অপূর্ব চৌধুরীর কলাম ‘ভাষার বৈচিত্র্য ও বাংলা ভাষা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১

পৃথিবীতে ভাষা আছে সাত হাজারের ওপরে। সবচেয়ে প্রাচীনতম লিখিত ভাষার বয়স সাড়ে পাঁচ হাজার। নাম, সুমারিয়ান। বর্তমান ইরাক অঞ্চলে তার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত আছে এমন ভাষার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা তামিল। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো।

শুধু এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি ভাষার জন্ম। প্রায় ২৩০০ এর বেশি। এর পরে আছে আফ্রিকায় হাজার দুয়েকের ওপরে ভাষা। ইউরোপে জন্ম নেয়া ভাষার সংখ্যা তিনশোর বেশি। অনেক মার্কিন ইংরেজি নিয়ে বড়াই করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এবং বিমানের পাইলটদের সবাই একই ভাষা বুঝার সুবিধা ছাড়া ভাষায় আমেরিকান ইংলিশের অবদান খুব কম। সাহিত্যে তথৈবচ। বর্তমানে কম্পিউটার জায়গা করে নিয়েছে ইংরেজি, তবে তা একা আমেরিকান ইংরেজি নয়।

আমেরিকার জনসংখ্যা ত্রিশ কোটির ওপরে হলেও মাত্র বিশ কোটির বেশি মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। আমেরিকায় দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় ভাষা স্প্যানিশ। মাতৃভাষার সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি চাইনিজ ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে। দ্বিতীয় স্প্যানিশ এবং তৃতীয় ইংরেজি।

সারা পৃথিবীতে ইংরেজিতে মাতৃভাষার সংখ্যা চল্লিশ কোটির বেশি নয়। সেখানে স্প্যানিশ মাতৃভাষা পঞ্চাশ কোটির বেশি। পৃথিবীর শতকরা আট ভাগ লোকের প্রথম ভাষা স্প্যানিশ। ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে প্রথম স্প্যানিশ, এরপরে পর্তুগিজ।

ইংরেজি ভাষায় দেড় বিলিয়ন মানুষ yes, no, very good ধরনের ইংরেজি বলতে পারে। কেউ স্যংখ্যাটিকে দুই বিলিয়ন দাবি করে। সে হিসেবে, ইংরেজিভাষী পৃথিবীর শতকরা বিশ থেকে পঁচিশ ভাগ। প্রতি পাঁচজনে একজন। আঠারোশো শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জার্মান ভাষা তাদের মাতৃভাষা হওয়ার কথা ছিল। ১৭৯৫ সালে কংগ্রেসে এক ভোটাভুটি হয়। তাতে জার্মান ভাষা মাত্র এক ভোটে হেরে যায় ইংরেজির কাছে। ইংরেজি হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রধান ভাষা।

মজা হলো, এখনো পর্যন্ত আমেরিকার কোনো State Language নেই সংবিধান অনুযায়ী। আমেরিকা একটি বহুজাতিক ভাষার দেশ। পূর্ব থেকে থাকা নেটিভ রেড ইন্ডিয়ানদের পরে সতেরো শতকে প্রথম ডাচ এবং জার্মানরা আসে। তারপরে আসে ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চরা। বর্তমানে গোটা আমেরিকায় তিনশোর বেশি ভাষায় কথা বলার লোক আছে। বাইরে ইংরেজি ভাষা হলেও সেখানে ঘরের ভাষা বহুজাতিক। তবে শুধু লন্ডন শহরেই তিন শতাধিকের উপর বহুভাষিক অধিবাসীর বসবাস। লন্ডন পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বহুজাতিকের শহর।

ইংরেজির ভাষার জনক ব্রিটিশরা হলেও আমেরিকানরা ব্রিটিশদের তিনগুণ বেশি ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। ব্রিটিশ ইংরেজি ভাষিক মাত্র ছয় কোটি, আমেরিকান  ইংরেজি মাতৃভাষা ২০ কোটির বেশি, সারা পৃথিবীতে ইংরেজি মাতৃভাষা ৪০ কোটির বেশি। শুনতে অবাক লাগলেও আমেরিকার পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ ইংরেজি মাতৃভাষার দেশ নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ড নয়। নাইজেরিয়াতে আট কোটির বেশি লোকের মাতৃভাষা ইংরেজি।

