
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১৯
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২০
বাবার গ্রামে থাকার দিনগুলো খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। বাবা ঢাকা চলে গেলে ওদের সবার মন খারাপ হয়ে যায়। বাবা চলে গেলে, মা আর হাসেন না। নামাজ পড়েন আর আল্লাহকে ডাকেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন-তখন মানুষ মারে। এজন্য মা-বাবা ঢাকা থেকে না ফেরা পর্যন্ত শুধু চিন্তা করেন। বাবুর মন খারাপ হয়ে যায়। মায়ের এই চেহারা বাবুর ভালো লাগে না।
এই বাড়ি ঘেঁষে একটা শুকনো খাল চলে গেছে। বাবু একদিন ওখান দিয়ে যেতেই দেখল, খালের মাঝখানে পানির সরু ধারা। বাবু ভেবে পেল না, এই পানি কোত্থেকে এলো! পরদিন বাবু দেখল খালের অর্ধেক প্রায় পানিতে ভরে গেছে। আর দুদিনের মধ্যে পুরো খালই পানিতে ভরে গেল। শুধু তাই নয়, এ বাড়িতে যে বিশাল পুকুরটি আছে সেই পুকুরের পানি দ্রুত বেড়ে গেল। দুয়েক দিনের মধ্যেই পানিতে ছয়লাব হলো চারদিক। তালিয়ে গেল ফসলের ক্ষেত আর নিচু এলাকা। দ্বীপের মতো জেগে রইল বসতবাড়ির উঁচু ভিটে। চারদিকে এত পানি দেখে বাবু আর মিষ্টির খুশি আর ধরে না।
কিন্তু দুই চারদিন পরই বাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। এখন নৌকা ছাড়া এক বাড়ি থেকে কেউ অন্য বাড়িতে যেতে পারে না। এজন্য সন্ধ্যা বেলায় নাটমন্দিরে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য তেমন ভিড় হয় না। লাবু আর লাবুর বন্ধুরা এখন তেমন আসে না। বাবুদের কোনও নৌকা নেই। বাবু কোথাও যেতে পারে না। বিকেলবেলায় আর খেলা হয় না। বাবু আর মিষ্টি শানবাঁধানো পুকুর ঘাটের বেঞ্চিতে বসে থাকে। বাবুর ঢাকার চমৎকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। টিম-ইমুরা এই বিক্রমপুরেরই একটা গ্রামে থাকে। কতদিন ওদের সাথে দেখা নেই! কী চমৎকারই ছিল ঢাকার দিনগুলো! ওসব ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
একদিন সকালবেলা লাবু ওর কোষা নৌকা নিয়ে ওদের বাড়িতে আসে। এতদিন পর লাবুকে দেখে বাবুর খুশি আর ধরে না। লাবুর নৌকা দেখে বাবু আনন্দে নেচে ওঠে। লাবু চলে গেল মায়ের কাছে। মাকে বলল লাবুর মা পিঠে তৈরি করেছে। বাবু আর মিষ্টিকে নিয়ে যেতে বলেছে। মা বাবুকে সারাদিনের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি হলেও মিষ্টিকে দিলেন না। মিষ্টি এখনো বাবুর মতো বড় হয়নি। আর সাঁতারও জানে না।
বাবু লাবুকে নিয়ে আর দেরি না করে নৌকায় উঠে বসল। বাবু লাবুর হাত থেকে বৈঠা নিয়ে নৌকা চলাতে গেল। নৌকাটা উল্টাপাল্টা ঘুরতে লাগল কেবল। লাবু বলল, তোমারে আরও শিখতে অইবো। এহন লও, আগে পিঠা খাই। তারপর তোমারে লইয়া বিলে যামু।
লাবুর মা বাবুকে দেখে খুব খুশি। থালায় করে নানা রকম পিঠে সাজিয়ে আনলেন। বাবুকে পিঠে খেতে দিয়ে একটা তালের পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। বললেন, আহা, তোমরা এই গ্রামে কত কষ্টই না করো! এখানে তো বিদ্যুৎ নাই, বাত্তি নাই। এতটুকু পথ আইস্যা পোলাডা কেমন ঘামছে। পাকিস্তানি গো বিচার আল্লাহ করবো।
পাশে দাঁড়িয়ে লাবু বাবুকে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করার জন্য তাড়া দেয়। লাবুর সময় কম। আজ সারাদিন ওরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। লাবু আর বাবু নৌকায় চাপল। লাবুদের বাড়ির পাশেই আওলাদের বাড়ি। ওদের চেয়ে মাথায় একটু বড় আওলাদ। আওলাদ কখনো স্কুলে যায়নি। তবে আওলাদের অনেক সাহস। অনেক উঁচু সুপারি গাছে উঠতে পারে। উঁচু থেকে পুকুরে ঝাপ দিতে পারে। এড়া শিয়ালের গর্ত থেকে বাচ্চা বের করতে পারে। লাবু বলল, আজ ওরা শিয়াল ধরতে রথখোলায় যাবে। আওলাদকে ডাকতেই নৌকায় এসে বসল। আওলাদের হাতে একটা বল্লম আর ছালা। শিয়ালের বাচ্চা পাওয়া গেলে ছালায় ভরা হবে। আওলাদ দুটো বৈঠাও নিল। রথখোলা অনেক দূরের পথ। বাবু একটা বৈঠা তুলে নিয়ে অনভ্যস্ত হাতে দাঁড় বাইতে লাগল।
দেখতে দেখতে ওদের নৌকা বিলে এসে পড়ল। বিলের সাথে আশপাশের ফসলের ক্ষেত ডুবে গিয়ে মিলেমিশে পুরো এলাকাটা সমুদ্রের মতো হয়ে আছে। বাতাসের ঝাপ্টায় তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল ঢেউ। বাবুর একটু ভয় লাগল। ভীষণ বেগে নৌকার তলায় ঢেউগুলো ঝাপ্টা খাচ্ছে। দূরে বিন্দুর দেখা যাচ্ছে আরেকটা নৌকা। ওটাও রথখোলার দিকে যাচ্ছে।
লাবু বলল, ’আওলাদ জোরে টান। ওই ব্যাডারে ধরতে আইবো।’ উৎসাহ পেয়ে বাবু আর আওলাদ প্রাণশক্তিতে বৈঠা চালাতে লাগল। লাবু গান ধরল, স্বাধীন বাংলার গান।
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে
আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে।
সত্যি সত্যি ওরা আগের নৌকাটা ধরে ফেলল। তারপর লাবু দাঁড়িয়ে নিজেদের নৌকা দুলিয়ে ঢেউ বানিয়ে ওই নৌকাটা পেছনে ফেলল। এতক্ষণ নৌকা চালিয়ে হাঁপিয়ে গেছে সবাই। এবার ওরা স্বাভাবিক ভাবে দাঁড় বাইতে লাগল।
আগেকার জমিদাররা রথটানার জন্য বিশাল একটা জায়গাকে উঁচু করে, যাতে বর্ষার পানিতে ডুবে না যায়। মাঝখানে বিশাল বিশাল পুকুর কেটে মাটি তুলে চারদিক উঁচু করে রথটানার জন্য রাস্তা করা হয়। অনেক বছর ধরে এখানে রথটানা হয় না। ফলে রথটানার রাস্তা ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এখানে মানুষজন তেমন একটা আসে না। তবে বর্ষা এলে আশপাশের শস্যক্ষেত আর নিচু এলাকার সব জীবজন্তু এখানে এসে বাসা বাঁধে। লাবু বলেছে, এখানে সাপ, শিয়াল, বাঘডাশ, এমন কি চিতা বাঘও থাকতে পারে। লাবুর মুখে একথা শুনে বাবু একটু দমে গেল। ওর গা ছমছম করতে লাগল। কিন্তু ভয়ের কথা বললে লজ্জা পেতে হবে। লাবু একদিন বাবুকে বলেছিল, ’তোমরা ঢাকার পোলা। তোমগো কত সাহস। মিলিটারি গো ভয় পাও না!’ সুতরাং বাবুকে ভয় পেলে চলবে না।
ওদের নৌকা রথখোলায় ভেড়ে। পাড়টা বেশ উঁচু। নৌকাটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ওরা খাড়া পাড় বেয়ে রথখোলায় নামে। বর্ষার পানি পেয়ে জঙ্গল খুব ঘন হয়েছে। পায়ে চলার পথ নেই। বল্লমের লাঠি দিয়ে ঝোপঝাড়ে বাড়ি দিতে দিতে আওলাদ আগে আগে যাচ্ছে। সাপ তাড়ানোর বুদ্ধি। তবু বাবুর ভয় করতে লাগল। উঁচু উঁচু গাছের ডাল থেকে যদি সাপ লাফিয়ে ওদের গায়ে পড়ে কিংবা বাঘডাস কিংবা চিতাবাঘ যদি নেমে আসে! বাবু ওর হাতের বৈঠাটা শক্ত করে ধরল। যাই আসুক এই বৈঠা দিয়ে মারতে হবে। ঝোপঝাড় পাড় হওয়ার পর ওরা একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেল। বাবুর ভয়টা কমল। পাশেই বিশাল দীঘি। লাবু বলল, আগে এই দীঘির চারপাশ দিয়ে রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হতো। গাছের ডালে বসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ছাড়া ওরা এ পর্যন্ত ভয়ংকর কিছুই দেখেনি।
ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প শুরু করল। এ সময় হঠাৎ করে একটা গুরু গম্ভীর ভেসে আসে, ’কে ওখানে?’ হঠাৎ করে মানুষের গলা পেয়ে ওরা তিনজনই মারাত্মক চমকে গেল। এখানে ওরা বাঘের গলা আশা করলেও মানুষের কণ্ঠ আশা করেনি। ওরা কণ্ঠের উৎসের দিতে তাকালো। প্রথমে কয়েকটা শুকনা ডাল ভাঙার শব্দ। তারপর জঙ্গল ফুঁড়ে উদয় হলো বাবরি চুল আর দাড়িঅলা ভয়ংকর দর্শন একলোক। লোকটির হাতে রাইফেল। সেটা নাড়াতে নাড়াতে মেঘের গর্জনেরমতো লোকটি বলল, খবরদার কেউ একচুল নড়বে না।
এরপর লোকটি পকেটে রাখা বাঁশিতে ফুঁ দিল। ওরা তিনজন মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অল্প সময়ে মধ্যে আরও তিনজন লোক চলে এলো। এদের হাতেও রাইফেল আর স্টেইনগান। সঙ্গিদের বলল দাড়িঅলা, কোত্থেকে এই তিন গজব হাজির! এখন কী করবে করো।
একজনের দিকে তাকিয়ে লাবু হঠাৎ বলে উঠল, হাসান ভাই আপনে!
