
হারাতে হারাতে কুড়াতে কুড়াতে যাই
পর্ব ৪
সরকার আবদুল মান্নানপ্রকাশিত : মে ০১, ২০২০
মালগাড়ি চলাচলের ওই রেললাইন দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রুহুল ভাই লজিং ঠিক করে দিয়েছেন। এটা চার মাসের মধ্যে আমার তৃতীয় লজিং। চাষাড়ার দিকে এগোচ্ছি। হাতে ব্যাগ আর হ্যারিকেন। হ্যারিকেনটাও একটি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আশা করি হ্যারিকেনটা আর লাগবে না। ওটা রুহুল ভাইকে ফিরিয়ে দেব।
ভেতরটা হুহু করছে। এই সময় ক্লান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমার দেহ-মন ক্লান্তিতে যেন অবশ হয়ে আসছে। রেল লাইনের পাশে পরিত্যক্ত একটি দোকানের টুলে গিয়ে বসলাম। ব্যাগ, হ্যারিকেন নিচে রেখে ঠায় বসে থাকলাম। তুরফা মেয়েটি আমার কে? কেউ না। তার পরেও ওর জন্য কেন আমার মন খারাপ হচ্ছে, কেন ভেতরটা এমন হাহাকার করছে। মনকে প্রবোধ দিলাম, নাহ্, এমনটা হওয়া ঠিক নয়। পেছনটা খুব সুন্দর, খুব মোহময়। তার জন্য পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। সামনে আরও যে সুন্দর, আরও যে মোহময় কিছু অপেক্ষা করছে না, তা-ই বা কে বলবে! সুতরাং আমাকে এগোতে হবে।
ব্যাগ এবং হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে আবার আমি হাঁটতে শুরু করলাম। এই রাস্তা আমার অনেক দিনের পরিচিত। প্রতিদিন আমি এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে কলেজে আসা-যাওয়া করি। কিন্তু আজকে রাস্তাটি খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে। যেন আমি আগন্তুক। কোনো দিন এই পথে আসিনি। ভুল করে এখানে এসে পড়েছি। আজ প্রথম চোখে পড়ল, বাঁ দিকের ছোট জলাশয়ের ওপাড়ে কদম গাছটা। ওর বড় বড় সবুজ পাতার নিচে বেঢপ ঝুলে আছে শুকনো কদম ফুল। কিন্তু সবুজ পাতার টলটলে জীবনের মধ্যে ওই শুকনো কদম ফুলগুলো কোথায় যেন জীবনকেই প্রগাঢ় করে তুলেছে। তার পাশে আরও কয়েকটি কদম গাছ। এ যেন নিপবন।
শুধু কদম গাছগুলো নয়, আজকেই প্রথম বিস্ময়কর নির্জনতা আর প্রবল প্রাণতৃষ্ণা নিয়ে দেখা দিল পুকুর পারের উঁচু জায়গায়টার উপর অনেক পাতা আর অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল গাছটা; কামরাঙার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ফল নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে উঁচিয়ে থাকা অর্জুন গাছটা এবং ছোট ছোট মৌমাছির মতো সাদা ফুলের অবিশ্বাস্য আয়োজন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাতিম গাছটা। কেন যে ওরা আজ এমনভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠল, তার কি কোনো কারণ আছে? কোনো দায়? কয়েকটি মাস আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, প্রকৃতির ভেতরে আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার কৈশোর। আমার সকল আনন্দ-বেদনার একমাত্র সহচর পুকুরের জলে পা ভিজিয়ে রাখা ওই হিজল গাছটা, বিস্রস্ত ঘুরে বেড়ানো ওই শালিক দুটি— ওই জল, ওই পুকুর, ওই খাল, ওই বিল। কী করে আমি আজন্মের এই প্রিয়জনদের ছেড়ে আছি। আমার ভেতরের হাহাকারটুকু কী করে ওরা টের পেল, আর ওমনিতেই অফুরন্ত আয়ূধ হয়ে একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
