হুমায়ূন আহমেদের ৫ কবিতা
পুনর্মুদ্রণ
প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২০
গৃহত্যাগী জ্যোছনা
প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার
আকাশের দিকে তাকাই।
গৃহত্যাগী হবার মতো জ্যোছনা কি উঠেছে?
বালিকা ভুলানো জ্যোছনা নয়,
যে জ্যোছনায় বালিকারা ছাদের
রেলিং ধরে ছুটোছুটি করতে করতে বলবে,
ও মাগো, কী সুন্দর চাঁদ!
নবদম্পতির জ্যোছনাও নয়,
যে জ্যোছনা দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবে,
দেখো দেখো,
চাঁদটা তোমার মুখের মতোই সুন্দর।
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাঁতে
জ্যোছনা নয়,
যে জ্যোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জ্যোছনা নয়,
যে জ্যোছনা দেখে কবি বলবেন,
কী আশ্চর্য রুপোর থালার মতো চাঁদ।
আমি সিদ্ধার্থের মতো
গৃহত্যাগী জ্যোছনার জন্য বসে আছি।
যে জ্যোছনা দেখামাত্র গৃহের সমস্ত
দরজা খুলে যাবে।
ঘরের ভেতর
ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব, আর হাঁটব।
পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে,
চারদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠ
ডাকবে, আয় আয় আয়...
আমি খুব অল্প কিছু চাই
আমাকে ভালোবাসতে হবে না
ভালোবাসি বলতে হবে না
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ
নিয়ে আমার ঠোঁট
দুটো ছুঁয়ে দিতে হবে না
কিংবা আমার জন্য রাত
জাগা পাখিও
হতে হবে না
অন্য সবার মতো আমার
সাথে রুটিন মেনে দেখা
করতে হবে না কিংবা বিকেলবেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না, এত
অসীম সংখ্যক ‘না’ এর ভিড়ে
শুধুমাত্র একটা কাজ
করতে হবে আমি যখন
প্রতিদিন একবার ভালোবাসি বলব
তুমি প্রতিবার
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে একটুখানি আদর মাখা
গলায় বলবে, পাগলি
কব্বর
তিনি শায়িত ছিলেন গাঢ় কব্বরে
যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেঁধে দেয়া,
গভীরতা নয়।
কব্বরে শুয়ে তার হাত কাঁপে পা কাঁপে
গভীর বিস্ময়বোধ হয়।
মনে জাগে নানা সংশয়।
মৃত্যু তো এসে গেছে, শুয়ে আছে পাশে
তবু কেন কাটে না এ বেহুদা সংশয়?
বাসর
কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা
লোহার তৈরি ছোট্ট একটা ঘর
বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগ নেই
ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে
নামছে আর উঠছে
মানুষ ক্লান্ত হয়
এ ঘরের কোনো ক্লান্তি নেই।
এ রকম একটা ঘরেই বোধহয় বেহুলার বাসর হয়েছিল
নিশ্ছিদ্র লোহার একটা ঘর
কোনো সাপ সেখানে ঢুকতে পারবে না
হিসহিস করে বলতে পারবে না, পাপ করো। পৃথিবীর সব আনন্দ পাপে।
পুণ্য আনন্দহীন। উল্লাসহীন।
পুণ্য করবে আকাশের ফিরিশতারা।
কারণ পুণ্য করার জন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে।
লোহার সেই ঘরে ঢোকার জন্য সাপটা পথ খুঁজছিল
সেই ফাঁকে বেহুলা তার স্বামীকে বললেন, কি হয়েছে, তুমি ঘামছ কেন?
আর তখন একটা সুতা সাপ ঢুকে গেল।
ফিসফিস করে কোনো একটা পরামর্শ দিতে গেল
বেহুলা সেই পরামর্শ শুনলেন না বলেই কি লখিন্দরকে মরতে হলো?
তার সঙ্গে আমার দেখা কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে
ঘরটা শুধু ওঠে আর নামে।
আমি তাকে বলতে গেলাম, আচ্ছা শুনুন, আপনার কি মনে হচ্ছে না
এই ঘরটা আসলে আমাদের বাসর ঘর?
আপনি আর কেউ নন, আপনি বেহুলা।
যেই আপনি ভালোবেসে আমাকে কিছু বলতে যাবেন
ওম্নি একটা সুতা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দেবে।
আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। দয়া করে কিছু বলবেন না।
কাচপোকা
একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা
হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেল।
ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।
বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার
আমার ষোলোটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি
অন্ধকার দেখব বলে।
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার
একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল
বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।
কী গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার!
কাচপোকার ষোলোটা ক্লান্ত পা বারবার
সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।
তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে
তবু সে হাঁটছে
তাকে যেতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।
যে অন্ধকার আলোর জন্মদাত্রী।
























