আরিফুল ইসলামের গদ্য ‘জ্ঞানার্জনে বয়স’

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২১

আমাদের একটু বয়স হলেই মনে করি, আমরা আর জ্ঞানার্জন করতে পারবো না। আমাদের জ্ঞানার্জনের বয়স শেষ হয়ে গেছে। আমরা আফসোস করে বলি, আবার যদি আমরা বাল্যকালে চলে যেতে পারতাম, তাহলে জ্ঞানার্জন শুরু করতাম। আমরা ধরেই নিয়েছি, এই বয়সে আর জ্ঞানার্জন শুরু করা যায় না।

জ্ঞানার্জনের যেমন কোনো বয়স নেই, যেকোনো বয়সেই যেমন মানুষ জ্ঞানার্জন করতে পারে, তেমনি জ্ঞানার্জন শুরুরও বয়স নেই। আপনি যদি শৈশবে শুরু করতে না পারেন, তাহলে যৌবনে শুরু করতে পারেন। দুজন মানুষের গল্প বলবো, যারা পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করেন অনেক দেরিতে।

এক.
সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হিশেবে নোমান বিন সাবিতের দিন ভালোই চলছিল। নিয়মিত বাজারে যেতেন। কেনাবেচা করতেন, বাড়ি ফিরতেন। নিত্যকার রুটিনের মতো তিনি একদিন বাজারে যাচ্ছিলেন। তখন তার বয়স প্রায় বিশের কোঠায়। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধ তাকে ডাক দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ?
নোমান বললেন, আমি বাজারে যাচ্ছি।
বৃদ্ধ মূলত জানতে চাচ্ছিলেন, তুমি কার কাছে পড়াশোনা করো? বৃদ্ধ আবার প্রশ্ন করলে নোমান ঝটপট জবাব দিলেন, আমি কারো কাছে পড়তে যাই না।

যুবকের কথা শুনে বৃদ্ধা বেশ অবাক হলেন। এই যুবকের মধ্যে তিনি স্পষ্ট প্রতিভার ঝলক দেখতে পাচ্ছেন আর সে কিনা পড়াশোনা করে না! নোমানকে তিনি কাছে ডেকে নিলেন।

বৃদ্ধ নোমানকে বুঝালেন, দেখো, তোমার মধ্যে আমি প্রতিভার এক চাপা আলো দেখতে পাচ্ছি। আমি চাই, তুমি জ্ঞানী-গুণীদের সাথে ওঠাবসা করো।

উপদেশটা নোমানের অন্তরে দাগ কাটলো। বৃদ্ধ কী আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছেন, তোমার মধ্যে প্রতিভার ছাপ আছে! এই একটা কথা তার মনের মধ্যে সুনামির সৃষ্টি করলো। বৃদ্ধর কথা তো ফেলনা না, আর তিনি তো যেনতেন লোকও না। এই বৃদ্ধ হলেন কুফার শ্রেষ্ঠ ইমাম ইমাম আশ শা’বী (রাহিমাহুল্লাহ)।

মানিকে মানিক চেনে। কুফার শ্রেষ্ঠ ইমাম আশ শা’বী বাজারমুখী যে যুবককে জ্ঞানমুখী করেন পরবর্তীকালে সেই যুবক সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন ‘ইমাম আবু হানিফা’ (রাহিমাহুল্লাহ) নামে।

ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) প্রধান শিক্ষক ছিলেন হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান (রাহিমাহুল্লাহ)। তার কাছে ইমাম আবু হানিফা পড়াশোনা শুরু করেন ২২ বছর বয়সে। (ইমাম আবু হানিফা, আবু যাহরা, পৃষ্ঠা ৩০)

দুই.
২৬ বছর বয়সের এক যুবক জানাজার নামাজ পড়বেন। আসরের নামাজের পর জানাজা। তিনি মসজিদে ঢুকলেন, মসজিদে ঢুকে বসে পড়লেন। এক মুরব্বি তাকে উঠে দাঁড়াতে বলেন। তাকে বলা হলো, তুমি এত বড় হয়েছো, এখনো জানো না মসজিদে প্রবেশ করে বসার আগেই দুই রাকআত নামাজ পড়তে হয়?

যুবক উঠে দাঁড়ালেন। দুই রাকআত নামাজ পড়লেন।
জানাজার নামাজ শেষে আবারো তিনি মসজিদে গেলেন। তখন সূর্য ডুবি-ডুবি অবস্থা। তিনি ভাবলেন মসজিদে যেহেতু প্রবেশ করছেন, দুই রাকআত নামাজ পড়ে নেবেন। নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। তখন একজন এসে বললো, এ-এ-এ, কী করছো!
তিনি বললেন, আমি তো মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকআত সুন্নাত নামাজ পড়ছি।

তখন তাকে বলা হলো, তুমি কি জানো না যে, এখন নামাজের নিষিদ্ধ ওয়াক্ত? এখন নামাজ পড়তে নেই।

ওইদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি বেশ অপমানিত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, এত বড় হয়ে গেলেন অথচ নামাজের বিধান ঠিকমতো তিনি জানেন না! তিনি ফিক্বহ নিয়ে পড়াশোনার জন্য আবু আব্দিল্লাহ বিন দাহুনের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে যান। তার তত্ত্বাবধানে তিন বছর ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ পড়েন। (ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ১৩/৩৮০-৩৮১)