আজ চোখের জলে বলি, হে আমার বৃক্ষসকল, হে আমার পক্ষীকূল, হে আমার জলের জগৎ, হে আমার বিচিত্র আকাশ তোমরা কোনো দিন আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। তোমাদের ছাড়া আমার পুষ্টি নেই, দেহ ও মনের প্রশান্তি নেই। তোমরা থেকো।
মনের যে শৃঙ্খলা কিছুক্ষণ পূর্বেও প্রায় বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার তা ফিরে পেলাম। এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতে লাগল। তবুও নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে তোলার জন্য একটি চায়ের দোকানে বসে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম। মনে হলো নতুন লজিং বাড়িতে ঢোকার জন্য এখন ঠিক আছি। ওই মালবাহী রেল লাইনের উত্তর পাশে মেম্বার সাহেবের বাড়ি। এইটে পড়ুয়া ছেলেটি আমার হাত থেকে ব্যাগ ও হ্যারিকেনটি নিয়ে সামনে চলে গেল। আমি ওকে অনুসরণ করে একটি রুমে ঢুকলাম। বসত ঘরের সঙ্গে লাগোয়া এই রুমটি। তবে ইটের দেয়াল দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে। রেল লাইনের দিকে এই রুমটির একটি মাত্র দরজা। ফলে বসত ঘরের সঙ্গে লাগোয়া হলেও স্বতন্ত্রই বলা যায়। সুতরাং প্রাইভেসি রক্ষিত হবে। এটা আমার কাছে চিরকালই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এইটুকু স্বস্তির জায়গা পেয়ে আমি ছেলেটির সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে শুরু করলাম। তার নাম জুয়েল। আইটি স্কুলে এইটে পড়ে। ফর্সা নয়, কালোও নয়। আবার উজ্জ্বল শ্যামলা যে বলব, তাও নয়। শরীরের যে পুষ্টি, প্রশান্তি ও প্রযত্ন মানুষের শরীরে প্রবলভাবে একটি ছাপ রাখে এবং একটি নির্দিষ্ট বর্ণকে প্রগাঢ় করে তোলে, এই শিশুটির মধ্যে তা নেই। এক ধরনের বিবর্ণ ওর শিশুদেহে অনতিক্রান্ত বেদনার মতো লেপটে আছে। দেহে মাংস নেই। শরীরের জায়গায় জায়গায় হাড় উঁচিয়ে আছে। এই বয়সের শিশুদের মাথার চুল সদ্য গজিয়ে ওঠা জমাট শস্যের মতো যে পেলবতা তৈরি করার কথা, লাউয়ের ডগার মতো তরুণ প্রাণপ্রবাহে স্নিগ্ধতার আলোড়ন তৈরি করার কথা, জুয়েলের মাথায় সেই বাহারি চুলের লেশমাত্র নেই। মাথায় গামছা বেঁধে সারাক্ষণ মুটেগিরি করে যে শ্রমিক, তাদের মাথার ধূসর ও নিষ্প্রাণ চুলের মতো অল্পবিস্তর চুল জুয়েলের মাথায়। এইসব দেখে কেমন যেন ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আর এই ছেলেটির প্রতি খুব মায়া জমে গেল।
বললাম, জুয়েল, তুমি কেমন আছ বাবা?
জুয়েল বলল, ভালো স্যার। আমি এখন যাই? আমি বললাম, অবশ্যই যাবে। তো কোথায় যাবে এখন? বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে? জুয়েল বলল, কোথায় যাব জানি না স্যার। আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, তোমার মাকে আসতে বল। আমি উনার সঙ্গে একটু পরিচিত হই। আচ্ছা, বলে জুয়েল বেরিয়ে গেল। জুয়েলের মা এলেন। আমি একটু বিভ্রান্তই হয়ে পড়েছিলাম। কিছুতেই মনে হচ্ছিল না উনি একজন মেম্বারের স্ত্রী। যখন বললেন, বাবা, কেমন আছেন, তখন আমি বুঝতে পারলাম, উনি জুয়েলের মা। বললাম, ভালো আছি চাচি। আপনি কেমন আছেন?
আছি বাবা, আছি। ছেলেটাকে নিয়েই আমার যত জ্বালা। ওরে যদি একটু মানুষ করতে পারতাম বাবা!
