অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘প্রয়াগরাজ যাবার পথে’

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩০, ২০২১

হাওড়া স্টেশনে নীলাদ্রি যখন পৌঁছাল, ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনের তো কোনো দোষ নেই। সে তার নিয়ম মেনেই ছেড়েছে। নীলাদ্রির স্ত্রী সুচেতা ভারি অদ্ভুত ধরনের মেয়ে। ভ্রমণের কথা উঠলেই ভেটো দেবে। কিছুতেই বেড়াতে যেতে চায় না। নীলাদ্রির আবার পায়ের তলায় সর্ষে। জীবনে এই একটাই শখ। দেশ ভ্রমণ। এখন অবশ্য শখটাই তার পেশার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে।

সুচেতা বলে, তোমার যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমাকে নিয়ে টানাটানির দরকার নেই। তুমি যে কদিন থাকবে না, আমি মার কাছে গিয়ে থাকব। আমার কোনো অসুবিধে নেই, বরঞ্চ ভালোই লাগবে। যেতে হবেই নীলাদ্রিকে। এটা তার রুজির ব্যাপার। দুটো পত্রিকা থেকে আগাম টাকা নেয়া হয়ে গেছে। কুম্ভমেলার ওপর লিখতে হবে। লেখার রসদ সংগ্রহের জন্যই যাওয়া। সুচেতা সব জানে। বোঝে। তবুও অবুঝের মতো আচরণ করে।

মুখে বলবে, তুমি যাও আমি মার কাছে গিয়ে থাকবো, কিন্তু আদৌ যাবে না। বাড়িতেই থাকবে। প্রতিবার বেরুবার সময় সুচেতা এমন সিন্ ক্রিয়েট করবে যে, নীলাদ্রির মুডটাই অফ হয়ে যায়। এখন অবশ্য নীলাদ্রির অনেকটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। খুব একটা আমল দেয় না সুচেতার কথায়। বিয়ের পরপর বারকয়েক সুচেতাকে জোর করেই বেড়াতে নিয়ে গেছিল নীলাদ্রি। সুচেতা একটুও মানিয়ে নিতে পারে না। তখন নীলাদ্রির মাইনে কম। ট্রেনের স্লিপার ক্লাসেই যাতায়াত। বাসে চড়েই সাইট সিন্ দেখা। সুচেতার জানলার ধার চাই। চাইলেই কি পাওয়া যায়?

না পেলেই গণ্ডগোল। মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। একটাও কথা বলবে না। পুরো বেড়ানোটাই মাঠে মারা যাবে। একবার একটা ফোর্টে ঘোরার সময় সুচেতা চোখে সানগ্লাস পরে ছিল। নীলাদ্রি বারণ করেছিল কিন্তু সুচেতা শোনেনি। অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কিভাবে হাইহিল চটিতে স্লিপ কেটে গড়িয়ে পড়লো নিচে। ব্যাস শুরু হয়ে গেল চিৎকার। সমস্ত দোষ নীলাদ্রির। কেন সে তাকে বেড়াতে নিয়ে এসেছে? সে আসতে চায় না তবু জোর করবে। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিভাবে হাঁটবে?

অপরাধীর মতো মুখ করে থাকে নীলাদ্রি। হয়তো তেমন কিছু লাগেনি। তা বললে কি হবে? অত সহজে ছাড় পাবে না। সমস্ত লোক জড়ো করে নীলাদ্রির বাপ-বাপান্ত করে তবে ছাড়বে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে নীলাদ্রির। ট্যাক্সিটা হাওড়া ব্রিজের মুখে উঠতেই ফটাস করে ফেটে গেল পেছনের একটা চাকা। কোনোমতে বাঁদিক করে ট্যাক্সিটা দাঁড় করলো ড্রাইভার। বলল, আপনাকে বাকি রাস্তাটা হেঁটে যেতে হবে। আমার গাড়িতে স্টেপনি নেই।

রাগে গজগজ করতে করতে নীলাদ্রি ছুটলো স্টেশনের দিকে। দেরি তো হবেই। যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। প্রাণপণে দৌড়ালো নীলাদ্রি। প্রায় এসে গেছে। বি ফোর তার কোচ নাম্বার। ওই তো সামনে। আর একটু। হঠাৎ একটা হাত বেরিয়ে এলো দরজা দিয়ে। শক্ত করে ধরল নীলাদ্রির বাড়িয়ে দেয়া হাত। একটানে তুলে নিল কোচের ভেতরে। হাঁপিয়ে গেছে নীলাদ্রি। তাকিয়ে দেখলো টিকিট চেকার। সাদা ট্রাউজার আর কালো কোট পরা। ভদ্রলোক বললেন, আর একটু হলে তো ট্রেনটা মিস করতেন। আগে আসতে পারেন না?

শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হবার পর নীলাদ্রি বলল, হাওড়া ব্রিজে ওঠার মুখে ট্যাক্সির টায়ার পাংচার। ওখান থেকেই ছুটে আসছি। রাস্তার জ্যামের কথা আর কি বলবো!

থাক, আর কিছু বলতে হবে না। এবার সিটে গিয়ে বসে একটু জিরিয়ে নিন।
অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি সাহায্য না করলে ট্রেনটা মিস করতাম।
এসিথ্রি টিয়ার। তার কুপে মোট আটজন যাত্রী। তার বার্থ সতেরো নম্বর। তার মানে লোয়ার। মিডিল ও আপার বার্থের দুজন সহযাত্রী তার সিটে গুছিয়ে বসেছে। রুকস্যাকটা সিটের তলায় চালান করে একধারে চুপ করে বসলো নীলাদ্রি। এতক্ষণে অনুভব করলো তার ফুলস্লিভ শার্টটা পুরো ভিজে গেছে। ঘামে সেঁটে আছে শরীরের সাথে। খোলার উপায় নেই। পুরো ঘামটা গায়ে বসবে।

সহযাত্রীদের দিকে একটু নজর বুলাতেই দেখে তার সিটে যে দুজন বসে আছেন তারা অবশ্যই সিনিয়র সিটিজেন। সৌম্যকান্তি চেহারা। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। একজনের পরনে ট্রাউজার আর হাফ স্লিভ শার্ট। অন্য জনের পরনে সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার। পরে জেনেছিল ইনারা দুই ভাই। মোট চোদ্দ জনের দল।

সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। নীলাদ্রির বিপরীত দিকে একটি ছোট পরিবার। বাবা-মা আর বছর দশেকের একটি বাচ্চা মেয়ে। সাইড লোয়ারে বসে আছে মা আর মেয়ে। মায়ের বয়স বছর কুড়ি। মুখের আদল দেখে মনে হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিশেষ কোনো সম্প্রদায় ভুক্ত। তারা যে ভাষায় কথা বলছিল তা ছিল নীলাদ্রির কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। তবে মাঝে মধ্যে হিন্দিতেও কথা বলছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমে উঠলো পাশের সহযাত্রীদের সাথে। জানা গেল সকলেরই গন্তব্যস্থল প্রয়াগরাজ। এবারের অর্দ্ধ কুম্ভে চলেছে সবাই। বিপরীত দিকে যে পরিবারটি বসেছিল তারা দমদমে থাকে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের দোরগোড়ায়। নাম প্রণব কাঁসারি। একটা চোখে সমস্যা। মনে হয় দেখতে পান না। পাশে বসা ভদ্রলোকের নাম চঞ্চল মুখোপাধ্যায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইনি বড়। প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক ছোট ভাই। নাম চন্দন মুখোপাধ্যায়। দুজনেই প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। বড় ভাই চঞ্চল বাবু জ্যোতিষ চর্চা করেন। বেহালার চৌমাথা থেকে খানিক ভেতরে উনাদের পৈতৃক বাড়ি। তবে ভদ্রলোকের চেম্বার চৌমাথায় পাম জুয়েলারির নিচে বিবেকানন্দ বুক হাউসের ঠিক পাশে। চাকরি জীবন থেকেই জ্যোতিষ চর্চা। একবার অফিসের মালিককে এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গুজরাটি মালিক চঞ্চল বাবুকে আলাদা চেম্বার দিয়ে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট করে ছিলেন। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার আগে চঞ্চল বাবুর মতামত নিতেন। মালিকের দৃঢ় বিশ্বাস চঞ্চলবাবুর কথা অনুযায়ী চলে কম্পানির বাড় বাড়ন্ত।

