অপূর্ব চৌধুরীর গদ্য ‘বাঙালি কেন বই পড়ে না’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২১

পরীক্ষা পাশের জন্যে মুখস্ত করা এই জাতির মেধাবীরাও বই পড়ে না। অন্যদের কথা বাদ দিলাম। কারণ তাদের লক্ষ্য, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া। সারা জীবন এরা যতগুলো পাঠ্যবই পড়ে, চাকরির জন্যে তার চেয়ে বেশি গাইড বই পড়ে। আর মাঝে সাঝে বই পড়লে পড়বে ফিকশন কিংবা গল্প-উপন্যাস।

টিনএইজ ছেলেমেয়েরা উঠতি বয়সে কলকাতার অখাদ্য সুনীল, শীর্ষেন্দু ও সমরেশদের কিছু নিম্ন শ্রেণির উপন্যাস পড়ে ঠিক করে নেয়, বাকি জীবন এইগুলোই ভালোর স্ট্যান্ডার্ড। লঙ্গরখানায় খিচুড়ি খেয়ে বিরানি ভেবে বসে। অখাদ্যের বর্বর মেষপালক হুমায়ূন তো জাতীয় উড়নচণ্ডী। হিমু, মিসির আর শুভ্র বেচে তার রঙ্গপল্লী বানানোই ছিল উদ্দেশ্য। অকালে পটল তুলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চরম লাভ করে গেছেন! কারণ আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে ঘেটুপুত্র বিষ্ঠা গিলতে হতো লোকদের! যার বইতে না আছে সাহিত্য না আছে জীবন। এরপরেও দেশের মানুষগুলো তৃপ্ত! কারণ বই পড়ছে এটাই তাদের কাছে অনেক বড়! কী বই পড়ছে, এটা বড় কথা নয়।

পৃথিবীতে বছরে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করে ইংরেজরা। ছয় কোটির দেশ ব্রিটিশরা বছরে বই বের করে দুই লক্ষের মতো। তার ৬০% নন ফিকশন। বাংলাদেশের আঠারো কোটি বলদেরা মিলে বছরে বের করে ছয় হাজার বই। তার ৫০% কবিতা, ৩০% গল্প-উপন্যাস, মাত্র ১০% প্রবন্ধ! তার মানে ৮০% বই ফিকশন, ১০% নন ফিকশন! বিশ্বে বছরে আড়াই মিলিয়ন বই প্রকাশিত হয়। সারা বছর গড়ে ছয়শো মিলিয়ন কপি বই বিক্রি হয়। বইয়ের ৪৬% নন ফিকশন, ৩৫% ফিকশন। আর আমরা ১০%! এ জাতির লোকেরা কী অখাদ্য খায়, বোঝাই যায়।

ব্রিটিশরা বছরে দুই লক্ষের মতো বই বের করে। তার এক লক্ষ বিশ হাজারের মতো থাকে কেবল নন ফিকশন, সিরিয়াস বুক। বছরে বইয়ের রেভিনিউ এক বিলিয়ন পাউন্ডের চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করে চীনারা, পাঁচ লক্ষ। আমেরিকানরা তিন লক্ষ। জাপানিরা দেড় লক্ষ। তবে বই কেনার দিক থেকে আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি খরচ করে টাকা। বছরে কমপক্ষে চারটি নন ফিকশন পড়ে, গড়ে আটটি নন ফিকশন কেনে।

ব্রিটিশ, আমেরিকা, ফ্রাঞ্চ, জার্মানি, জাপান— এসব দেশের লোকেরা বছরে যা বই পড়ে তার ৬০% নন ফিকশন থাকে। বাংলাদেশের এমন লোকও পাওয়া যাবে, সারাজীবন গল্প-উপন্যাস পড়েছে, একটি নন ফিকশন বই সারা জীবনেও পড়তে পারেনি। কেন এমন মানুষগুলো! যখন উন্নত বিশ্বের স্কুলপাশ মানুষগুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের চেয়েও বেশি বই পড়ে, বেশি নন ফিকশন পড়ে।

কারণ দুটো।
এক. আমাদের নন ফিকশনের ভালো বই নেই। আমরা চটি পড়ার জাত। এখানে সিরিয়াস ভালো বই প্রকাশও হয় না, পড়েও না লোকজন। যা খেয়ে বড় হয়, রুচির ব্যারোমিটার তেমনি থাকে।
দুই. আমাদের শিক্ষা, সামাজিক সিস্টেম এবং মনোভাব। আমাদের দেশে পরিবারগুলোতে বাচ্চাদের বই পড়তে উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করা হয়। বলা হয়, স্কুলের বইগুলো পড়ো। অন্যগুলো পড়ে সময় নষ্ট করো না। এখানে লোকদের মানসিকতা হলো, বই পড়ার অর্থ জ্ঞান অর্জন নয়, এসব অবসরের বিনোদন। ঘুম আনতে লোকেরা বই পড়ে। বিনোদনের কাতুকুতু পেতে বই পড়ে। তারা পরীক্ষা পাশের মেধাবী হোক আর বলদ হোক, প্রিয় বইয়ের তালিকায় এদের কিছু কচু, কিছু শালগম মার্কা লেখকের গল্প-উপন্যাস।

এই অথর্ব জাতির লোকগুলো আগামী এক হাজার বছরেও পরিবর্তন হবে কিনা সন্দেহ। কারণ, বংশ পরম্পরায় এরা শর্টকাটে সারতে চায় সবকিছু। শৌচাগারে গেলেও ছটফট করে কখন বের হবে, কার পাছায় আঙুল দিয়ে গুতোবে। পরীক্ষাগারে ঢুকলেও ভাবে, কতভাবে ভেজাল মিশিয়ে কাজ সারা যাবে। এরা সারাদিন মডেলদের কাপড় কতটুকু উঠে আছে, তা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকে। এদের জীবনের আদর্শ নুনু প্রদর্শনকারী জুয়াড়ি ক্রিকেটার, চিটার খেলোয়াড়, প্রলাপ বকা পলিটিশিয়ান! এদের লেখকগুলো মাতালগ্রস্ত, বুদ্ধিজীবীগুলো বুদ্ধু! এদের কবিগুলো কাকের মতো শব্দের কা কা করে, এদের নাট্যকাররা হাসির জিনিস ফুটাতে গিয়ে মাথার চুল ছেঁড়ার মতো সংলাপ বানায়।

এদের দিয়ে আর কিছু হোক, বই, জ্ঞান এবং একটি প্রজ্ঞাময় পৃথিবীর রচনা সম্ভব নয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চিকিৎসক