
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ২১
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২০
ইমামের মাথায় এখন শুধু ঢাকা অপারেশনের চিন্তা। বিমান ছিনতাই পরিকল্পনা বাতিলের পর ইমামের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন ওর দেহ ও মন দুই-ই সতেজ। কারও অপেক্ষা না করে ইমাম নিজের মতো করে ঢাকা অপারেশনের পরিকল্পনা সাজায়।
ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় থাকেন ইমামের ডিপার্টমেন্ট হেড। ইমাম এই ভদ্রলোকের সাথে ছাত্রের মতো আচরণ না করে বন্ধুর মতো আচরণ করে। ছেলের বয়সি এই ছাত্রের আচরণ ভদ্রলোক বেশ উপভোগ করেন। ইমাম অবলীলায় সিগারেট বের করে স্যারকে দেয়। এরপর নিজেও সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে এক ম্যাচের কাঠিতে দুজনের সিগারেটে আগুন ধরায়। স্যারের স্ত্রীকে ভাবি ডেকে নানা ধরনের ঠাট্টা মশকরা করে।
এক সকালে ইমাম ওর গাড়ি নিয়ে ফুলার রোডে স্যারের বাসায় হাজির হলো। স্যার আর ভাবি ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছিলেন। ইমাম টেবিল থেকে একটা কলা নিয়ে চেয়ায়ে বসে খাওয়া শুরু করল। স্যার বললেন, এসেই খাওয়া শুরু করলে! মতলব কি?
ডিভাইন কজ স্যার। আপনার গাড়িটা দরকার।
কেন? নিজেরটা কি হাসপাতালে পাঠিয়েছ?
নট দ্যাট। আমারটা দিয়ে অপারেশন চালালে তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যাব স্যার। এজন্য একটা গাড়ি ধার করা দরকার। আপনিই দেন।
কিসের অপারেশন শুনি?
গোটা বিশেক খানসেনা খতম করতে হবে। তিন-চার ঘণ্টাই যথেষ্ঠ। অপারেশন শেষে আপনার গাড়ি আমরা কোথাও ফেলে রাখবো। আপনি তুলে নিয়ে আসবেন।
এই সাতসকালে তুমি কি মস্করা করতে এসেছ? অন্য কোনও মতলব থাকলে বলো। আমার সময় নষ্ট করো না।
স্যারকে অপারেশনের ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে ইমামকে অনেক সময় ব্যয় করতে হলো। শুনে স্যার বললেন, কিন্তু এই রিস্ক আমি নিতে পারি না। আমি গাড়ি দেব না।
ফের শুরু হলো ছাত্র-শিক্ষকের তুমুল তর্ক। স্যার কিছুতেই গাড়ি দেবেন না। আর ইমাম গাড়ি নিয়েই ছাড়বে। এতক্ষণ ভাবি নীরবেই এদের তর্কাতর্কি শুনছিলেন। স্যারকে রাজি করাতে না পেরে ইমাম অসহায়ভাবে ভাবির দিকে তাকাল। ভাবি যা বোঝার বুঝে নিলেন। বললেন, আহ, কী শুরু করলে তুমি! পঁচিশে মার্চে পর থেকে তো গাড়িটা গ্যারেজে ফেলে রেখেছ। বললে পরাধীন দেশে গাড়ির বিলাসিতা মানায় না। দেশ স্বাধীন না হলে গাড়ি তো
এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে। আর ও তো বলছেই, তুমি থানায় জানাবে গাড়িটা গ্যারেজ থেকে চুরি গেছে। তুমি এমন করছ কেন?
তুমি কি জানো? ভাবির দিকে তাকালেন স্যার, তারপর অন্যদিকে ফিরে ধরা গলায় বললেন, ইমাম যা বলে তুমি তাই বিশ্বাস কেন করো? এই বাচ্চাছেলেদের পক্ষকে কি ঢাকার রাস্তায় খানসেনাদের মারা সম্ভব! গাড়ির মায়া কে করে! গাড়ি তো যাবে। গাড়ির সাথে ওরাও মরবে।
কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। অবশেষে ভাবিই মুখ খুললেন। মৃদু স্বরে বললেন, তুমি তো ইমামকে চেনো। ও কি তোমার কথা শুনবে! তুমি গাড়ি না দিলে ও অন্য কারও গাড়ি সত্যি সত্যি চুরি করবে। এতে তো ওদের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
তুমিও আমাকে কম জ্বালালে না দেখছি! ভাবির দিকে তাকিয়ে স্যার ললেন। তারপর স্যার ইমামের দিকে তাকালেন, তা এই পিকনিকে কবে যাচ্ছ?