২৬ বছর বয়সে পুরোদমে জ্ঞানার্জন শুরু করা সেই ব্যক্তিটি হলেন আন্দালুসের বিখ্যাত স্কলার ইমাম ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ)। ইসলামের ইতিহাসে সেরা দশ পলিম্যাথ স্কলারের মধ্যে তাকে ধরা হয়।

ইমাম আয-যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে বলেন, আল-ইমাম, আল-আল্লামা, আল-হাফিজ, আল-ফক্বীহ, আল-মুজতাহিদ। ইয়াযুদ্দীন ইবনে আব্দিস সালাম (রাহিমাহুল্লাহ), যাকে বলা হয় ‘উলামাদের সুলতান’, তিনি ইমাম ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে বলেন, ইমাম ইবনে হাযমের (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-মুহাল্লা’ ও ইমাম ইবনে কুদামার (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-মুগনীর’ মতো শ্রেষ্ঠ কিতাব আমি আর দেখিনি। (ইমাম আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ১৩/৩৭৮)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম ইবনে হাযমের (রাহিমাহুল্লাহ) জ্ঞানের প্রশংসা করেন। ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ দুজন ইমাম কিশোর-যুবক বয়সে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে। আপনি যদি শৈশবে জ্ঞানার্জন করতে না পারেন, তাই বলে হতাশ হয়ে পড়বেন না। আপনার সময় শেষ হয়ে যায়নি। বর্তমানে এমন অনেকেই ভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করে আবার মাদ্রাসায় পড়ে আলেম হয়েছেন।

আপনি কোথায় আছেন এবং কোথায় যেতে চান, এটা ঠিক করে নিন। কোনো বিষয়ে কতটুকু জ্ঞানার্জন করতে চান, সেটাও ঠিক করে নিতে হবে। গন্তব্য অনুযায়ী মানুষ তার বাহন সিলেক্ট করে। বাড়ি থেকে বাজারে যেতে চাইলে হয়তো রিক্সায়, সাইকেলে যায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গেলে হয়তো বাস বা ট্রেনে যায়। আবার, বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকায় যেতে চাইলে প্লেনে যায়। আপনি কোন ধরনের জ্ঞানার্জন করে কোথায় যেতে চান সেটার উপর নির্ভর করছে বাহন।

আপনি যদি ইসলামের একেবারে বেসিক (যা না জানলেই নয়) জানতে চান, তাহলে আপনার নিকটস্থ কোনো আলেমের কাছে গিয়ে টিউশনি টাইপের পড়াশোনা করতে পারেন। অনলাইনে ফরজে আইনের এমন অসংখ্য কোর্স পাওয়া যায়, সেগুলোও করতে পারেন। আপনি যদি নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী জানতে চান, তাহলে বিভিন্ন লেকচার সিরিজ দেখতে পারেন, সীরাত বিষয়ক বই পড়তে পারেন।

কিন্তু, আপনি যদি আলেম হতে চান, বড় স্কলার হতে চান, তাহলে আপনাকে ইমাম আবু হানিফার মতো কোনো একজন হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান বা ইমাম ইবনে হাযমেরে মতো কোনো একজন আবু আব্দিল্লাহ বিন দাহুনের দ্বারস্থ হতে হবে। জ্ঞানার্জন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই দুটো জিনিস লাগবে। একজন মেনটর, গাইড, আলেম বা একটি প্রতিষ্ঠান। আর দুই হচ্ছে, বই-পুস্তক।

এই দুটোর কোনো বিকল্প নেই। শুধুমাত্র একটি দিয়ে হবে না, অন্যটিও লাগবে। আপনি জ্ঞানার্জন করে নিজেকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, সেটার উপর নির্ভর করছে আপনি কোন বাহনে উঠবেন। যারা বিবিএ তে পড়ে, তারা নন-মেজর কোর্স হিশেবে General Science পড়ে। এই কোর্সের সাথে বিবিএ’র কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলো জানার জন্য এই কোর্স। এই কোর্স পড়ে কেউ বিজ্ঞানের এক্সপার্ট হবে না।

যারা ভার্সিটিতে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, সিএসসি পড়ছে, তাদের কাছে এই কোর্সটি ‘অ-আ-ক-খ’ মনে হবে। এই একটি কোর্স পড়ে আপনি যেমন ভার্সিটির সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে পড়া কারো সাথে যুক্তিতর্কে যেতে পারেন না, তেমনি যেকোনো বিষয়ের প্রাথমিক বই পড়ে ঐ বিষয়ের এক্সপার্ট হতে পারবেন না। আপনাকে এক্সপার্ট হতে হলে ওই ডিসিপ্লিনে গিয়ে ভালোভাবে সেটা রপ্ত করতে হবে।

আপনি ইসলামের বেসিক জানতে চান, নাকি স্কলার হতে চান এই প্রশ্ন ঠিক করে নিন। আপনি যেই বয়সেরই হোন না কেনো, জ্ঞানার্জন শুরু করতে আপনি এখনো বুড়ো হননি। আপনার গন্তব্য ঠিক করে সেই গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে এমন বাহনে উঠুন।