আরব বিশ্ব এক হলে এক ফুৎকারেই উড়ে যেত ইসরাইল

রাহমাতুল্লাহ ইমন

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২১

ফিলিস্তিন ইস্যুকে যারা আরব-ইসরায়েল বিরোধ বলে ভাবে, তারা কোন স্বর্গে বাস করে তা আমার জানা নেই। ইসরায়েলের যা সার্বিক অবস্থান তাতে আরবরা শুধু ফুঁ দিলেই ইসরায়েলের এই ধরা থেকে হাপিশ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা না হয়ে কিভাবে ইসরায়েল সবার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে? এক্ষেত্রে আমার যা মূল্যায়ন তাতে অনেকেই আমার ওপরে রে রে করে তেড়ে আসবে। তাই তেড়ে আসার আগে তাদের বলব ইতিহাসটি ভালো করে জানুন আর ঠাণ্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতি ভাবুন। একমাত্র তাহলেই এই সমস্যার গভীরে আপনি ঢুকতে পারবেন।

একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ মানবিক কারণে কক্সবাজারসহ আশপাশের কিছু জায়গায় তাদেরকে থাকতে দিয়েছে। কয়েক বছর পর কক্সবাজারকে রাজধানী ঘোষণা করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বাংলাদেশের ৭০-৮০ ভাগ জায়গা দখল করে নিয়ে রোহিঙ্গা রাষ্ট্র ঘোষণা করল। এই গল্পটি কি আপনাদের কাছে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো? না হবারই কথা। হ্যাঁ, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এভাবে কল্পনাও করতে পারবে না। তাহলে আজকের ইসরায়েলের ইতিহাস আপনি মেনে নিচ্ছেন কিভাবে? ঘটনা তো হুবহু এক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই ধরার বুকে ইসরায়েল নামের কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। নাৎসি জার্মানির অত্যাচারে বিপন্ন ইহুদিদের একটি নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের আওতায় থাকা ফিলিস্তিন যা কিনা ঐতিহাসিকভাবে বনি ইসরাইলের আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল, সেখানে ইউরোপ থেকে আসা উদ্বাস্তু ইহুদিদের বসতি স্থাপনের কাজটি করেছিল ব্রিটেন। বিশ্বযুদ্ধে তুর্কিরা যেহেতু জার্মানির পক্ষ নিয়েছিল, এটা ছিল তাদের পরাজয়ের শাস্তি যা মেনে নেয়া ছাড়া তুরস্কের কোনো উপায় ছিল না। ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্ররা যারা জাতিগতভাবে ছিল আরব, প্রথম থেকেই এই অভিবাসন প্রক্রিয়া মেনে নিতে পারেনি। সেই সময় ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মাত্র তিন শতাংশ। কিন্তু ব্যাপক অভিবাসনের কারণে অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা তিরিশে উন্নীত হয়।

ব্রিটিশরা নতুন নতুন আরব জায়গা দখল করে ইহুদি বসতি গড়তে শুরু করে। আর এ কারণেই ফিলিস্তিনের সংঘাতকে সাদা চোখে আমরা আরব-ইসরায়েল সংঘাত বলেই ভেবে থাকি। কিন্তু বাস্তবতা এর থেকে অনেক আলাদা। এর মূলে রয়েছে ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে তা নিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল। যার ফায়দা নিচ্ছে ইসরায়েল, আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। আমরা সবাই জানি যে, একাধিকবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। কাগজে কলমে একদিকে সব আরব রাষ্ট্র আর অন্যদিকে শুধুমাত্র ইসরায়েল। সামরিক সামর্থ্যের বিবেচনায় আরবরা শুধুমাত্র ফুঁ দিলেই ইসরায়েলের উড়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধের ফলাফল কি? সম্মিলিত আরব শক্তি পুচকে ইসরায়েলের কাছে গোহারা হেরেছে, বারবার। আর তাতে ফিলিস্তিন তো বটেই, মিশর, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়ার অংশ বিশেষ ইসরায়েল দখল করে বসেছে। এটা কিভাবে সম্ভব?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পক্ষালম্বন করার কারণে পরাজয়ের পর মিত্রবাহিনীর কোপ নেমে এসে আরবদের ওপরে। অধিকাংশ আরবভূমি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ব্রিটেন আর নেপথ্যে থাকে আমেরিকা। উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ফ্রান্সের হাতে। আরবভূমিকে ইচ্ছেমত কেটেকুটে অনেকগুলো রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি প্রথম থেকেই চেয়েছে ইসলামি নেতৃত্ব থাকুক তাদের বশংবদ সৌদি আরবের হাতে। সেই কারণেই ইসলামের প্রধান দুটি পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার কর্তৃত্ব তাদের হাতে অর্পন করা হয়।  কিন্তু মিত্রবাহিনীর দুই প্রধান শরিক আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে দ্বন্দ্ব শুরু হলে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আরব বিশ্বের ওপরে। সৌদি আরব বরাবরই ছিল আমেরিকার বিশ্বস্ততম মিত্র। এই বলয়ে থাকা অন্য দেশগুলোর মাঝে ছিল তুরস্ক, জর্ডান, ইরান। বিপ্লব ঘটিয়ে মিশরের ক্ষমতায় আসা গামাল আবদেন নাসের সোভিয়েত শিবিরে যোগ দিলেন।