শীঘ্রই স্যার।
ঠিক আছে, আমি গাড়ির একটা ডুপ্লিকেট চাবি করে রাখব। কাল এসে নিয়ে যাবে। আর গ্যারেজ থেকে তালা ভেঙে গাড়ি বের করবে। ভাঙা তালা গ্যারেজের আংটার সাথে ঝুলিয়ে রাখবে।
থ্যাঙ্কয়্যু স্যার।
খান সেনাদের মারতে না পারলে তোমার খবর আছে।
ইমামের এক খালা বনানীতে থাকেন। তার স্বামী আগাখানী সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্য আত্মীয়রা এই খালাকে এড়িয়ে চললেও এই খালার বাড়িতে ইমামের যখন-তখন আনাগোনা। খালার বাড়িতে বিভিন্ন পার্টি লেগেই থাকে। ইমাম কোনো রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে এসব পার্টিতে হাজির হয়। অবাঙালি খালু এজন্য ইমামকে পছন্দ করে। দূর্গের মতো উঁচু প্রাচীর ঘেরা তিনতলা বাড়ি। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে বন্দুকধারী বিহারী দ্বাররক্ষী। ইমাম ভেবে দেখল, এ বাড়িটি এখন ঢাকার মধ্যে অন্যতম নিরাপদ বাড়ি। ইমাম ওর লাগেজ নিয়ে খালার বাসায় হাজির হলো।
খালা ওর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করতেই ইমাম মুখ খুলল, আর বলো না খালা। বাড়িতে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেলাম। কী যে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে! ঠিক করলাম, তোমার বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থাকবো। জাস্ট আ চেঞ্চ আর কি! অবশ্য তুমি যদি থাকতে দাও!
এই হারামজাদা, তোকে আমার বাড়িতে থাকতে কে মানা করেছে। তিনতলার গেস্ট রুমে গিয়ে থাক না। তোকে কে মানা করেছে! ও ঘরে রেডিও আছে, রের্কড প্লেয়ার আছে। আমার ঘরে অনেক ভালো ভালো রেকর্ড আছে। পছন্দমতো বেছে নিস।
ফাইন খালা। খালা, আমার বন্ধুরা যদি মাঝে মাঝে এখানে আড্ডা মারতে আসে তবে কি তোমার অসুবিধা হবে? বোঝও তো, এখন গণ্ডগোল হচ্ছে। বাইরে আড্ডা দিতে ভয় লাগে।
আসুক না বন্ধুরা, ওদেরও তোর সাথে থাকতে বল। তিনতলায় এটাচ বাথরুমসহ সবই আছে।
কিন্তু খালু যদি কিছু মনে করে?
কী যে পাগলের মতো কথা বলিস। তোর খালু তোকে খুবই পছন্দ করে। আর তার এসব দেখার সময় কই!
খালা একটু আনমনা হয়ে যান। খালা খালুর দ্বিতীয় স্ত্রী। এ কারণে খালু নিয়মিত এ বাড়িতে থাকেন না। খালা যেন বিশাল দৈত্যপুরীতে দৈত্যের হাতে বন্দি এক দুঃখিনী রাজকন্যা। খুব সূক্ষ্ম চোখে না দেখলে খালার এই দুঃখের খবর কেউ জানবে না। মেয়েরা যে কত কি লুকাতে পারে!
ইমামের কাজের অগ্রগতি জেনে সিরাজুলের মনটা খুশিতে ভরে গেল। ইমামকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। ঢাকা অপারেশন নিয়ে এখন সিরাজুলের সামান্যতম দ্বিধা নেই। চলবে