
অমিত কুমার কুণ্ডুর গদ্য ‘জীবনের ভাঙাচোরা গল্প’
প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০২২
বিবাহ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। যে মেয়ের উপযুক্ত সময়ে বিয়ে হয় না, তাকে সমাজের মোটা মোটা চোখগুলো তীর্যক দৃষ্টিতে দেখে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। আজও একা থাকা একজন মেয়ের পক্ষে শুধু কষ্টকরই নয়, বরং প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। কানা হোক, খোঁড়া হোক, বেকার হোক, ভেগাবণ্ড হোক, বর একটা জুটাতেই হবে।
যার বর জুটছে না, অথবা যার এই মুহূর্তে বর নেই, তারও সমাজের নানা যাতনা ভোগ করতে হয়। একা মেয়েকে বাড়িঅলা বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। একা মেয়েকে পরিবার থেকে ট্যুরে যেতে দিতে চায় না। একা মেয়ের অনেক ঝক্কি। শুধু অনূঢ়া কন্যা নয়। বিপত্নীক বা ডিভোর্সি মেয়েদের যাতনাও কম নয়। যাদের এই দশা হয়, তারা যেন সমাজের সকলের হয়ে যায়। নানা ছুতোয়, নানা অজুহাতে সমাজের দুষ্টু হাতগুলো তাদের ছুঁতে চায়। তাদের নিঃসঙ্গ শরীরের স্বাদ নিতে চায়। এই জংধরা সমাজের মুখোশের আড়ালের নোংরা মুখগুলো সবার আগে সেইসব একা হয়ে যাওয়া মেয়েরাই দেখতে পায়।
এর থেকে পরিত্রাণ এই আধুনিক সমাজের কোনো বাঙালি মেয়েই পাচ্ছে না। যে মেয়ে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে, কারণে অকারণে সমাজের বাধা পাওয়া মুখগুলো সরব হয়ে ওঠে। সেসব মেয়েদের নিয়ে রসালো গল্প রটায়। এই মিথ্যা রটনার তপ্ত আঁচ ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সেসব মেয়েদের গায়ে লাগে। তাদের মনঃপীড়ার কারণ হয়।
যেসব নারী এগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে, তারা আধুনিক সমাজের অদৃশ্য হেরেমখানার বাসিন্দা হয়ে যায়। যারা জাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চায়, তাদেরও যাতনার শেষ নেই। আমৃত্যু পিছু হেঁটে চলে পুরানো জীবনের ভাঙাচোরা গল্প। তবে কি এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই? আছে, মুক্তি আছে। মুক্তি আসবে বিবাহ নামক এই জগদ্দল পাথরের হাত থেকে সমাজের মুক্তি হলে। বিয়ে খুব বেশিদিন আগে সৃষ্টি হয়নি। নারীকে আজীবনের দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধা রাখতেই বিয়ের উৎপত্তি। প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উৎপত্তির সময়ে এই প্রথা প্রবর্তিত হয়। যখন পুরুষ নারীকে সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা শুরু করে, যখন পুরুষ নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে ভাবতে থাকে তখন এই প্রথার উৎপত্তি।
যখন পুরুষ নারীর কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে, ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে উঠে। তখন নারীদেরকে বন্দি করা শুরু করে। কিন্তু বন্দি নারীর শরীর হয়তো ভোগ করা যায়, কিন্তু মন, তার নাগাল তো পাওয়া যায় না। তখন পুরুষের অনুর্বর মস্তিষ্ক থেকে একটা ভনিতার ভাবনা এলো। সেই ভনিতার নাম বিবাহ। ক্রমে নারীর মন থেকে স্বাভাবিক স্বাধীনতার বোধ লুপ্ত হলো। তারা পুরুষের সেবাদাসী হয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করতে লাগল। যে পুরুষ যত বেশি নারীকে নিজের আয়ত্বে আনতে পারল, সে হয়ে উঠল ততই ক্ষমতাধর। পুত্র-কন্যা-জামাতা-পৌত্র পরিবেষ্টিত হয়ে সে হয়ে উঠল বড়ো গোষ্ঠীপতি। তখন তার ক্ষমতা হয়ে উঠল অসীম। ক্রমে সেই গোষ্ঠীপতিদের মধ্যথেকে সর্বাধিক পেশিবহুল, সর্বাধিক বাহুবলের অধিকারী নিজেকে রাজা ঘোষণা করলো।
অন্য গোষ্ঠীপতিরা নিজেদের সুন্দরী কন্যাগুলোকে সেই রাজার রাজসেবায় নিয়জিত করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। যার নাম দেওয়া হলো সন্ধি। আর সেই মেয়েগুলো হয়ে উঠল রানি। যে রাজা যত ক্ষমতাশালী তার রানির সংখ্যা তত বেশি। রাজা, তথা রাজপুরুষেরা শুধু রানিতেই তৃপ্ত থাকতেন না। তাদের দরকার হতো দাসি। তাদের দরকার হতো হেরেমখানা। তাদের দরকার হতো শতপুত্রের। এই সব বিবাহ, এই সব সামাজিক নিয়ম, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি। পুরুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সৃষ্ট। পুরুষের সীমাহীন লালসা পরিতৃপ্ত করবার জন্য সৃষ্ট।
এই নোংরা ভোগবিলাসের বৈধ সামাজিক নাম বিবাহ। একটি মেয়েকে আজীবনের জন্য ভোগের বস্তু করে তোলার ছল। এই একবিংশ সমাজে সবার আগে প্রয়োজন বিবাহ নামক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের অবসান। যদি এটা হয়, তবে মুক্তি হবে মানবজাতির। নারী-পুরুষ উভয়ই মুক্ত হবে। স্বাধীন হবে। এখন মানুষের স্বাধীনতা বড় বেশি দরকার। বিবাহ নামক বন্ধনের আড়ালে নারী, পুরুষের ও পুরুষ, নারীর দাসে রূপান্তরিত হয়। দাস প্রথা রহিত হয়েছে গত শতাব্দীতে। এ শতাব্দীতে হোক বিবাহ নামক দাসত্বের অবসান।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক