আর কতদিন টিকবে বাংলাদেশ?

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১

আমেরিকায় আসার পরপরই আমার কাছে সাহায্য চাওয়ায় আমি একজনকে নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিক এজেন্ট হিসাবে চাকরি পেতে সহায়তা করি। সহায়তা বলতে বাংলাদেশের স্ট্যাইলের সহায়তা নয়, তার ফর্ম ফিলাপ করে দেয়া, ডকিউমেন্ট সাজিয়ে দেয়া, ফর্মে কিছু জটিল ব্যক্তিগত তথ্যাদি পূরণ করে দেয়াসহ অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে পরামর্শ।

এতে তার স্কুল ও কলেজ পরীক্ষার বিস্তারিত তথ্যাদি দিতে বলা হয়েছিল। মাসখানেক পর একদিন সে আমার কাছে এসে বলল, তার স্কুল থেকে প্রধান শিক্ষক তাকে ফেসবুকে টেক্সট করে জানিয়েছেন যে, আমেরিকার পুলিশ তার কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, অমুক নামের কেউ তাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন কিনা ইত্যাদি।

আমি সত্যিই খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। আসলে এজন্যই এরা আমেরিকান হতে পেরেছে। সামান্য ক্ষুদ্র বিষয়গুলিও এরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। ওখানে তাদের কাছে বোর্ডের সার্টিফিকেট দেয়া রয়েছে, ট্রান্সক্রিপ্ট দেয়া হয়েছে, এমনকি সার্টিফিকেটগুলি নিউইয়র্ক থেকে `ই-ভ্যালুয়েশন` করে সমমান মার্ক করেও দেয়া হয়েছে।

ই-ভ্যালুয়েশন কম্পানিগুলি সার্টিফিকেট যাচাই করে দেখে যে, এগুলি আসল বা জাল কিনা। অথচ এরপরও নিউইয়র্ক পুলিশ ভেরিফিকেশন করার জন্য তার নিজের দেশের স্কুলে ও কলেজে চিঠি পাঠিয়েছে। ঠিক তখনই আমার প্রয়াত আব্বার বলা কয়েকটা কথা মনে পরে গেল।

তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, বৃটিশ আমলে, এমনকি পাকিস্তান আমলেও সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর নিজের, ভাইবোনদের, তার পিতা, এমনকি দাদারও তথ্যাদি যাচাই করে দেখা হতো যে, তার ও তার বংশের কারো চরিত্রগত কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা, কোনো চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসী রয়েছে কিনা, কোনো মাদক ব্যবহারকারী বা ব্যবসায়ী রয়েছে কিনা, কোনো ক্রিমিনাল এক্টিভিটিজ আছে কিনা ইত্যাদি। সবকিছু যাচাই শেষে `নৈতিকতা সম্পন্ন` প্রতীয়মান হলেই শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হতো।

৭১ সালে বাংলাদেশ হয়ে যাবার পর থেকে এসব রীতি উঠে যায়। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন শুধুই `ঘুষ` নামের কথিত ‘স্পীড মানি`র জোর ছাড়া অন্য কিছুই যাচাই করা হয় না। ফর্মাল কিছু চেক-আপ করা হয়, তবে সেটা সে `জামাত বা বিএনপি` করে কিনা অথবা বিরোধী মতের কিনা, এটুকুই।

তো, এমন একটি অবস্থায় একটি সন্ত্রাসী-খুনি পরিবার থেকে আজিজ সেনাবাহিনীর মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানেও নিজের চাকরি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠানটিতে তার শীর্ষ পদে পদায়নেও কোনো সমস্যা হয়নি। রাখাল বালক ড. আতিয়ার দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর হতে পেরেছিল, অথচ তার যা পারিবারিক ইতিহাস তাতে পাকিস্তান বা বৃটিশ আমল হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে `এডি` পদেও চাকরি পাবার কথা নয়।

নিচু পরিবার থেকে বড় পদে আসলে ঠিক কি হয়, সেটা ড. আতিয়ারের কাছ থেকে আমরা দেখেছি। ৮১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক হয়ে যাবার পরও কয়েক মাস তা গোপন করে রাখা হয়েছিল। ড. আতিয়ার পরিকল্পিতভাবে চুরির হোতা একজন ইন্ডিয়ানকেই আবার তদন্তকারী নিয়োগ দিয়েছিল তার একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। সেই একই ফ্লোরে আগুন লেগে সব পুড়ে যাওয়া ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। এবং তার কোনো সঠিক তদন্ত না হওয়া বা সেই টাকা উদ্ধার না হওয়াও বাংলাদেশের জন্য কোনোই সমস্যা নয়।

সে বছরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৫ হাজার কোটি টাকার হিসাবও পাওয়া যায়নি। এছাড়া বর্তমানে জাতির মেরুদণ্ডখ্যাত শিক্ষা-ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সেক্টরেও যা অবস্থা চলছে, তাতে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী হবার শতকরা এক ভাগও সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে জনগণ সচেতনত না হলে এবং নৈতিক বোধ থেকে গর্জে না উঠলে বাংলাদেশের ধ্বংস ছাড়া আমি অন্যকিছু চিন্তাও করতে পারি না। কেবল একটি প্রশ্নই বারবার বুকের ভেতর জেগে ওঠে, আর কতদিন টিকবে বাংলাদেশ?