হাসান ভাই ওদের দিকে ফিরে তাকালো। বাবু এই লোককে চেনে! উনিই মঠ ভেঙেছিলেন। হাসান ভাই কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, আরে লাবু তোরা! তারপর বিরক্ত হয়ে বললেন, এখানে তোরা কি করছিস?
আমরা তো শিয়াল ধরতে আইছিলাম। আওলাদ বলল।
শিয়াল ধরার আর জায়গা পেলি না! হাসান ভাই বললেন। কিন্তু অহন আমি তোগো নিয়া কি করি? তগরে তো অহন ছাড়া যায় না।
ঠিক কইছ এগুলারে ছাড়লেই গ্রামে যাইয়া সব কইয়া দিব। এক কাম করো, এগো বাইন্দা রাখো। দাড়িঅলা লোকটি বলল।
কিন্তু কত দিন ওগো বাইন্দা রাখুম। আবার ছ্যাইরা দিলেও পাকিস্তানি চররা সব জানবো। কী যে করি!’ হাসান ভাই চিন্তিত স্বরে বললেন।
ও আপনারা বুঝি মুক্তিযোদ্ধা! বাবু প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল। বাবুর ভয় কোথায় উবে গেছে। দাড়িঅলা লোকটাকে এখন আর ভয়ংকর মনে হচ্ছে না।
বাবুর কথা শুনে লাবু বলে ওঠে, হাসান ভাই, আমাগো আপনে গো দলে নেন। আমরাও মুক্তিযোদ্ধা হমু।
হাসান ভাই ধমকে উঠে লাবুকে বলেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। দেখি কি করা যায়!
অগত্যা ওরা তিনজন অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হাসান ভাই দাড়িঅলার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা শেষ করেন। তারপর লাবুকে বলেন, দেখ লাবু, তোরা আমগো ঘাঁটি দেখছস। এজন্য তোগরে মারাই আমগো নিয়ম। আর তোরা কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হইতে পারবি না। অনেক শক্ত কাম।
আওলাদ বলে, আগে আমগো মুক্তিযোদ্ধা বানান। আমরা সব কামই পারুম। খালি কন কি করতে হইবো।
হাসান ভাই বললেন, প্রথম কাম, এই ঘাঁটির কথা তোরা তিনজন ছাড়া আর কেউ যেন না জানে। কাউরে না কইলেই তোগো মুক্তিযোদ্ধা বানামু।
আরে না, এহন থিক্যাই ওরা মুক্তিযোদ্ধা। অহন বাড়ি যাও। কথা যেন ঠিক থাকে। দাড়িঅলা বললেন। পোলাপানও মুক্তিযোদ্ধা হইতে চায় টিক্কা খানের বাবাও আমগো স্বাধীনতা ঠেক্যাইতে পারবো না। কথাটা বলে দাড়িঅলা হাসতে থাকেন।
ওরা তিনজন তীব্র উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য নৌকায় ওঠে। শিয়াল ধরার কথা ওদের মনেও থাকে না। ওদের বয়স বেড়ে গেছে। এখন আর খেলার সময় নেই। প্রায় সন্ধ্যা হবো হবো সময়ে লাবু বাবুকে ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। বাবু দেখল মায়ের মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। বাবুকে সামনে পেয়েই মা ওর গালে চড় লাগিয়ে দিলেন। বাবু মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মায়ের চোখে পানি।
আমি সেই কখন থেকে টেনশনে মরছি। আর উনি এখন এলেন। লৌহজং থানায় মিলিটারি এসেছে। ওরা নাকি গ্রামের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করবে। তোর বাবা ঢাকায় গিয়ে বসে আছে। এ গ্রামে থাকা যাবে না। তোদের দুজনকে নিয়ে আমি এখন কোথায় যাই! মায়ের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে। চলবে