নীলাদ্রির ডান হাতের তর্জনীতে একটি পান্না বসানো রুপোর আংটি ছিল। চঞ্চল বাবুর নজর সেদিকে যাওয়াতে নীলাদ্রির সাথে আলাপটা উনি যেচেই করলেন। বললেন, তর্জনীতে পান্না পরেছেন কেন? একটু থতমত খেয়ে নীলাদ্রি বলল, তা তো জানি না। আমার স্ত্রী তার বাপের বাড়ির এক পরিচিত পামিস্টকে দিয়ে আমার হাত দেখিয়ে ছিলেন। ওই জ্যোতিষীর নির্দেশে যত না আমার পান্না ধারণ করা তার চেয়ে অধিক আমার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে তর্জনীতে পান্না পরেছি।

চঞ্চল বাবু বললেন, সে ঠিক আছে কিন্তু তর্জনীতে কেন?
ঢোক গিলল নীলাদ্রি। বলল, আমি তো এর বিন্দু বিসর্গ জানি না। সংসারে অশান্তি এড়াতে পান্না পরেছি। ওই জ্যোতিষী তো তাই বললেন ।
গলা উঁচিয়ে চঞ্চল বাবু বললেন, ভুল বলেছেন। একদম ভুল কথা। তর্জনীতে কেউ পান্না পরে না। তাছাড়া রুপো দিয়ে পান্না! এটাও কি উনি বলেছেন?
মিঁউ মিঁউ করে নীলাদ্রি বলল, যে আজ্ঞে। উনি বানিয়ে এনে দিয়েছেন। আমি শুধু টাকাটা দিয়েছি।
কত টাকা দিয়েছিলেন, মনে আছে?
বললা, বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। দশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন।

ঠকিয়ে দিয়েছেন। এই সমস্ত মিথ্যাবাদী ভণ্ড জ্যোতিষীদের জন্য এই পেশাটাকেই মানুষ অশ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। যাই হোক, আপনি সোনা দিয়ে আংটিটা বানাবেন। আর ডান হাতের অনামিকায় ধারণ করবেন। একটা অনুরোধ, ধারণ করার আগে একটিবার আমাকে ফোন করবেন। চলে আসবেন আমার চেম্বারে। আমি শোধন করে দেব। ভয় নেই, কোনো টাকা পয়সা লাগবে না। আপনার ভালো হবে।

সমস্ত কথাই হা করে গিলছিলেন প্রণব বাবু । চঞ্চল বাবু থামতেই প্রণব বাবু বললেন, আমার স্ত্রীর হাতটা যদি একবার দেখে দেন। প্রণব বাবুকে স্থির দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে চঞ্চল বাবু বললেন, এই নিন আমার কার্ড। আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আমার চেম্বারে আসবেন দেখে দেব।

হঠাৎ দেখি সাইড লোয়ারে বসা মা ও মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে।
কি ব্যাপার?
দুর্গাপুর থেকে দুজন যাত্রী উঠেছেন। দেখে মনে হয় পিতা পুত্র। পরে অবশ্য জেনেছি, পুত্রের কলেজ খুলে যাওয়াতে তার বাবা তাকে হস্টেলে নিয়ে যাচ্ছেন। ছেলেকে হস্টেলে রেখে ফেরার পথে নামবেন প্রয়াগরাজে। উদ্দেশ্য গঙ্গা স্নান। পুণ্য অর্জন।