আমি বললাম, জুয়েলের কথা বলছেন তো। ওকে নিয়ে একদম ভাববেন না। ওকে আমি দেখব।
আচ্ছা বাবা, তাই দেইখেন, বলে ওনি চলে গেলেন। আমি প্রায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ কোথায় এলাম আমি! এই মহিলার মধ্যে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। ফর্সা কিন্তু রক্তশূন্য। মাসের পর মাস অসুস্থ থাকার পর এইমাত্র বিছানা থেকে উঠে এলে একজন মানুষকে যেমন দুর্বল, অপরিচ্ছন্ন ও ওষ্ঠাগতপ্রাণ মনে হয়, ওই মহিলাকে দেখতে ঠিক তেমনি। যে সব মহিলারা রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে ভিক্ষা করে, তাদের চেয়েও অপরিচ্ছন্ন ও প্রাণহীন এই মহিলা। রাতেই জানতে পারলাম, মেম্বার সাহেবর দুই স্ত্রী। জুয়েলের মা বড়, মানে প্রথম স্ত্রী। ছোটজনকে আমি এখনো দেখিনি। আশা করি এক সময় সশব্দেই আবির্ভূত হবেন।
জুয়েলের দেখা পাওয়া গেল রাত আটটার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম না যে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কী করেছ? বললাম, জুয়েল, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সোনা। চলো, একটু কথা বলি। জুয়েলের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কিন্তু কিছুতেই ওর কোনো মনোযোগ নেই। আমার সঙ্গে কথা বলতে ওর ভালো লাগছে বলেও মনে হচ্ছিল না। অগত্যা বললাম, তোমার কথা বলো জুয়েল। আমি শুনি। জুয়েল বলল, আমার কী কথা, স্যার?
ধরো, তোমার কী করতে ভালো লাগে, কী খেতে ভালো লাগে, তোমার বন্ধু কারা। কে তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু? আরও কত কী। এইসব বলতে পারো। জুয়েল বলল, আমার এখন বলতে ভালো লাগছে না স্যার। পরে বলব। আমি বললাম, আচ্ছা, এখন তোমাকে বলতে হবে না। যখন ভালো লাগবে তখন বলবে। তবে মনে রেখো, তোমাকে নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। ইচ্ছা করলে তুমি তোমার সব কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো। কখনোই তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। এই বিশ্বাস রাখতে পারো।
জুয়েল একটি বই টেনে পড়তে চেষ্টা করছিল। আমি দেখলাম, ওর তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বললাম, জুয়েল, যে কাজটা ভালো লাগবে না, সেটা করতে যেও না। কারণ, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজই ভালো হয় না। কি জুয়েল, ঠিক বলেছি? দেখলাম, সে কিছুটা সপ্রতিভ হয়ে উঠল। বলল, স্যার, একদম ঠিক বলেছেন। পড়তে আমার কখনোই ভালো লাগে না। তাহলে কি আমি পড়ব না?
নিশ্চয়ই তুমি পড়বে। তোমার মা-র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি তোমার পড়াশোনা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। মাকে কিছুতেই অসুখী রাখা যাবে না। তুমি পড়বে এবং ভালো লাগা নিয়েই পড়বে। সেক্ষেত্রে আমাকে যদি একটু সহযোগিতা করো তাহলেই চলবে। জুয়েল খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল। এবং বলল, আপনি যা বলবেন, আমি শুনব স্যার।
ওই রাতে পড়াশোনা হলো না। জুয়েলের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে মেম্বার সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। উনার সঙ্গে অবশ্য আগেই আমার দেখা হয়েছিল। হালকাপাতলা ছোটখাটো মানুষ। থুতনিতে সামান্য দাড়ি। সর্বক্ষণ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে থাকেন। পায়ে পাম্পসু এবং হাতে ছাতা। মর্যাদাসম্পন্ন আপাত বিচ্ছিন্ন মানুষ নন তিনি, বরং এই হতদরিদ্র এলাকার গরিবদুঃখী সবার সঙ্গেই নিবিড় সম্পর্ক। সবার সঙ্গেই মিশেন, কথা বলেন, হাসিঠাট্টা করেন, গালাগাল দেন। এইসব নিয়ে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকেন। খাওয়া-দাওয়ারও কোনো ঠিকঠিকানা আছে বলে মনে হয়নি। বাড়িতে আসেন রাত্রিযাপনের জন্য। আমাকে বললেন, মাস্টার সহেব, কী অবস্থা? আছেন কেমন?
আমি বললাম, ভালো আছি, চাচা। আপনি কেমন আছন? আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, থাকেন দুই-চার দিন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, আমি কেমন আছি। বলেই তিনি রেল লাইনের দিকে হাঁটা দিলেন। জুয়েলকে দেখলে মনে হবে খুব নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির একটি দুর্বল লেছে। কিন্তু সে মোটেই তা নয়। বরং তার মাথার মধ্যে সারাক্ষণ কীসব চিন্তা গিজগিজ করে। তার অস্থিরতার শেষ নেই। কোথায়, কাদের সঙ্গে, কী নিয়ে তার এত কাজ, এত ব্যস্ততা, বোঝা মুশকিল। পিতার মতো এই পুত্রও দিনের অধিকাংশ সময় বাইরে থাকতে পছন্দ করে। খাওয়া-খাদ্যের কাজও চলে তার বাইরেই।
ইতঃপূর্বে ছোট বউয়ের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। সশব্দে নয়, প্রায় নিঃশব্দে। শ্যামলা এবং হালকা পাতলা গড়নের পঁচিশোর্ধ্ব মহিলা। তারও দেহে পুষ্টির অভাব স্পষ্ট। কেমন আছেন ভাই? এই গোছের দু-একটি কথা বলে তিনি বিদায় নিয়েছেন। দ্বিতীয়বার আর কখনো কথাবার্তা হয়নি। বাড়িটির পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব দিক জুড়ে ঘর। রান্নাঘর লাগোয়া উত্তরের ঘরে কেউ থাকে না। ওই ঘরটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুব দিকের টিনসেড চৌচালা ঘরটিতে ছোট বউকে নিয়ে মেম্বার সাহেব থাকেন। ওই ঘরে আরও কতগুলো ছোট ছেলেমেয়ে থাকে। আর পশ্চিমের ঘরের একটি কামরায় আমি থাকি এবং বাকি ঘরটিতে বড় বউ তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকেন। দুই পরিবারের শিশুদের সঙ্গেই আমার একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।
উঠোনে বড় একটি চৌবাচ্চা। ওই চৌবাচ্চায় তেলাপিয়া মাছের চাষ করা হয়েছে। শিশুরা সারাক্ষণ এই মাছগুলো নিয়ে খেলে। বাড়ির চার দিকে গাছ আর গাছ। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় এই বাড়িটিতে সূর্যের আলো পড়ে না। লাগোয়া আরও কয়েকটি বাড়ি আছে। সব বাড়ির শিশুরা খেলতে আসে এই বাড়িতে। সারাদিন নির্বিঘ্নে খেলতে পারে ওরা। ওদের অনেকের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছে। প্রথম দিকে দিনের কোনো না কোনো সময় কিছুটা আড়াল-আবডাল রেখে এই দুই সতিনের মধ্যে ঝগড়ার শব্দ পেতাম। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই লক্ষ্য করলাম, বাড়িতে সারাক্ষণ চরম অশান্তি বিরাজমান। সতিনের সংসার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। যতটুকু শুনেছি লোকমুখে। কিন্তু বাস্তবে তার রূপ খুবই ভয়াবহ।
ভাষার একটি প্রথাগত গড়নের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এবং তার ন্যায়সূত্রকে অবলম্বন করে শব্দভাণ্ডারের একটি জগৎও নির্ধারিত হয়ে আছে। সংসারে কখনো যদি ঝগড়াঝাটি হয় তখনো আমরা সাধারণত ওই ন্যায়সূত্রকে খুব বেশি অগ্রাহ্য করি না। ভাষা ব্যবহারে ক্ষোভকে ধারণ করার জন্য কণ্ঠের উচ্চবাচ্যতারও একটি সীমা আছে। কিন্তু এই দুই সতিনের মধ্যে যখন ঝগড়া বেঁধে যায় তখন ভাষার পরিশীলনগত সকল ন্যায়সূত্র ভেঙে যায় এবং এমন এক শব্দভাণ্ডার ব্যবহৃত হয়, যার অভিধানসম্মত কোনো রূপ নেই।
উদাহরণ দিই। একজন অন্য জনকে বলছে, ধোয়ার জি, আধোয়ার জি, নাপ্তার জি, দুহুইরার জি, বাদুনির জি, খানকির জি, নহরের জি, বাদাইম্মার জি ইত্যাদি। অশ্লীল শব্দ ও বাক্যগুলো উল্লেখ করা ঠিক হবে না।
খুব আয়েশ করে এই সব বলছেন, তা কিন্তু নয়। বরং মনোজগতের বিপর্যস্ততা ও দেহভঙ্গির উত্তাল ঢেউ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যার বিবরণ তুলে ধরা ভাষার অসাধ্য। এক পর্যায়ে মনে হয় কণ্ঠে রক্ত ওঠে এখনই বুঝি মৃত্যু হবে ছোট বউর। বড় বউও যে এত পারেন তা প্রায় অকল্পনীয়। তবুও এক সময় বড় বউ হার মানেন। তার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিউত্তর যখন আর যায় না, তার পরেও বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে ছোট বউও দম নেন। আস্তে আস্তে আমার কাছে সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেন মেম্বার সাহেব বাড়িতে থাকেন না এবং কেনই বা আমার ছাত্র চুরিদারি করে এবং কিশোর অপরাধীদের সঙ্গে মিশে জুয়া খেলে। এই পরিস্থিতি থেকে জুয়েলকে উদ্ধার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। অবস্থা এমন হয়ে উঠল যে, কোনো রকমে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচি।
এই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে খাদ্য ও খাদ্যব্যবস্থাপনার চরম দুরবস্থায়। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই দেখা গেল যে, ভাত ছাড়া আর তেমন কিছুই রান্না হয় না এই সংসারে। শুধু ডালের সঙ্গে ডাঁটার টুকরো সিদ্ধ করা হয়। অনেকটা গোরুর খাদ্যের মতো। পানির সঙ্গে কিংবা ভাতের মারের সঙ্গে যেমন কুপিয়ে টুকরো করে কাশ, কলা গাছ কিংবা খড়কুটো মিশিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি ডালের সঙ্গে ডাঁটা কুপিয়ে টুকরো করে সিদ্ধ করা হ্য়। এইসব বিষয় আমি কখনোই বাড়িতে জানাতাম না। মা-বাবা কিংবা ভাই-বোনদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা কখনোই আমার হতো না।
কিন্তু একদিন আমার ভাই শাহজাহান ও ছোট বোন ফরিদা ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এসে সর্বশেষ লঞ্চটি ধরতে ব্যর্থ হয়। ফলে রাত্রিযাপনের জন্য জিজ্ঞাসা করতে করতে আমার এই লজিং বাড়িতে এসে ওঠে। রাতে ওই খাবার দেখে ওরা প্রায় হতভম্ব হয়ে যায়। ওরা ভাবতেই পারেনি, মানুষের জন্য এমন খাবারের আয়োজন হতে পারে। রাতে অভুক্ত থেকে খুব ভোরে ওঠে ওরা বাড়িতে চলে যায়। এবং একদিন পর বাবা আমাকে দেখতে আসেন এবং যতদিন একটি ভালো লজিং না হবে ততদিন যেন বাইরে থেকে ভালো করে খেয়ে আসি, তার জন্য আমার হতে টাকা দিয়ে যান। ওই বাড়িতে আমি মাসখানেক ছিলাম। এর মধ্যেই আমি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তার বললেন, আমাশয়। প্রাথমিক পর্যায়।
এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আবার আমি শরণাপন্ন হলাম রুহুল ভাইয়ের। তিনি বললেন, খুব ভালো হয়েছে। ঠিক সময়ে এসেছ। শীতলক্ষ্যার ওপার নবীগঞ্জে নান্নু সর্দারের বাড়িতে তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। আশা করি কলেজের বাকিটা সময় ওখানে তোমার ভালই কাটবে। আগামী কাল তোমাকে নিয়ে ওই বাড়িতে যাব। পরদিন নান্নু সর্দারের বাড়িতে গেলাম। কদম রসুল মাজারের কিছুটা দক্ষিণ দিকে নদীর কাছেই ওই বাড়িটি। ওখানে উঠার দিন-তারিখ ঠিক করে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। কলেজে ভর্তির প্রায় সাড়ে তিন মাসের মাথায় আমি বাড়ি গেলাম। সবার সঙ্গে কলেজে পড়াশোনা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু চিরকাল গ্রামের আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা একজন কিশোরের সংগ্রামের ইতিহাসটুকু তার সঞ্চয়ে রেখে দেওয়াই মর্যাদার বলে মনে হয়েছে। চলবে
লেখক: শিক্ষাবিদ