কালক্রমে এই শিবিরে যুক্ত হয় ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো। লেবাননে হতে থাকে ক্ষমতার পালাবদল। মিশরের প্রভাবে গড়ে ওঠে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে। মিশরের প্রভাব বলয়ে থাকা পিএলও র পক্ষপাতিত্ব ছিল সোভিয়েত ব্লকের দিকেই আর এতেই তারা চক্ষুশূল হয় আমেরিকা আর তার মিত্রদের। নৈতিক কারণে সব আরব দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ সমর্থন করলেও ভেতরে ভেতরে স্যাবোটাজ করতে থাকে আমেরিকার মিত্র আরব দেশগুলো। এমনকি যাদের ওপর ফিলিস্তিনিদের আস্থা ছিল সবচে বেশি সেই মিশরের সেনাবাহিনীর একটি অংশও গোপনে হাত মিলিয়েছিল ইসরায়েলের সাথে আর যাতেই শোচনীয়ভাবে পরাজয় ঘটে ফিলিস্তিনের। এরপর আনোয়ার সাদতের সময় থেকে মিশর ফিরে আসে মার্কিন জোটে। ইরানে খোমেনির নেতৃত্বে তথাকথিত ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান মার্কিন জোট থেকে বেরিয়ে এলেও তাদের একটি গোপন যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল আমেরিকা এবং ইসরায়েলের সাথে।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরান-কন্ট্রা কেলেংকারির ঘটনা নিশ্চয় সচেতন মানুষেরা বিস্মৃত হননি। এসময় ইসরায়েল গোপনে মার্কিন অস্ত্র পৌঁছে দিত ইরানের হাতে নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের মাধ্যমে। পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনকে কুঠারাঘাত করে। এখন আর কোন ফিলিস্তিন নেতাই অখণ্ড ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন না। এমন কি পশ্চিম তীর আর গাজা উপত্যকায় যে সীমিত স্বায়ত্বশাসন তারা অর্জন করেছিল তাও ব্যাহত হয়েছে বারংবার। কিন্তু তারপরেও তাদের ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল মোটেই আলগা হয়নি। সোভিয়েতের পতনের পর আরব বিশ্বে নতুন মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। আর এবারের মেরুকরণ হচ্ছে সবচে মারাত্মক ধাঁচের শিয়া সুন্নি মতবাদকে কেন্দ্র করে। হযরত মোহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর দিন থেকেই খেলাফত নিয়ে এই দুই গোষ্ঠীর বিবাদ শুরু। এই বিরোধ যে কতটা গভীরে প্রোথিত তা বাংলাদেশের মতো দেশে বসে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

কার্যক্ষেত্রে আমার সুযোগ হয়েছে অসংখ্য সৌদি ও ইরানির সংস্পর্শে আসার। এদের এক জাতির প্রতি অন্য জাতির অবিশ্বাস এবং ঘৃণার কোনো তুলনা চলে না। আমি অনেক বৈঠকে ভারতীয় এবং পাকিস্তানিদের পাশাপাশি বসে গল্প করতে দেখেছি, কিন্তু কখনো সৌদি আর ইরানিদের কুশল বিনিময় করতে দেখিনি। এমনকি না জেনে যদি তারা কখনো পাশাপাশি বসেও পড়েছে, পরিচয় পাওয়ামাত্র ছিটকে সরে গেছে একে অন্যের পাশ থেকে। এক সভায় একজন ইরানির পাশে বসার পরদিন আমার একাধিক সৌদি ছাত্র আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিয়েছে। তাদের বিশ্বাস, শিয়ারা শরীরের ভেতর ছুরি রেখে দেয় সুন্নি দেখলেই তা চালিয়ে দেবার জন্য। এটা বাত কি বাত নয়, ছোটবেলা থেকে তারা এমন বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়। আমার একাধিক সৌদি ছাত্র অনুযোগের সুরে বলেছে, আমি কেন ইরানিদের সাথে মিশি বা কথা বলি। কেননা কিয়ামতের আগে ইরানিরা এসে কাবা ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে, ওরা অভিশপ্ত।

অপর পক্ষে ইরানিদের দেখেছি, অনেক ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও তারা জুমুআ বা ঈদের নামায পড়তে আসে না। কারণ সেখানে শিয়া মসজিদ নেই। সরকারের কথা বাদই দিলাম, এ যাবত যত সৌদি ছাত্রের সাথে কথা বলেছি তাদের সবার অভিমত, ইসলামের সবচে বড় দুশমন হলো ইরান। ইসরায়েলকে শত্রু ভাবা তো দূরের কথা, তারা বিপদের বন্ধু বলে ভাবে। তাদের ধারণা, ইরান যদি কখনো সৌদি আরব আক্রমণ করে তখন ইসরায়েল তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। সুন্নি আরব সৌদি, মিশর, জর্ডান এবং উপসাগরীয় কিছু দেশ এখন আর কোনো রাখ ঢাক না করে সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করছে। অন্যপক্ষে ইরান, সিরিয়া, ইরাকের শিয়া জোট ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিচ্ছে কিন্তু ৮৫% সুন্নি অধ্যুষিত ফিলিস্তিনে তাদের এই সমর্থনকে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরাই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। অনেকের আশঙ্কা, এই বিবাদের সুবাদে হিজবুল্লাহর মতো শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ সেখানে ঢুকে পড়তে পারে।

আজ যে হামাস ফিলিস্তিনিদের রক্ষাকর্তা বলে বিবেচিত হচ্ছে তার জন্ম হয়েছে খোদ ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোশাদের হাতেই। তাদের নেপথ্য কলকাঠি যে এখনও ইসরায়েলিরাই নাড়াচ্ছে না সেই গ্যারান্টি কে দিতে পারে? তুরস্ক দীর্ঘকাল মার্কিনীদের তাবেদারি করে এসেছে। হাল আমলে সুন্নি ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবের সাথে বিরোধের জের ধরে তাদের অবস্থান ফিলিস্তিনের পক্ষে হলেও তা যতটা না কাগজে কলমে বা মুখে, যুদ্ধের ময়দানে ততটা নয়। তবে কি ফিলিস্তিনে শান্তির আশা সুদূর পরাহত? রক্ত আর কান্নাই কি তাদের একমাত্র নিয়তি? কথাটি শুনতে খুব খারাপ শোনালেও বাস্তব সত্য হয়তো এটাই। আমি এখনও বিশ্বাস করি, আরব বিশ্ব যদি এক হয় তবে ইসরাইল এক ফুঁৎকারেই উড়ে যেত। কিন্তু সাত মণ ঘিও পুড়বেনা, রাধাও নাচবে না। কোনো পরাশক্তিই চায় না বিরোধ মিটে যাক। তারা বিরোধ জিইয়ে রাখতে চায় তাদের অস্ত্রের বাজার চাঙা রাখার স্বার্থে। পারলে আরবরাই পারত, কিন্তু ফিলিস্তিন এখন আরব সুপ্রিমেসির হান্টিং গ্রাউন্ড। কেয়ামত পর্যন্ত আরবদের মাঝে শিয়া সুন্নির বিরোধ মিটবে না, শুধু নিরীহ নিরাপরাধ নারী পুরুষ শিশুর রক্তে রঞ্জিত হবে ফিলিস্তিন।