ঘটনা হয়েছে, উনাদের সিট একটা আপার আর একটা মিডিল। লোয়ারে আছেন এক বয়স্ক মহিলা। তার অনেকগুলো ব্যাগ। ভদ্রলোক কোনোমতে দুটো ব্যাগ চাপাচাপি করে ওখানে রেখেছেন। দুটোই ছেলের ট্রলি ব্যাগ। মুশকিল হলো, উনার ব্যাগটা রাখার কোনো জায়গা পাচ্ছেন না। আমাদের কুপের সাইড লোয়ারের তলায় জায়গা আছে। ভদ্রলোক ওখানেই রাখতে গেলেন উনার ব্যাগটা। সাইড লোয়ারের মেয়েটি পা ছড়িয়ে বসেছিল। মেয়েটিকে পা সরাতে বললেও সে পা সরায়নি। দূর থেকে ছেলেটি একটু জোরের সাথেই মেয়েটিকে পা সরাতে বলে। কেন জোরে বলেছে সেই নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত। মেয়েটির মা চিৎকার করে লোক জড়ো করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির বাবা শান্ত প্রকৃতির মানুষ। নিজের ও ছেলের তরফ থেকে ভুল স্বীকার করে নিলেন।
বললেন, আমি হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে চুপ করুন।
কে শোনে কার কথা! মেয়েটির মা সে কথার কোনো কর্ণপাত না করে হাত পা ছুড়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে চিৎকার করেই চলেছেন। আচমকা সকলকে বিস্মিত করে মেয়েটি উঠে গিয়ে ছেলেটির গালে এক চড় কষিয়ে দিল। ছেলেটিও ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল মেয়েটির ওপরে। থামিয়ে দিলেন ছেলেটির বাবা। কোনোভাবেই ছেলেটিকে মেয়েটির গায়ে হাত তুলতে দেননি। আমরা সকলেই মেয়েটি ও তার মায়ের আচরণে ক্ষুব্ধ। কারোর গায়ে হাত তোলা গর্হিত অপরাধ। ছেলেটি এমন কিছুই বলেনি বা করেনি যে, তার গায়ে হাত তুলতে হবে। দু-চারজন যাত্রী প্রতিবাদ করে উঠলো। মেয়েটি বা তার মায়ের কোনো বিকার নেই। এতটুকু অনুশোচনা নেই। কাজটা যে মোটেই ভালো করেনি, সে কথা সে মানতে রাজি নয়। উপরন্তু সে জানালো যে, সে যা করেছে ঠিক করেছে।

ছেলেটি চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নয়। অসম্ভব অপমানিত বোধ করছে সে। সত্যি তো, সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তার বাবা ব্যাগ রাখতে গেছে। মেয়েটিকে বলা সত্ত্বেও সে পা সরায়নি। তখন সে একটু জোরের সাথেই মেয়েটিকে পা সরাতে বলে। এতে অন্যায়টা কোথায়? তবুও তার বাবা অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। এর পরও এরকম সিন ক্রিয়েট করা। ছেলেটি ফোন করলো জিআরপিকে। এরই মধ্যে ট্রেন আসানসোলে ঢুকে পড়েছে। ছেলেটি নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। ডেকে আনলো পুলিশ। দুজন পুরুষ ও একজন মহিলা পুলিশ উঠে এলো কম্পার্টমেন্টে। ছেলেটি বলল পুরো ঘটনাটা। সমর্থন করলো অন্যান্য সহযাত্রীরা। মহিলা বা তার মেয়ে বুঝতে পারেনি যে, ছেলেটি পুলিশ ডাকবে। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে উঠে গেল পুলিশের কাছে। ইনিয়ে বিনিয়ে জানালো ছেলেটি ও তার বাবা কিভাবে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে।
মহিলা পুলিশটি বলল, তাই বলে গায়ে হাত তুললেন কেন?
মেয়েটি বলল, ও আমার গায়ে হাত তুলেছে।
মেয়েটির মা শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলো। বলল, ছেলেটি আমার মেয়ের বুকে হাত দিয়েছে ।
অবস্থা ক্রমান্বয়ে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। পুলিশ ভদ্রলোক বললেন, তাহলে তো আপনাদের উচিত ছিল আমাকে খবর দেয়া। তা তো আপনারা দেননি। ছেলেটি নিজে গিয়ে আমাদের ডেকে এনেছে।

ঠিক সেই সময় পাশের এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, মেয়েটি ও তার মা মিথ্যে কথা বলছে। ছেলেটি কিছুই করেনি। এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। উল্টে মেয়েটি এখানে এসে ছেলেটির গায়ে হাত তোলে।

পুলিশের কাছে পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেল, আপনারা সবাই শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি এরকম আচরণ করেন তাহলে অন্যদের কি বলবো! একসাথে যাবেন একটু মিলেমিশে চলুন। ভালো লাগবে। তারপর মেয়েটিকে বললেন, আপনি অন্যায় করেছেন। গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনা ঘটেনি। আপনি বিশেষ সুবিধা নেবার চেষ্টা করেছেন। আপনি ছেলেটির কাছে ক্ষমা চান।

মেয়েটি কিছুতেই ক্ষমা চাইবে না। মহিলা পুলিশটি বলল, তাহলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। সেক্ষেত্রে হয়তো আপনাদের এই ট্রেনে আর যাওয়াই হবে না। এখন ভেবে দেখুন কি করবেন।

বেগতিক দেখে মেয়েটি ক্ষমা চেয়ে নিল। নামার আগে ছেলেটির পিঠে হাত দিয়ে পুলিশ অফিসার বলে গেলেন, জাস্ট ফরগেট ইট। এরপর ঘণ্টাখানেক ধরে পুরো কম্পার্টমেন্ট জুড়ে একটি বিষয় নিয়েই আলোচনা চলতে থাকলো। স্ত্রী স্বাধীনতা ও তার অপপ্রয়োগ। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। তবে ট্রেনের এই সহযাত্রীদ্বয়ের আচরণে সকলেই ক্ষুব্ধ। শুধুমাত্র মেয়ে বলে এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারল। আর সেই সুযোগ নিতে মিথ্যে কথা বলতেও পিছপা হয়নি। ভাগ্যক্রমে ট্রেনের অন্য মহিলা সহযাত্রী প্রতিবাদ করায় পুলিশের পক্ষে ঘটনার সত্যতা অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়নি। সমস্ত স্তরেই কিছু পুরুষ আর কিছু মহিলা থাকবেই যাদের আচরণে নারী অথবা পুরুষ জাতিকেই কটু কথা শুনতে হয়। ভালো মানুষদের দুঃখটা সেখানেই।

আস্তে আস্তে কম্পার্টমেন্ট শান্ত হয়ে গেল। আবার সকলে নিজ নিজ আলোচনায় মগ্ন। চঞ্চল বাবুর ভাই চন্দন বাবু বিপরীতে দিকে বসা প্রণব বাবুকে বললেন, কুম্ভমেলায় তো যাচ্ছেন তা থাকবেন কোথায়? ব্যবস্থা কিছু করেছেন?
প্রণব বাবু বললেন, সন্ন্যাসীদের সাথে তাঁবুতে থাকবো। কোনো অসুবিধে হবে না।
খাওয়া-দাওয়া?
ওদের সাথেই। ওরা যা খাবে আমরা তাই খাব। সরকার থেকে ওদের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। হোটেল-টোটেল অনেক দূরে। দুই কিলোমিটারের বেশি। সেখান থেকে অত সকালে এসে সময়মতো স্নান করা যাবে না। তাছাড়া...
তাছাড়া কি?
প্রণব বাবু গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, তাঁবুতে কোনো খরচ নেই। বিন্দাস থাকো আর খাও। স্নানেরও সুবিধা। এরপরে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমার একটু গঞ্জিকা সেবনের অভ্যাস আছে। তাঁবুতে থাকলে সেটাও জুটে যায়। বোম শঙ্কর বলে ছিলিমে দুটান দিলেই মনে হয়, স্বর্গে আছি। জীবনের সমস্ত সুখ ওই টানে। বড্ড হালকা লাগে নিজেকে। সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা একেবারে ভোঁ ভা।
আপনার স্ত্রীর বা মেয়ের কোনো আপত্তি নেই?
একদম না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে বেড়াতে পারলেই খুশি। কোথায় আছি আর কাদের সাথে আছি, সেটা তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। বেড়ে আছি মশাই। যেখানেই বেড়াতে যাই আগেই খুঁজে বেড়াই সস্তার কি আছে। রামকৃষ্ণ মিশন বা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ঘর পেলে তো কথাই নেই। কোথাও কোথাও গুরুদুয়ারা। থাকা খাওয়া ফ্রি। জানেন, পুরীতে এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ। ভদ্রলোক খুব গরিব। ভাঙাচোরা একটা বাড়িতে থাকেন স্ত্রী আর আইবুড়ো এক মেয়েকে নিয়ে। কিছু টাকা দিলেই দিন সাতেক আরামসে থাকা যায় উনার ভাঙা বাড়ির একটা ঘরে। মন্দিরে গিয়ে প্রসাদ খাই। ওদের জন্যও নিয়ে আসি। এই নিয়ে দশ বারো বার পুরী যাওয়া হয়ে গেছে। দিল্লির কালীমন্দিরে থাকতেও আমাদের কোনো অসুবিধে হয় না।

আপনি কি করেন?
আমার একটা লন্ড্রি আছে। একটু পয়সা কড়ি জমলেই বেরিয়ে পড়ি। সস্তা না হলে চলবে কেন?
চঞ্চল বাবু নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করেন?
বলার মতো কিছু নয়। একটু লেখাঝোকা করি।
তারমানে আপনি লেখক?
লিখি যখন তখন লেখক বলতে পারেন। তবে নিজেকে সাহিত্যের সেবক বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।
তা লেখক মশাই আপনি কেন এই বয়সে মেলায় যাচ্ছেন?
পেটের তাগিদে।
মানে ঠিক বুঝলাম না।
আসলে লেখার রসদ সংগ্ৰহ করতে। দেখুন কুম্ভমেলা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সকলেই মোটামুটি সব জানেন। আমার আগ্রহ মানুষ। যারা আসেন তাদের সম্পর্কে জানা। এটাতো অর্দ্ধ কুম্ভ। ২০২১ এ হরিদ্বারে হবে পূর্ণ কুম্ভ। সে তো আরও বিশাল ব্যাপার।

প্রণব বাবু বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
বললাম, বলুন।
কুম্ভ কথাটার মানে কি? কুম্ভ বলে কেন?
ইংরেজিতে বলে পট। পাত্র। অমৃতের পাত্র। সমুদ্র মন্থনের ফলে যে অমৃত পাওয়া গেছিল তা ওই কুম্ভের ভেতরেই রাখা হয়েছিল। যে চারটি স্থানে কয়েক ফোঁটা ছলকে পড়েছিল সেই স্থানগুলোই পবিত্র স্থান হিসাবে চিহ্নিত। প্রয়াগের সঙ্গম মানে গঙ্গা যমুনার সঙ্গম স্থল তার একটি। প্রতি বারো বছর অন্তর পূর্ণ কুম্ভ এবং ছয় বছর অন্তর অর্দ্ধ কুম্ভ হয়।

চঞ্চল বাবু প্রণব বাবুকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেন চলেছেন, শুধু কি মেলা দেখতে না অন্য কোনো কারণে?
আসলে আমার মেয়ের একটি শারীরিক সমস্যা আছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কাজ কিছু হয়নি। এক সাধু বাবার সাথে গত বছর আলাপ হয়। তিনি আমাকে এখানে আসার জন্য বলেন। দেখি, যদি কিছু সুরাহা হয়। তা আপনারা কেন যাচ্ছেন?
দুটো উদ্দেশ্য। এত বছর বাদে কুম্ভমেলায় আসার সুযোগ পেয়েছি। তাই হাতছাড়া করতে চাইনি। তবে আর একটা কারণ আছে। আমার কোনো সন্তান নেই। এই যে আমার ভাই চন্দন, ওর একটাই ছেলে। সুগন্ধ। বছর তিনেক হলো বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো সন্তান হয়নি। বৌমার মা ও বাবা আমাদের সঙ্গে আছেন। বৌমার মায়ের ইচ্ছা একবার মেয়ে জামাইকে নিয়ে সঙ্গমে পুণ্য স্নান করার। আমরা আপত্তি করিনি। যদি ভালো কিছু হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। তাছাড়া কুম্ভ স্নানের মানে ‘হোলি ডিপ ‘এর সাথে তো এস্ট্রোলজির যোগাযোগ আছে। স্টার ও প্ল্যানেটদের পজিশনাল চেঞ্জে অনেক কিছুই হতে পারে। সেইজন্য সবাই মিলে যাচ্ছি ।

রাতের খাবার নিয়ে আই আর সি টি সির ছেলেগুলো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। প্রণব বাবু বললেন, ওই যে রাতের খাবার এসে গেছে। চলুন খেয়ে নেয়া যাক।
চঞ্চল বাবু বললেন, একটু তাড়াতাড়ি শুতে হবে। কাল সকাল পৌনে সাতটায় ট্রেন পৌঁছাবে প্রয়াগরাজে।