ইংরেজির পর পৃথিবীজুড়ে শিক্ষিত লোকেরা সবচেয়ে বেশি জানে ফ্রেঞ্চ ভাষা। ব্রিটেনের বাইরে ইউরোপে ফ্রেঞ্চ হলো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা অফ ইউরোপ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ফ্রেঞ্চ ভাষিক প্যারিস প্রথম হলে, দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে কঙ্গোর কিনসাসা শহরের লোকেরা। বিশ্বে ইংরেজি ভাষার বিস্তারে উনিশ শতক পর্যন্ত ব্রিটিশ উপনিবেশ ব্যবসা এবং বিশ শতকের অর্ধেকের পর ফিল্ম, মিডিয়া এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে আমেরিকান ইংরেজি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে। বর্তমানে কম্পিউটারের দুই তৃতীয়াংশ তথ্য ইংরেজি ভাষায় লেখা। মজা হলো, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ভাষা ইংরেজি হলেও তাদের রাষ্ট্রীয় motto ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা।

ইংরেজি ভাষার মূল উৎপত্তি ইংল্যান্ডে নয়। পনেরোশো বছর আগে পশ্চিম জার্মানের Angels নামক একটি জাতি জার্মানির পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে গিয়ে একসময় বর্তমান ইংল্যান্ডে এসে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের ভাষা ছিল জার্মান ভাষার একটি ডায়ালেক্ট Anglo Frisian। তখন ইংল্যান্ডের লোকজন যে ভাষায় কথা বলতো তার নাম ছিল Celtic। এই Angels থেকেই English এবং England এসেছে। আমরা বাংলা করেছি ইংরেজ। ইংরেজির মূল উৎপত্তি জার্মান হলেও ইংরেজি ভাষার এক তৃতীয়াংশ শব্দ ফ্রেঞ্চ। কারণ, ফ্রেঞ্চরা চারশো বছর ইংল্যান্ডের কিছু অঞ্চল শাসন করেছিল।

ইংরেজির দেশ ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টরিয়া ইংরেজি ভাষা জানতেন খুব কম। কারণ তিনি ঘরে জার্মান ভাষায় কথা বলতেন এবং দরবার চালাতেন জার্মান ভাষায়। রানী ভিক্টরিয়ার মা ছিল এক জার্মান বিপত্নীক। বর্তমান রানী এলিজাবেথের দ্বিতীয় স্বামী ফিলিপ বাপের দিক থেকে গ্রিক, দাদার দিক থেকে ডেনিশ এবং নানার দিক থেকে জার্মান। জন্মেছেন গ্রীকে, পড়ালেখা করেছেন ফ্রান্সে, কাজ করেছেন ব্রিটিশ রয়েল নেভিতে এবং রাজা হয়েছেন এলিজাবেথকে বিয়ে করে ব্রিটেনে। বহুজাতিক রাজা।

নেটিভ স্পিকারের সংখ্যায় বাংলা ভাষা চতুর্থ নাকি পঞ্চম, এ নিয়ে হিন্দির সাথে দ্বন্দ্ব আছে। কোনো হিসেবে, হিন্দি চতুর্থ বড় ভাষা, বাংলা পঞ্চম। কারো হিসাবে উল্টো। কারণ, প্রথম ভাষা হিসাবে হিন্দি কমছে, কিন্তু বাংলা প্রথম ভাষা বাড়ছে। একশো বছর আগে সারা ভারতে বাংলায় কথা বলার লোক ছিল চার কোটির উপরে। মজা হলো, সমসাময়িক কালে হিন্দি ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলার চেয়েও কম ছিল। বিশ  শতকের অর্ধেকের পর পুরো ভারতে হিন্দির দৌরাত্ম বেড়ে যায়, পশ্চিমবঙ্গে বাংলার প্রভাব কমে যায়, কিন্তু উর্দু ও ফার্সীকে বিদায় করে বাংলাদেশে বাংলা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে আটাশ কোটির বেশি অধিবাসীর ঘরে বাংলা মাতৃভাষা। তার দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে।

প্রতি বছর ভাষা কমে যায়। কারণ, সে ভাষায় একজনও বলার মতো থাকে না। সবচেয়ে কম কথা বলা ভাষা ক্যামেরুনের Busuu ভাষা। মাত্র তিনজন কথা বলতে পারে এই ভাষায়। সবচেয়ে বেশি ভাষা আছে পাপুয়া নিউগিনিতে। প্রায় আটশোর উপরে ভাষা দ্বীপ দেশটিতে। পৃথিবীর অর্ধেক লোক মাত্র ২৩টি ভাষায় কথা বলে। আবার চার বিলিয়নের উপরে মানুষ দুটি ভাষায় কথা বলতে পারে। পৃথিবীর জনসংখ্যা আট বিলিয়নের মতো।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে বাইবেল। প্রায় ছয়শোর বেশি ভাষায় অনূদিত। তিন হাজারের উপরে ভাষায় বাইবেলের অংশবিশেষ অনুবাদ করা হয়েছে। কোরআন অনুবাদ করা হয়েছে পঞ্চাশটির মতো ভাষায় মাত্র। কোরআনের অংশ বিশেষ আয়াত অনুবাদ করা হয়েছে ১১০টি ভাষায়। শুনতে অবাক লাগলেও নবম শতাব্দীতে সম্পূর্ণ কোরআন প্রথম অনুবাদ করা হয় গ্রীক ভাষায়। সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলা হয় ফ্রেঞ্চ ভাষাকে। দ্বিতীয় স্থান নিয়ে বাংলা এবং ইতালিয়ান ভাষার লড়াই। আবার সবচেয়ে দ্রুত বলা ভাষা জাপানি এবং সবচেয়ে আস্তে বলা ভাষা চাইনিজ ম্যান্ডারিন।

গ্রীক ভাষার প্রথম দুটি বর্ণমালার নাম আলফা ও বেটা। দুটো মিলে ইংরেজি Alphabet বা বর্ণমালা শব্দটি এসেছে। বাংলা বর্ণমালা ২৮টি। সবচেয়ে বেশি বর্ণমালা আছে কম্বোডিয়ার খেমার ভাষায়, ৭৪টি। সবচেয়ে কম পাপুয়া নিউগিনির রোটকাস ভাষায়, মাত্র ১১টি বর্ণমালা। ভারতে প্রায় চারশোর বেশি ভাষা আছে। তার মধ্যে হিন্দি ও ইংরেজি রাষ্ট্রের অফিসিয়াল ভাষা। ২০টি ভাষা স্টেটগুলোর প্রধান অফিসিয়াল ভাষা। রাষ্ট্র হিসাবে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল ভাষা সবচেয়ে বেশি, ১৬টি। তারপরে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ১১টি। ইতালিয়ানদের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইতালিয়ান নয়। ফ্লোরেন্টিন নামের একটি আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট তাদের রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল ভাষা।

ইংরেজির মূল জনক ব্রিটেনে ইংরেজির ভাষার ৪০টি ডায়ালেক্ট আছে। আমেরিকায় আছে ২৪টি। বইয়ের ভাষায় বাংলা ডায়ালেক্ট ছয়টি। যদিও জেলার হিসাবে আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট অনেকগুলো। সবচেয়ে বেশি শব্দ ইংরেজি ভাষায়। এক লক্ষ সত্তর হাজারের উপরে। দ্বিতীয় রাশিয়ান ভাষার শব্দ সংখ্যা দেড় লক্ষের উপরে। তৃতীয় কোরিয়ান ভাষা। বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা নিয়ে ভালো গবেষণা ও সঠিক তথ্য নেই। এই ভাষার মানুষগুলোর মতো নিজেদের ইচ্ছামতো এক একটি দাবি করে বসেছে। কেউ আজগুবি দাবি করে, এক লাখের উপরে, কেউ দেড় লাখ। সবগুলোই মামুর বাড়ির আবদার! বাংলায় প্রকাশিত ডিকশনারিগুলোতে গড়ে পঁচাত্তর থেকে আশি হাজার বাংলা শব্দ থাকে। যার একটি ভালো অংশ অব্যবহৃত, অপ্রচলিত ও পরিবর্তিত। একটি আপাত হিসাব হচ্ছে, তদ্ভব বা খাঁটি দেশি শব্দ চল্লিশ হাজারের মতো, তৎসম বা সংস্কৃত থেকে গ্রহণ করা শব্দ বিশ হাজার এবং বাকিগুলো বিদেশি বা অন্য ভাষা থেকে নেয়া।

ইংরেজি ভাষায় কথা বললে বাম মস্তিষ্ক কাজ করে। কিন্তু চাইনিজ ভাষায় কথা বললে বাম ও ডান, দুই মস্তিষ্কই কাজ করে। বেশির ভাগ ভাষার ক্ষেত্রে বাম মস্তিষ্কই কাজ করে। কারণ, মানুষের ল্যাংগুয়েজ সেন্টার থাকে মস্তিষ্কের বাম পাশে। নাম Broca’s area।