
আমাদের ঈদগুলো নিষ্প্রভ হয়ে উঠলো কেন
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : মে ১৩, ২০২১
আমাদের ঈদগুলো খুব নিরানন্দ। অথচ মুসলমানদের সবচেয়ে আনন্দের দিন হওয়া দরকার ছিল ঈদের দিন। পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানে ঈদের দিনের চেয়ে বহুগুণ আনন্দ হয়। পহেলা বৈশাখ জাতীয়ভাবে উদযাপিত হওয়ায় বিপুল উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ দেখা দেয় সর্বত্র। অথচ ঈদের দিন থাকে প্রায়শই নিষ্প্রাণ। কারো জন্মদিনে যে আনন্দ ও হাসি থাকে পরিবারজুড়ে, ঈদেও কি তা-ই থাকে? জন্মদিন বা বিয়েবার্ষিকী পালন জায়েজ নাকি না-জায়েজ, এই প্রশ্ন আপাতত বাদ দিয়ে বাস্তবের দিকে যদি তাকাই, দেখবো, মানুষের আনন্দ যেন ঈদের চেয়েও বেশি এইসব দিনে। আমাদের অনেক জাতীয় দিবসেও ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ হয় বলে ধারণা করি। অথচ মুসলিমদের আনন্দিত থাকবার দিন প্রধানত দুটো— ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।
রাসুল (সা.) বলেন, “প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ-উৎসব হলো দুই ঈদ।” (বুখারি, হাদিস ৯৫২)। অথচ কি বিপুল কোষ্ঠকাঠিন্য সর্বত্র। কী কারণে আমাদের ঈদগুলো এমন নিষ্প্রভ হয়ে উঠলো তার কারণ খুঁজে বের করা হয়তো কঠিন হবে না।
আমাদের সেকুলার ও উপনিবেশী মন এই নিষ্প্রভ ঈদের পেছনে দায়ী অনেকটাই। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সামাজিক উদ্যমের অভাবের কারণও নিহিত আছে এতে। যদিও ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য লক্ষণীয়, কেনা-বেচায় আগ্রহেরও খামতি নেই কোথাও। তারপরও ঈদের দিনগুলো এমন নিরস-নিস্পৃহ কেন যায়? ঈদের দিন আসবার আগেই যেন ঈদ ফুরিয়ে যায়! দিনটিকে সাজাবার যে রুহানি চেতনা ও কর্তব্যবোধ তা কেন উবে গেল, মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, ভাবা দরকার। ইসলাম যখন বিজয়ী ছিল, সেই যুগে ঈদ নিশ্চয় এমন নিরানন্দ ছিল না। এমনকি সুলতানি আমলে বা মোঘল আমলেও তো ঈদের চাকচিক্য ও জাঁকজমকের হদিস পাই।
বৈধভাবে আনন্দ করবার অজস্র উপাচার আছে। পরিকল্পনা করা উচিত কীভাবে ঈদকে পরিবার ও সমাজের প্রধান আন্দোৎসবে পরিণত করা যায়। হয়তো এই করোনাকালে সম্ভব নয় আনন্দ-পরিকল্পনার সবটুকু বাস্তবায়ন করা। কিন্তু এই দুর্বিপাক তো চিরজীবী নয়। চিন্তাটুকু অন্তত জারি থাকুক।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্যোগে ঈদ হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে আনন্দময় অনুষ্ঠান। ঈদকে অন্যান্য সকল অনুষ্ঠানের চেয়ে আনন্দময় করে তোলা আমাদের ঈমানি দাবি। সমাজের প্রতিপ্রান্তে ঈদের রুহানি আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া মুসলিম সমাজের অবশ্য কর্তব্য। ঈদের সালাত, ছাদাকায়ে ফিতর, স্বজনদের পোশাক-আশাক দেয়া ছাড়াও আরো কি কি ভাবে ঈদকে আনন্দময় করা যায়, এটি ভাবা দরকার। ঈদে আনন্দ করবার ও আনন্দকে ছড়িয়ে দেবার সুন্নাহকে কার্যকরী করবার জন্যে নানা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে:
১. বেলুন দিয়ে বা অন্যভাবে সবাই মিলে বাসা সাজানো যেতে পারে।
২. ঈদের সালামি উঠে গেছে প্রায়। এটিকে ঘরে-বাইরে ফিরিয়ে আনা দরকার। পথে পথে ঈদি দেয়া যায় বাচ্চাদের। হাদিয়া দেয়ার আচারও চালু করা যায়।
৩. উপযুক্ত জনদেরকে বই উপহার দেয়ার চর্চা শুরু করা যায়।
৪. মিষ্টিমণ্ডা বিতরণের আয়োজন করা যায়। দেয়া যায় প্রতিবেশীকে। ইউনিয়ন-কাউন্সিল-পৌরসভায় আয়োজন করা যেতে পারে গণভোজের।
৫. ঈদের দিন জামাতের সালাত ছাড়া অন্যসময় নিষ্ক্রিয় থাকে মসজিদগুলো। মসজিদের উঠোনে বাচ্চাদের খেলাধুলার আয়োজন করা যেতে পারে। সমাজ ও সম্প্রদায়ের সহায়তায় মসজিদ চত্তরে হতে পারে বিশেষ ঈদ-আয়োজন।
৬. শরিয়তের বিধিমেনে মসজিদের ভেতরটাকে কীভাবে সাজানো যায়, আমাদের আলিমরা ভেবে দেখবেন।
৭. সারাদিন উচ্চস্বরে তাকবির ধ্বনি চলতে থাকবে। চলতে থাকবে সারাদিন দোয়া, দরুদ ও অন্যান্য জিকির।
৮. পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় নানা খেলাধুলার আয়োজন করা যেতে পারে।
৯. ফ্ল্যাটবাড়িগুলো তাদের নিজেদের উদ্যোগে ছাদে বা চত্তরে কাব্য-আসর বসানো যায়, সাথে থাকবে খাওয়া-দাওয়া।
১০. ঈদের আনন্দকে কীভাবে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পরিকল্পনা নেয়া যায়।
১১. ঈদগাহকে সাজানো যায় নতুনভাবে, যাতে ছোট-বড় সবাই এখানে আসতে পারে, খুতবা শুনতে পারে।
১২. বিনামূল্যে সরকারিভাবে লঞ্চে বা বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা। এজন্যে অবশ্য গণপরিবহন ব্যবস্থায় সরকারি তত্ত্বাবধান বা রাষ্ট্রীয়করণের প্রয়োজন পড়বে।
১৩. আমাদের নারীরা ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। পরিবারের পুরুষরা যাতে ইবাদত করতে পারে সেই ইন্তেজাম করতেই তাদের দিন যায়। রান্নাঘরে যায় অধিকাংশ সময়, বাচ্চার পালনে যায় দিনের পুরোভাগ। এক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষদের এগিয়ে আসা দরকার হবে। নারী-পুরুষ সম্পর্কের দ্বীনি রূপান্তর ছাড়া পরিবার পরিসরে কোনো আনন্দ উদযাপন সম্ভব নয়।
১৪. দরিদ্র কৃষক আর শ্রমজীবী মানুষেরা যাতে ঈদের দিনগুলোকেই বছরের সেরা দিন হিসেবে উপভোগ ও উদযাপন করতে সেই জন্যে কমিউনিটি পর্যায়ে বা জনপ্রতিনিধিদের বা প্রশাসনিক উদ্যোগে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
মূলকথা হলো, ঈদকে ফিরিয়ে আনতে হবে বছরের শ্রেষ্ঠতম আনন্দের দিন ও উৎসব হিসেবে। যদিও বোঝাই যায়, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ‘গুণগত রূপান্তর’ ছাড়া ঈদকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। ঈদকে প্রধানতম ও বৃহত্তম আনন্দের দিন হিসেবে জারি করা ও জারি রাখা ইসলামের সভ্যতাগত প্রকল্পের সাথে জড়িত। তবুও সাধ্যে যতটুকু কুলোয় তার সবটুকু দিয়ে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে কীভাবে ঈদকে সকল মুসলমানের জন্যে সবচেয়ে উপভোগ্য ও সর্বাধিক আনন্দময় দিবস করা যায়।
পরাধীন ভূমির মজলুম মুসলিমদের জীবনে ঈদ পালিত হয় চাপা কান্নায়, মৃত্যুর হাতছানির মধ্য দিয়ে। দোয়া ও দাওয়ায় স্মরণ যেন রাখি তাদের। যাদের সাহাস্যে সপরিবারে ঈদ করার কথা ছিল কিন্তু পারছে না, তাদের নিরানন্দকে কী করে ভুলি! ঈদ একইসাথে ইবাদত ও আনন্দ উৎসব। আনন্দ ও সম্মিলনও ইসলামের পরিসরে হয়ে উঠতে পারে ইবাদত। আল্লাহ তাওফিক দিন যাতে উম্মার মাঝে ঈদকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক