আশিকুজ্জামান টুলুর গদ্য ‘শিল্পীজীবন’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২১

একজন শিল্পী যখন তার যাত্রা শুরু করে তখন সেটা নেহায়েত নেশা থাকে, পরবর্তীতে নেশা ও পেশার সংমিশ্রণে একটা নতুন প্রফেশনের সৃষ্টি হয়। যেখানে নেশার সাথে আয় এসে যোগ হয়। আস্তে আস্তে এরা নাম করে, সবাই এদেরকে চেনে, এদের মনের ভিতরে একধরনের আনন্দ সবসময় বিরাজ করতে থাকে। কী যে ভালোলাগা সারা মনকে ঘিরে রাখে, তা শুধুমাত্র এরাই জানে।

হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা আসতে থাকে, অগণিত, অপ্রত্যাশিত টাকা, পকেট ভর্তি প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা, কোনও দিন স্বপ্নেও না দেখা টাকা। প্রথমেই ইচ্ছা করে একটা গাড়ি কিনতে, কিনে ফেলে কোনও দিকে না তাকিয়েই। এরপর কোনও এক তাজ হোটেলে সকাল-বিকাল চলতে থাকে খাদ্যপ্রিয় শিল্পীর পাঙাশ মাছের পেটি, খাশির পায়া দিয়ে নানরুটি, চিকেন বা মাটন বিরিয়ানি, আরও কতধরনের সুস্বাদু খাবার!

সাথে আছে অটোগ্রাফ, ফোটোগ্রাফ, ভালোলাগা, ভালোবাসা। চাওয়ার আগেই সব কিছু হাতের নাগালে। সবচাইতে এলিট থেকে প্রলেট্যারিয়েট, সবচাইতে নিঃস্ব থেকে পুরো বিশ্ব- সবাই এক নিমেষেই হয়ে যায় বন্ধু। চারিদিকে সাজ সাজ রব, শুধু সাকসেস আর সাকসেস। এক নিমেষ দেখার জন্য লেগে যায় ফ্যানদের বিরাট লাইন। কী রঙিন পৃথিবী!

এরকম একটা জীবন যে কী পরিমান অন্ধ করে দেয় একজন শিল্পীকে, তা সে নিজে একেবারেই টের পায় না। ভবিষ্যৎ বলে যে একটা জিনিস অ্যাকজিস্ট করে, সেটা বেমালুম ভুলে যায়। ভবিষ্যতে কী হবে, কীভাবে জীবন চলবে, কোনও কিছুরই কোনও খবর থাকে না। কারো পড়াশুনাটা কমপ্লিট হয়, কারো হয় না। তাতে এদের কিছুই আসে যায় না। কারণ টাকা কামানোর জন্যেই তো পড়াশুনা, তো টাকা যদি মিউজিক করেই চলে আসে অগণিত, তাহলে আর পড়াশুনা করে লাভ কি।

মন শুধু রঙিন স্বপ্নের ভেলায় ভাসতে থাকে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও মনটা, চোখটা যেন কী খুঁজতে থাকে। এরপর হঠাৎ একদিন সমুদ্রের জোয়ারের মতো প্রেম আসে, উজাড় করে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার জন্য যা প্রয়োজন, সব কিছুই সে করে, কার্পণ্য করে না কিছুর। তারপর একদিন সংসার শুরু করে। শুধু শুরুই করা হয়, কিন্তু এ সংসারের কোনও কিছুই বোঝার মধ্যে আসে না। বেশিক্ষণ এক জিনিস ভালো লাগে না। বোর লাগে। বেশিক্ষণ বউও ভালো লাগে না। মনকে শুধু টানে মিউজিক। একমাত্র মিউজিক ছাড়া আর কিছুই ঢোকে না মাথায়।

ব্যস্ততা আরও বাড়তে থাকে। বর্তমানের ব্যস্ততায় ভবিষ্যতের চিন্তা ধারে কাছে ভিড়তে পারে না। মনে হয়, সারাজীবন এই ব্যাস্ততাই থাকবে।... এগিয়ে যেতে থাকে জীবন। একইসাথে পৃথিবীতে থাকার বয়স কমে আসতে থাকে। কোন অলক্ষ্যে যেন বয়স এক এক করে বাড়তে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে। ওদের প্রতি কর্তব্য, দায়িত্ব বাড়তে থাকে, সাথে খরচও বাড়ে। ধীরে ধীরে মাথার ওপরের সূর্যটা কখন যেন একটু হেলে পড়ে পশ্চিমের আকাশে। আস্তে আস্তে রোদের তাপ কমে আসতে থাকে। একসময় ধূলা উড়িয়ে ঠাণ্ডা বিকাল এসে পড়ে।

পাখিদের নীড়ে ফেরার সময়ও ঘনিয়ে আসে। ক্রমেই রোদটা আরও নরম হয়ে যায়। কখন যেন গোধূলি লগ্নের সূত্রপাত সব পাখিদের ঘরে ফিরিয়ে নেয়। ঠিক সেভাবেই শিল্পীদেরও ঘরে ফেরার সময় হয়ে আসে। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার ফুরসত চলে আসে। প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় ভাবনাটা ভাবার জন্য। আস্তে আস্তে একটা একটা করে রেকর্ডিং কমে, ফাংশন কমে। কেন যেন আগের মতো কেউ ডাকে না। একধরনের অবহেলা, ভুলে যাওয়া, দেখে না দেখা বিষয়গুলো আসতে থাকে সব প্রোডিউসার, মিউজিক ডিরেক্টর, মুভি ডিরেক্টরদের মধ্যে। বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করে।

কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। শুধু মনে হয়, যদি অনেক টাকা থাকতো তাহলে এত টেনশন না করে শুধু মিউজিক কোরতাম। একা একা কাটে প্রতিটা মুহূর্ত, বউ বাচ্চা কাছে থাকলেও চোখ আর মন ওদের দেখতে পায় না, শুনতে পায় না।

বিরাট সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে। জীবনেও কারো কাছে মাথা নত করতে হয় নাই। তাই আর ইচ্ছাও করে না মাথা নত করতে। এরকম একটা অবস্থার মানুষের যখন মসনদ থেকে নেমে আসতে হয় রাজপথে, বুকের ভিতরটা তখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। না পারে কইতে, না পারে সইতে। নদীর যখন ভাঙন শুরু হয় তখন সে সবকিছু পানিতে টেনে নেয়। দেখে না কার ঘর ভাঙলো আর কার ভাঙলো কপাল। শিল্পীদের সাঁঝবেলাটা ঠিক তেমন। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটা শিল্পী ভীষণ একা। সারাজীবন এরা একান্ত নিজের একটা জগতে বসবাস করে বলে কারো ভীষণ কাছে কোনও দিনও যাওয়া হয় না।

হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে থেকেও ভীষণ একা একটা জীবন পার করে এরা, ঠিক সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সিনেমার নায়কের মতো। সেই কারণে আশপাশে কাউকে পায় না, এদের দরকারে। অতি সমর্পণে সাঁঝ পেরিয়ে রাত নেমে আসে শিল্পীর জীবনে। চারিদিকে ঘুটঘুটে কালো কালি দিয়ে লেপে দেয়া অন্ধকার। একধরনের অভূতপূর্ব একাকিত্ব এদেরকে গ্রাস করে। একা একা ক্ষয় হতে থাকে সবার চোখের অলক্ষ্যে। কাউকে শেয়ার করে না মনের ভিতর জমে থাকা ব্যথার কাব্যগীতি।

সারাটা জীবন অন্যকে আনন্দ দেয়া মানুষটা নিজেই আনন্দের আকালের সন্ধানে দিনাতিপাত করতে থাকে। বয়সের ভারে এরই মধ্যে দূরারোগ্য ব্যাধি এসে বাসা বাঁধে শরীরে। আয় রোজগার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বন্ধ হয় না প্রাত্যহিক সাংসারিক চাহিদা। এমন একটা অবস্থার মধ্যে এসে দাঁড়ায় জীবনটা যে, তা আর কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। একসময়ের ধোপদুরস্ত একনামে চেনা শিল্পী, ঝড়ের রাতে বিশাল সমুদ্রে ভেসে থাকা জীবন নায়ের একলা নাবিক হয়ে যায়। যার চোখের সামনে শুধু অগণিত ঢেউ আর বুকফাটা সমুদ্রের গর্জন।

অপেক্ষা এখন শুধু নৌকাটা ডুবে যাওয়ার। আর ভালো লাগে না এই বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে। কোনো একফাঁকে মনে এসে উঁকি দেয় সেই গানটা, ও আমার দরদী আগে জানলে, আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না।

একদিন সত্যি সেই শেষ আর সবচাইতে বড় ঢেউটা আসে বুকে টেনে নিতে শিল্পীকে। ও নির্ভয়ে এগিয়ে যায় বুকে বুক মিলানোর জন্য। মধুমিলন ঘটে যায়। একটা শতাব্দীর ইতি টানা হয়। বিশাল ঢেউয়ের কোনও এক গহ্বরে হারিয়ে যায় আমাদের অতিচেনা প্রাণপ্রিয় শিল্পী। আর কোনও দিনও পরিচিত জনপদে দেখা যায় না বাবরি দোলানো, মন ভোলানো, সুর তোলানো আত্মভোলা শিল্পীকে, যে শুধু সবাইকে আনন্দ বিলিয়ে যাচ্ছিলো, যাচ্ছে এবং যাবে... থামবে না কোনও দিন তার আনন্দ বিতরণ, নিঃশ্বাসটা থেমে গেলেও।

লেখক: কণ্ঠশিল্পী ও রম্যলেখক