আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ২৬

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯

ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল! কী সুন্দর জাদুখেলা! শৈশবে যখন প্রথমদিন দেখেছিলাম, বড় হতবাক হয়েছি! হতবাক নাকি বিস্ময়ে অভিভূত, আজ ঠিক বলতে পারব না। তবে মনে আছে, সেদিন কাজলসন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডের সে-বাসায় আকাশবালিকা দেখতে গিয়ে যতটুকু না বিস্মিত হয়েছিলাম, তারচেয়ে বেশি হয়েছি নাকাল। কেননা, দরজা খুলতেই কোথায় দেখবো বিমানবালার ড্রেস-পরা কাঙ্ক্ষিত সেই সুন্দরী নারীর লাস্যভরা হাস্যমুখ, তা না, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আমারই এক পরম পরিচিত বন্ধু!

সাক্ষাৎ যমদূত বলছি এ-কারণে, আমার এ-বন্ধুটির সঙ্গে টিএসসিতে আড্ডা মারতে গেলেই দেখা হয়, সে-সূত্রেই বন্ধুত্বতা— দেখাশোনা হতে হতে আর কি! সে টিএসসির অতি পরিচিত মুখ। প্রায় প্রতিদিনই আসে সেখানে। কাঁচি-সদৃশ বাইরের সিরামিক ইটের লাল দেয়ালের কোথাও বসে চা খায়, গল্পের বৈতরণী তৈরি করে আর ভেতরের কোথাও দল বেঁধে আবৃত্তির রিহার্সেল দেয়। একটি কালচারাল সংগঠনের ব্যস্ততম সদস্য। আবৃত্তি দল নিয়ে ঘুরতে যায় দেশের এখানে-সেখানে, এমনকি ইন্ডিয়ায়ও! সেই তার সঙ্গে আমার দু-তিনদিন আগেও দেখা হয়েছিল। দেদার কথা হয়েছে কিন্তু ভুলেও একবার ওর বাসায় যে কোনোদিন যাব বা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে প্রসঙ্গ পর্যন্ত আসেনি বা আসার পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি, সে-ই আমি কিনা ওর বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছি গোপন এক অভিসন্ধি নিয়ে! সে আমার কাছে যমদূত মনে হবে না তো বিয়াই-বিয়াই অনুভূতির জন্ম দেবে নাকি?

বন্ধু তো আমাকে দেখে অবাক। ভীষণ রকমের অভাব! সে নির্বাহী সম্পাদক-সমেত আমাদের তিনজনকে খাতির করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালো। সেই সঙ্গে আমাকে নিয়েও শশব্যস্ত হয়ে উঠলো! বন্ধু তুমি কীভাবে জুটলা, বলো তো! তারপর অনিবার্যভাবেই যেন পৃথিবীটা যে গোল সে-প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো। আর আমি আবিষ্কার করলাম, পৃথিবী তো গোল বটেই, তবে গোলমালেও ভরা! তা না হলে কি আকাশবালিকার পরিবর্তে বন্ধু এসে সামনে দাঁড়ায়? আমি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে থাকি ঠিকই আর ভেতরে ভেতরে অধীর হয়ে উঠি, আকাশবালিকাকে কখন দেখবো, কখন সে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে! জীবনে এই প্রথম কোনো আকাশবালিকার সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ মিলবে।

কিন্তু না, সেদিন আর আকাশবালিকার দেখা আমি পাইনি। একটু পরই ডক্টর জিভাগোর ভিডিও ক্যাসেটটি হাতে নিয়ে যিনি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, সালোয়ার কামিজের আড়ালে তিনি চিরন্তন বাংলার এক পর্দানশীন গৃহবধু। মাথায় ওড়না। বাঙালি মেয়ের সারল্য ভরা স্মিত হাসিমুখ। তিনি আমার বন্ধুটির লক্ষ্মীমন্ত বধু, মুখজুড়ে লজ্জার রক্তিম ছটা। কোথায় সেই মাথার স্কার্ফ, বিশেষ স্টাইলে পরা শাড়ি, মুখে হালকা প্রসাধনীর আমেজ— কোথায় সেই সজ্জা! আকাশবালিকা দেখতে না-পারার অতৃপ্তি বোধ নিয়েই সেদিন ফিরে এসেছিলাম এসএম হলে। তবে একেবারে যে ব্যর্থ হয়ে যায়নি সেদিনের সেই সন্ধ্যার অভিযাত্রা, সে-কথাও হলপ করে বলতে পারি। নির্বাহী সম্পাদক আমাকেও ভিডিও ক্যাসেটটি দিয়েছিলেন ডক্টর জিভাগো দেখার জন্য। সেই প্রথম বরিস পাস্তারনাকের সান্নিধ্য পেলাম অর্থাৎ সিনেমার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যকর্মের রস আস্বাদনের সুযোগ হলো এবং তাকে নিবিড়ভাবে অনুভব করলাম।

ডক্টর জিভাগো উপন্যাসটি গড়ে ওঠেছে রাশান বিপ্লব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বতীকালীন সময়ের ঘটনা প্রবাহকে অবলম্বন করে। অক্টোবর বিপ্লবকে হেয় করার অভিযোগ ওঠায় উপন্যাসটি রাশিয়ায় প্রকাশিত হতে পারেনি। প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ইতালিতে। সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর আরো পাঁচটি ভাষায় অনূদিত হয়। পরে নোবেল পুরস্কারও লাভ করে। যদিও রাশিয়ান কম্যুনিস্ট সরকার বরিস পাস্তেরনাককে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেয়নি!

ডক্টর জিভাগো চরিত্রের ভেতর দিয়ে আসলে বরিস পাস্তেরনাকের কবিসত্তার স্বরূপই উন্মোচিত হয়েছে। লারার সঙ্গে ডক্টর জিভাগোর প্রেমও মূল কাহিনির আখ্যানের মতো বেশ গুরুত্ব দিয়েই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়। এত বছর হয়ে গেল, পঁচিশ কী ত্রিশ বছর, এখনো টিভিস্ক্রিনে দেখা সে-সিনেমার অনেক দৃশ্যের কথাই মনে আছে, স্মৃতিপটে জীবন্ত। বিশেষ করে, রাশিয়া থেকে ডক্টর জিভাগোর সাইবেরিয়া যাওয়ার বরফসাদা পথের লংশটে ট্রেনটাকে ধরে ট্রেনের জানালা আর আকাশের পূর্ণিমার চাঁদকে ডেভিড লিন কী অত্যাশ্চর্যভাবেই না এক ফ্রেমে বন্দি করেছেন! অবিস্মরণীয় তো বটেই, বিস্ময়করও। আজো ভাবলে অনন্ত পুলক অনুভব করি। একটা মহৎ কবিতা পাঠ করলে যা হয় তেমনই। আচ্ছা, কবিতা লিখলেই কি কবি হওয়া যায়? ডেভিড লিন বা সে-দৃশ্যটি যিনি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন, তিনিও কি কবি নন? তিনিও কবি এবং আমিও কবি! হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও কবি? নিশ্চয়ই, তা না হলে কবিতা পাঠের জন্য, শুধুমাত্র কবিতার জন্য ইম্ফল যাচ্ছি কেন? এত সহজ আর সরলভাবে সংজ্ঞায়িত করে ফেললাম কবিকে? চলুন না, বরিস পাস্তেরনাকেরই দেশের আরেক কবি আলেকজান্ডার পুশকিন কবিকে দেখেছেন কীভাবে, একসঙ্গে নিবিড় পাঠ নেয়া যাক! কবিতাটি লেখা ১৮২৭ সালে।

কবি

আলেকজান্ডার পুশকিন

যতক্ষণ কবিকর্ণে সঙ্গীতদেবতা
না-পাঠায় আত্মনিবেদনের আহ্বান,
কবি ততক্ষণ ক্ষুদ্র দৈনিকে সর্বদা
ডুবে থাকে, অতলে তলিয়ে থাকে প্রাণ।
ততক্ষণ নিরুচ্চার স্বপ্নপূত বীণা;
চিত্ত তার অবসন্ন আলস্যরভসে,
অযোগ্য সংসার তাকে ঘিরে রাখে কিনা,
তারো মধ্যে সম্ভবত অযোগ্যতম সে।
কিন্তু যবে একবার কর্ণে তার পশি’
বিচলিত করে তারে দেবতার বাণী—
তখন কবির চিত্ত ওঠে-যে উচ্ছ্বসি
নভশ্চরর ঈগল সে— জেগে ওঠে প্রাণী।
তখন সে সংসারের তুচ্ছ ছেলেখেলা
ফেলে রাখে, দূরে রাখে জন-কোলাহল;
মানে না সে মানুষের দেবতার মেলা,
সমুন্নত শির সে-যে উদ্ধত প্রবল।
কবি তবে পলাতক— উন্মাদ স্পর্ধিত,
প্রাণৈশ্বর্যে মত্ত, সুরের উদ্বেল সে নীত-
যেখানে নির্জনে সিন্ধুজলে সুমার্জিত
তটভূমি, অরণ্যানী রণিত ধ্বনিত।
                 অনুবাদক: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়

তো, কবিতা পাঠের জন্য মণিপুরের ইম্ফল যাচ্ছি তো খুব বললাম। তার আগে তো ইন্ডিগোর এ উড়োজাহাজটিকে ঠিকঠাকমতো সেখানে পৌঁছাতে হবে। অবশ্য এ পথে কখনো কোনো বিমান দুর্ঘটনার কথা আদৌ শোনা যায়নি। তবু সাবধানের তো মার নেই। আমি যথারীতি সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বিমান গর্জন করে উঠল। একটু পর ধীরে ধীরে রানিংও শুরু করল। সত্যি বলতে কি, আমার একটু নার্ভাসই লাগছিল। কোনো ঠ্যাঙ নাই, ঠ্যাকনা নাই, কীভাবে এত লোহালক্কড়ের ওজনদার জিনিসটা শূন্য আকাশে ভেসে বেড়ায়, সেটা মনে পড়ছিল। সামান্য একটা পাখির সঙ্গে ধাক্কা লাগলেও নাকি হুড়মুড় করে বিমান ভেঙে পড়ে, সে-কথাটাও বড় বেশি মনে পড়ছিল। আমি আমার মনের ভেতরের ভয় তাড়াবার জন্য চঞ্চলমতি টাইপের আকাশবালিকার চোখজোড়াকে টার্গেট করলাম। যে-আমাকে উড়োজাহাজে ওঠার সময় চমৎকার একটি হাসি উপহার দিয়েছিল। আমি নিজেকে এই বলে বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে, যদি বিমানের সত্যি কিছু হয়, তাহলে তো শুধু আমি একা মরবো না, এই সুন্দরী আকাশবালিকারও  তো একই সঙ্গে জীবনাবসান ঘটবে। এমন সুন্দরীদের সঙ্গে একত্রে মৃত্যুর মধ্যেও তো আলাদা একটা কাব্যিক করুণ রসের ব্যঞ্জনা রয়েছে, নয় কি? চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক