আমার বন্ধু শবনম

উপন্যাস ২

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ১৭, ২০২০

আপনে কুনোদিন আমার মতন কুনো মাইয়ার লগে শুইছেন?
কীভাবে যেন আমি জানতাম, শবনমের মুখ থেকে একদিন এমন প্রশ্ন বেরিয়ে আসবে। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লাম, না।
শবনমের কণ্ঠে চাপা ক্ষিপ্ততা, ক্যান? ঘিন্না লাগে? আমাগো উপর আপনাগোর খুব ঘিন্না না?
বলি, অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু আমি ঘেন্না করি না। করলে তো তোমার সাথে বন্ধুত্ব হতো না আমার।

শবনম আমার চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাস্তার আলো যতটুকু এসে পড়েছে আমাদের ওপর তাতে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না কিছুই। তবু সেই ম্লান আলোর ঘাটতি যেন পুষিয়ে নিচ্ছে শবনমের দৃষ্টি প্রখর থেকে খরতর হয়ে। আমি তার চোখ থেকে চোখ সরাই না। নিক। মেয়েটা আরেকবার চোখের ভাষা যাচাই করে নিক।

অনেকক্ষণ পরে শবনম চোখ সরিয়ে মাথা ঝাঁকায়। বলে, আপনেরে আমার বিশ্বাস হয়।
হায়, বালিকা তো জানে না যে, সে বিশ্বাস করতে চায় বলেই তার বিশ্বাস হয়। আমি হেসে বলি, কোনটা বিশ্বাস হলো? মানে কোন কথাটা?
দুনোডাই।
তোমাদের মতো কারো সাথে বিছানায় যাইনি, এমনটা বিশ্বাস হলো কেমন করে?
শবনম একটু লাজুক হাসে, আমি খিয়াল করছি, আপনে সামনাসামনি বইসা রইলেও কুনোদিন আমার জামার ফাঁকের দিকে তাকান নাই।
তাই? আমার তো মনেই হয়নি ব্যাপারটা।
হাভাইত্যা ব্যাডাগো চোখ শকুনের মতোন আটকায়া থাকে মাইয়া মাইনসের এই দুইডার দিকে।
আমি হাসি, কে জানে, তুমি হয়তো খেয়াল করোনি। আমি হয়তো চোরাচোখে তাকিয়েছি ঠিকই।
এবার শব্দ করে হাসে শবনম, আপনে তাকাইলে আমি চোখ বুঁইজ্জা থাকলেও বুঝবার পারতাম। সব মাইয়াই টের পায়।
এই কথার পিঠে কোনো কথা আসে না আমার।

শবনম বলে, যাইতেও তো পারতেন দুই-একবার। শখ-আল্লাদ কইরাও তো মানুষ আসে আমাগো কাছে। আর উপ্রে আপনে আবার ল্যাখক মানুষ।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার, আমার জীবনে শখ-আল্লাদ বলে কোনো জিনিস নাই শবনম। কোনোদিন ছিল না।
আমার দীর্ঘশ্বাস বা কথা কোনোটাই বোধহয় ঠিকমতো বুঝতে পারেনি শবনম। কী যেন ভাবছিল। বলল, আপনের বউডার ভাগ্য খুব ভালো। আপনের মতোন সোয়ামি পাইছে।

আমি বলি, ঠিক উল্টা শবনম। আমার বউটার জীবনের সব দুঃখের কারণ হচ্ছি আমি। পৃথিবীতে যদি একজন মানুষের ক্ষতি করে থাকি, সে আমার বউয়ের।
শবনম চোখ বড় বড় করে, আপনে কি বউরে পিডান? ভাত-কাপড় ঠিকমতো দ্যান না?
বউকে পেটায় তো সবচেয়ে কাপুরুষরা। ঐটা আমার দ্বারা সম্ভব না। আর ভাত-কাপড় সাধ্যমতোই দিয়েছি। কিন্তু এসবের বাইরেও অনেক জিনিস আছে যার জন্য মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। ক্ষতি করা যায়।
আপনের কি পিরিতের বিয়া?
মাথা ঝাঁকাই। হ্যাঁ।

