প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর গদ্য ‘আদমের মন’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০২২

আদম শব্দটি আরবি নাকি হিব্রু, তা নিয়া মতভেদ আছে। হিব্রু আদম অর্থ পৃথিবী। এই ভাষায় আরেক অর্থ মানবজাতি। ফিনিশ ও সাবাই ভাষায় একই অর্থ পাওয়া যায়। কারণ আদম পৃথিবীর মাটি থেইকা সৃষ্ট। আরবি হইলে আদম অর্থ, ভুত্বকের ওপরের অংশ। কেননা সে ভূ-ত্বকের উপরিভাগের মাটি থেইকা সৃষ্ট। আবার অনেকের মতে, আদম অর্থ হইল সংমিশ্রণ। কেননা আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সংমিশ্রণে আদম সৃষ্ট।

প্রথম মানুষ ও প্রথম নবি হিসেবে আল্লাহ আদমকে (আলাইহিস সালাম) নিজ হাতে সৃষ্টি করেন। মাটির সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঁঠালো ও পোড়ামাটির মতো শুকনা মাটির তৈরি সুন্দরতম গঠনে, তার ভেতরে রূহ ফুঁক দিয়া আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেন। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথম দিন থেইকাই মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞানসম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসেবেই যাত্রা শুরু করছে এবং আজও সেভাবেই তা অব্যাহত আছে।

শুরু থেইকা আজ অবধি, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষ কখনোই মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। আল্লাহ আদমকে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেন। প্রথমে তাকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোট-বড় সকল সৃষ্টবস্তুর জ্ঞান ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেওয়া হইল। আদমকে দেওয়া সেই যোগ্যতা ও জ্ঞান ভাণ্ডার যুগে যুগে তার জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী সন্তানদের মাধ্যমে বিতরিত হইতেছে ও তার মাধ্যমে দুনিয়া উপকৃত হইতেছে।

গ্রেকো-রোমান খ্রিস্টান ইতিহাস ঐতিহ্যে আদম আলাইহিস সালামের ফল খাওয়া এবং তারপর তার প্যারাডাইস থেকে বার হওয়াকে ‘অরিজিনাল সিন’ বা আদি পাপ হিসাবে গন্য করা হয়। তারা আরও মনে করে, আদমের বংশধরেরাও পাপী, কারণ ফল খাওয়ার ফলে মানুষ জন্মের সিমেন বা শুক্রাণুও কলুষিত হইয়া গেছে। পরবর্তীতে সেইন্ট পল কল্পনায় জিসাস যিশু খ্রিস্টকে (ঈসা আলাইহিস সালাম) পাপমুক্তির মাধ্যম বানাইছে।

তাদের মতে, যিশু খ্রিস্টের রক্ত ঝরানোর মাধ্যমেই মানবের মুক্তি সম্ভব। তাই তো আমরা বিদেশে খ্রিস্টান ছোট ছোট মন্দিরের সামনে বড় করে লেখা দেখতে পাই, ‘যিশু হইল দরজা তাতে প্রবেশ করো, রক্ত দানের মাধ্যমে যিশু তোমাদেরও পাপ মোচন করে গেছেন‘ ইত্যাদি। এইটা সবাই জানেন যে, খ্রিস্টানরা যিশুকে আল্লাহর পুত্র তথা ট্রিনিটি সূত্র মোতাবেক সান, গড ও হোলি ঘোস্ট হিসাবে মান্য করে। তাদের আদি পাপ মুক্তির ধারণাটা হয়তো এখান থেইকা আসতে পারে।

যাই হোক, যেইটা বলতে চাইছিলাম তা হইল, মুসলমানরা আদমের (আ.) ফল খাওয়াটা আদি পাপ হিসাবে দেখে না। এইটা আদমের ভুল, এইটা ইবলিস দ্বারা আদমের প্রতারিত হওয়ার মাধ্যমে ঘটছে। এইটা আদমের (আ.) দুর্বল মনোবাসনার কারণে ঘটছে। ইবলিস তার দম্ভের কারণে আল্লাহর হুকুম পালন করে নাই। আদমের পাপ হইল মনোবাসনার পাপ, ইবলিসের পাপ হইল অহমিকার পাপ। আদম (আ.) স্বেচ্ছায় ফল খায় নাই, অন্যদিকে আল্লাহর অবাধ্যতা করা ইবলিসের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, তাকে কেউ প্রলুদ্ধ করে নাই, প্রতারিত করে নাই।

আমি আগুনের তৈরি, আদম মাটির তৈরি, তাই আই এম বেটার দেন হিম... ইবলিসের এই কুতর্কে তার স্পষ্ট ধৃষ্টতা ও অহংকার ফুইটা উঠছে। সে তার অবাধ্যতা ও দাম্ভিকতা স্বীকার করে নাই। অপরদিকে আদম (আ.) তার অবাধ্যতা ও ভুলকে স্বীকার করছেন। আল্লার কাছে মাফ চাইছেন।

প্যারাডাইস থেইকা পতিত হওয়ার পরে আদম (আ.)  খুব মনোবেদনায় ভুগতে থাকেন। তিনি এবং মা হাওয়া অনেক কান্নাকাটি করেন। তাদের ভেতরে ক্ষমা চাওয়ার অদম্য বাসনা জাগতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানি হইয়া তাদেরকে একটা দোয়াও শিখাইয়া দেন। ‘রব্বানা জালামনা আনফুসানা, ওয়া ইললাম তাগফির লানা ওয়াতারহামনা, লানাকু-নান্না মিনাল খসিরিন।’ অর্থ, হে আমাদের প্রভু, আমরা নিজেদের ওপর অন্যায় করেছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদেরকে রহম না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো (সুরা আরাফ ২৩)।

আল্লাহ আদমের (আ.) দোয়া কবুল করেন। ইসলামি ইতিহাস ঐতিহ্যে আদমের (আ.) এই দোয়াকে আল্লাহর কাছে মানুষের ফিরে আসার মোক্ষম সুযোগ মনে করা হয়। ইবলিস যেখানে তার প্রাইডের কারণে আল্লাহর কাছে কোনো ক্ষমা চায় নাই, আদম (আ.) আল্লাহর ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে তার হিউমিলিটি নিরহঙ্করতাকে প্রকাশ করছেন। কারণ মানুষ পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেইকা  দূরে সরে যায়, আবার তাওবা করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে।

আদমের (আ.) বিজয় তার উচ্চ পদের জন্য নয়, নয় তার মাহাত্ম্যের জন্য, বরং তার নিরহঙ্কারি মনের জন্য, আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়ার মধ্যেই আদমের (আ.) আসল বিজয়।

লেখক: কবি