াগোর একটা ছবি টাঙানো। কোনো এক হাওর কি ঝিলের পাড়ে অন্তরঙ্গ দুই বন্ধুর মতো বসে আছে পাশাপাশি। সান্তিয়াগোকে সে কুড়িয়ে পেয়েছিল রাস্তায়। একদিন পর্বতনগরী শিলং থেকে ফেরার পথে তামাবিল বর্ডারের নো ম্যান্স ল্যান্ডে সে দেখতে পায় কুকুরটিকে। নিতান্তই ছানা। তার পায়ে মুখ ঘষছিল আর কুঁই-কুঁই করে ডাকছিল। অবোধ ছানাটিকে সে কোলে তুলে নেয় পরম মমতায়। বাড়ি এনে লালন-পালন করতে থাকে সন্তানের মতো। বিনয় ভদ্র কি জানেন, উদয় চরিত্রে তার ছায়া আছে? জানার কথা নয়। আজকের পর হয়ত জানবেন। ইহযৌবন পড়বেন। খুঁজে পাবেন নিজের ছায়া, প্রতিরূপ।

তো আমি ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আহত কুকুর বিনয়ের মুখটি চোখের সামনে থেকে সরছে না, ভেসে আছে নিঃসীম শূন্যতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। হারিরির কথা মনে পড়ল। `স্যাফিয়েন্সে` তিনি লিখেছেন, সভ্যতার শুরুতে কুকুরই প্রথম জুড়ে গিয়েছিল মানুষের সঙ্গে। আমি ভাবি, পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের জন্য সর্বপ্রাণের অস্তিত্ব আবশ্যক। মানুষ নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে, তার মস্তিষ্ককে শান দিতে দিতে আজ এই মানুষে পরিণত হয়েছে। মানুষ উন্নত মস্তিষ্কের কারণেই মানুষ। নইলে তার মধ্যে এবং কুকুরের মধ্যে ফারাক কোথায়? যেহেতু মানুষের মস্তিষ্ক উন্নত, সেহেতু তার দায়িত্ব বিস্তর। কেবল সে নিজেকে রক্ষা করবে না, অন্য মানুষকেও রক্ষা করবে। কেবল মানুষকে রক্ষা করবে না, সমস্ত প্রাণকেও রক্ষা করবে। কেননা সে উন্নত, সে বিবেকী, সে বুদ্ধিমান। সে কারণেই তার দায়িত্ব বেশি।

ভাবি আসহাবে কাহাফের সেই কুকুরটির কথা। আসহাবে কাহাফ, মুসা নবির সাত যুবক অনুসারী, শত্রুদের ভয়ে একটা কুকুরকে নিয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ে, আশ্রয় নিয়েছিল একটা গুহায় এবং সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এক ঘুমে কেটে গিয়েছিল তিনশো বছর। একটি কুকুর গুহার মুখে বসে তাদের দিয়েছিল পাহারা। সাত যুবকের সঙ্গে বেহেশতে যাবে কুকুরটিও, কেতাবে উল্লেখ।

মনে পড়ে সেই বেশ্যার গল্প। হাশরের মাঠে এক বেশ্যাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন খোদা। সমবেত সকলে অবাক। বেশ্যা বেহেশতে যাচ্ছে, এ কী করে সম্ভব! সবার কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দিলেন খোদা। বললেন, শোনো, একদিন মরুভূমির পথে হাঁটছিল এই বেশ্যা নারী। দেখল, একটি কুকুর তৃষ্ণায় কাতর। পাশেই ছিল একটা কুয়া। কিন্তু পানি তোলার কোনো উপায় ছিল না। বেশ্যা তার একটি জুতা ওড়নার সঙ্গে বেঁধে কুয়ায় ফেলল। জুতায় যতটুকু পানি উঠল, তা পান করাল কুকুরটিকে। কুকুরটি বেঁচে গেল। একটি কুকুরের প্রাণ রক্ষার জন্য আমি তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছি। সে অনন্তকাল স্বর্গসুখ ভোগ করবে।

আর মনে পড়ে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের কথা। মহাপ্রস্থানের পথে তার সঙ্গী হয়েছিল একটি কুকুর। স্বর্গের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ালেন যুধিষ্ঠির। পেছনে কুকুরটিও। ধর্মরাজ বললেন, এসো যুধিষ্ঠির, স্বর্গে প্রবেশ করো। যুধিষ্ঠির বললেন, এই কুকরও যাবে আমার সঙ্গে। ধর্মরাজ বললেন, তুমি এখন স্বর্গসুখের মালিক হয়েছ, কুকুরের মায়া ছাড়, কুকুর স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে না। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি কুকুরকে ছাড়া যাব না স্বর্গে। এবার স্বরূপে ফিরল কুকুরটি। কুকুরের ছদ্মবেশে তিনি ছিলেন আসলে ধর্মরাজ।

অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লাম। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেল এক স্বপ্ন দেখে। দেখলাম, পরিচিত একজন, যার নাম ল, যার সঙ্গে একদিন কাটিয়েছিলাম অর্ধবেলা, যার সেই সঙ্গস্মৃতি জাগরুক থাকে হরদম, তিনি একটা বই লিখেছেন, যার নাম, ‘লাল গো।’ বিষয়বস্তু কুকুর। বইটা নিয়ে কথা বলছে বিস্তর মানুষ। কবি, চলচ্চিত্রকর্মী ও এক্টিভিস্ট শ্যামল শিশির বইটার প্রচ্ছদ শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তার পোস্টে আমি কমেন্ট করলাম, ‘এই লেখককে আমি চিনি।’

বইটার একটা দীর্ঘ রিভিউ করেছেন আইনস্টাইন। সক্রেটিস বইটার ওপর বক্তৃতা করছেন। কোনো এক সমুদ্রের পলিমাটির সৈকতে আসহাবে কাহাফের সেইসব ঘুমন্ত মানুষদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন ল। স্টিফেন হকিংস আমাকে প্রশ্ন করলেন, কে এই লেখক? বললাম, আমি ঠিক চিনতে পারছি না। বলেই সিগারেট ধরালাম। হকিংস উঠে পড়লেন একটা নৌকায়। নৌকাটি হরিরামপুরের পদ্মা নদীতে ভেসে চলছে। আমি হাত নাড়ালাম। দেখলাম ‘লাল গো’-এর লেখক ল অন্য একটি নৌকায় প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাচ্ছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি শস্যে ভরা এক সবুজ প্রান্তরে। হুহু স্বরে কাঁদছি। বুঝতে পারি না কান্নার কারণ। হয়ত শস্যে ভরা সবুজ প্রান্তরের জন্য, কিংবা স্মৃতির জন্য।

শত জ্যোৎস্নার মাধুরী
১৮.০৫.২০২৪