বয়সের তুলনায় আমাকে অনেক জিনিস বেশি বুঝতে হয়েছে। বুঝতে হয়েছে, আমাদের একটু ভদ্রস্থভাবে বড় করার জন্য আব্বাকে কী কঠোর পরিশ্রমই না করতে হতো। কত হিসাব করেই না সংসার চালাতে হতো মাকে। দেখা গেল কয়েকমাস ভালোভাবে চলছে, তারপরেই আব্বা কঠিন কোনো অসুখে পড়ে। একেবারে নিয়মিত ঘটনা ছিল এটা। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, অতিরিক্ত পরিশ্রম আর অনিয়মের কারণে তার ওপর এইসব অসুখের আক্রমণ। আব্বার অসুখ। ব্যবসার কাজ বন্ধ। পুঁজি ভেঙে চিকিৎসা, সংসার চালানো।

সেই বয়সেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, আব্বার কাছে অতিরিক্ত কোনোকিছু দাবি করা চলবে না। আমার সাথে পড়ুয়া বন্ধুদের মতো ফ্যাশন করা, পিকনিকে যাওয়া, চেহারার যত্ন নেওয়া, হোটেলে খেতে যাওয়া, দলবেঁধে সিনেমায় যাওয়া, বেহিসবি হাতখরচ— এসব আমার করা যাবে না। নিজেকে তাই গুটিয়েই রাখতাম। জেনে গেছিলাম যে, আমি খুব সাধারণ। এবং খুব সাধারণভাবেই জীবন কাটাতে হবে আমার। আমার ছিল স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি আর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নেওয়া বই পড়া। খেলার মাঠে যেতাম। কিন্তু ফুটবল খেলতে গেলে বুট কিনতে হয়, ক্রিকেট খেলতে গেলে পোশাক লাগে, কেটস লাগে, তাই সেসব খেলাতে বেশি অংশ নিতে পারতাম না। মোটামুটি ভালো খেলতাম বলে অন্যরা ডাকাডাকি করত। কিন্তু আব্বাকে তো ছোট করা যাবে না। বলা তো যাবে না যে বুট-কেটস কেনার জন্য বায়না ধরলে আব্বার বাড়তি কষ্ট হবে। তাই বলতাম, আমার কাজ আছে।

ক্লাসে আমি ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার। স্যারেরা বা বেশি ছেলে-মেয়ে আমাকে চিনুক তা চাইতাম না। সেই আমারও প্রেম হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার শহরের সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের, সবচেয়ে এটিকেট-জানা, সবচেয়ে ভদ্র-মার্জিত রুচিশীল মেয়েটি প্রেমে পড়ল আমার। সেই পরিবারের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিল্পপতি, কেউ ব্যারিস্টার, কেউ বিদেশে রাষ্ট্রদূত, কেউ মেজর জেনারেল, কেউ এমপি, কেউ মন্ত্রী।

শবনম বলল, এক্কেবারে ছিনামার লাহান।
মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম।
তখনই পিছিয়ে আসা উচিত ছিল আমার। কিন্তু উপায় নেই। প্রেম তখন আমার কাছে পূজা। আমি পারছি না সরতে। কিন্তু সে-ও সরল না। তার পরিবার তো আমার সাথে বিয়ে দেবে না। তাই বিয়ে করলাম নিজেরাই।

তার পরের বিশ বছর তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অপমান, তাচ্ছিল্যের বন্যা। তার পরিবারের লোকেরা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে সে নিজের জীবনকে নষ্ট করেছে আমাকে বিয়ে করার মাধ্যমে। পুরো কুড়িটি বছর।

বিশ বচ্ছর ক্যান? শবনম জিগ্যেস করে।
বলি, বিশ বছর আমি সাধনায় নিমগ্ন ছিলাম। স্বীকৃতি এসেছে কুড়ি বছর পরে। সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার নিজের জন্য স্বীকৃতির কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু সমাজ তো দেখতে চায় আমিও একটা কেউ।
শবনম জিগ্যেস করে, এখন কী করেন?
আমি আমার সাধনা চালিয়ে যাই। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত চালিয়ে যাব।
শ্যাষ হয় নাই?
এর কোনো শেষ নেই শবনম।
সমাজের কাছে যা পাওয়ার সেইডা তো পাইয়াই গ্যাছেন। এখন সমাজ নিয়া কী ভাবেন?

আমি সিগারেট বের করি। শবনমকে একটা দিয়ে নিজে একটা ঠোঁটে গুঁজি। লাইটারের আলোতে দুজনেই দুজনকে দেখি। তারপর বুকভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে শবনমের কথনভঙ্গি ধার নিয়ে বলি, তোমার মতোই সমাজরে এখন আমি বাল দিয়াও পুছি না। চলবে