ইসলামি আলোচনার ভাষিক ও পদ্ধতিগত দিক

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৭, ২০১৯

ইসলাম নিয়ে আলোচনার সময় ইদানীং প্রধান হয়ে উঠতে দেখি পাশ্চাত্য দর্শন ও রাজনীতিশাস্ত্রের পরিভাষা। এক পরিমণ্ডলের ভাব ও ভাষা দিয়ে অন্য পরিমণ্ডলের ভাব-ভাষাকে ধরতে বা বোঝাতে নতুন অর্থপ্রাপ্তি ও অর্থসংকোচ ঘটার নজির আছে। ক্রিয়েটিভ বা ডেস্ট্রাক্টিভ (মিস) রিডিংয়ের সম্ভাবনাও এতে প্রকট। যাহোক, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডলে ইসলামের এথিকাল ও রিচুয়াল দিকের আলোচনা উঠেই গেছে বলা যায়। ওই পরিসরটুকু যেন সীমায়িত হয়ে পড়েছে ট্র্যাডিশনাল আলেমদের মধ্যেই। এবং ইসলামকে নিয়ে দার্শনিক-সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনীতিশাস্ত্রীয় দিক থেকে আলোচনা সেই জায়গা দখল করেছে। যুগের প্রয়োজনেই ঘটেছে হয়তো এটা। কিন্তু এই আলোচনা যে ভাষায় করা হয় সেই ভাষা বাম, সেকুলার, উত্তরাধুনিকতাবাদী ও এমনকি পুঁজিবাদী ধারার ধারকৃত ভাষা।

হামদ-নাতের সুরও হিন্দি ও ইংরেজি গানের সুর নকল করে মাইকে প্রচার হতে দেখি। কোরআন তেলোয়াতের সুরেও সিনেমার দুই একটি জনপ্রিয় গানের সুরকে প্রায় হুবহু গ্রহণ করতেও শোনা যায়। এই `অনুকরণ` করা যাবে না তা হয়তো নয়, কিন্তু শিল্প ও বুদ্ধিজীবীতা— এই উভয় পরিমণ্ডলেই সৃজনশীলতার নিদারুণ সংকট উদ্ভাবনে অনীহা ও পরিশ্রমে গাফিলতিরই নমুনা। ইসলাম সবক্ষেত্রেই `সামগ্রিক পরাণুকরণ` বা তাশাব্বুহকে নিরুৎসাহিত করে, অনেক সময় নিষিদ্ধ করে। আমরা জ্ঞানের জগতে যেভাবে পাশ্চাত্য ও খ্রিস্টিয় ভাবরাজি দ্বারা তাড়িত হই, সব ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য চিন্তা দিয়ে নিজেদের দ্বীন-ধর্মকে মাপতে চাই, খাপ খাইয়ে নিতে চাই তা সংকটজনক। মুমিনের ওয়াজ-আখলাক কেমন হবে তা কোরআন-হাদিস থেকে সরাসরি পাই, তো আমাদের লেখা-প্রতিলেখাও হতে পারে ওই একই আদর্শানুযায়ী। ‘মুমিনের গদ্যভাষা’ নিয়ে চাইলে টুকিটাক গবেষণাও করা যায়, তবে তা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। জাস্ট ইজতেহাদি কাজ এটা।

পরিভাষার কাজ হচ্ছে বড় ভাবকে সহজে প্রকাশ করা ও এনালাইটিকাল টুল হিশেবে কাজে লাগানো। জ্ঞানের জগতে পরিভাষা নির্মাণ জরুরি কাজ। যেকোনো বড় চিন্তককেই নতুন পরিভাষা নির্মাণ করতে হয়, যেকোনো ডিসিপ্লিনেরই বিশেষ পরিভাষা থাকেই। ইসলামের জগৎবীক্ষাকে সহজে প্রকাশ করতেও পরিভাষা আছে, তৈরিও করা যায়। আজকাল অনেক লেখক তা করছেন, আগেও করা হয়েছে। ধরা যাক, ইসলামে `হক` এর ধারণা। এটি অধিকারের ধারণা থেকে ভিন্ন। ইন্সাফ জাস্টিস থেকে ভিন্ন, যুলুম শুধু শরীরী নির্যাতনকেই বোঝায় না, নূর মানে খালি আলো নয় ইত্যাদি। ইবাদাত বলতে শুধু উপাসনা নয়, মোয়ামেলাতে শুধুই জাগতিক লেনদেনের আক্ষরিক অর্থই প্রযুক্ত নয়। ইসলামকে কেউ যদি আগে নিজে বুঝতে চায় তবে ইসলামকে প্রথমত ইসলাম দিয়েই বুঝবেন, কারো সাথে তুলনা ছাড়াই।

দ্বিতীয় পর্যায়ে, তুলনা ও অন্যান্য সাপেক্ষতা দিয়ে বুঝবেন বা বুঝাবেন। এটা যেকোনো বিষয় বোঝা বা বোঝাবার প্রাথমিক প্রেক্ষিত। যা ইসলামে একান্ত বিশিষ্টার্থক তা বোঝাতে ইসলামের নিজস্ব পরিভাষা ব্যবহারকেই প্রচলন করা উচিত। কোনো বিশেষ শাস্ত্র যে পরিভাষা ব্যবহার করে তার জ্ঞানীয় ঐতিহাসিকতা আছে। যেমন, এনলাইটেন্মেন্ট, সেকুলারিজম এই পরিভাষাদ্বয় পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত। রেনেসাঁ নামক টার্মটিও বিশেষ ভাবগত ইতিহাসের সাথে যুক্ত। তেমনি, জিহাদ শব্দের ক্ষেত্রেও একই কথা। এটি কোনো হোলি ওয়ার নয়। পাশ্চাত্য তার নিজের ভাবগত ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে `অপর`-কে দেখে। আপনি আমিও চাইলে ইসলামের ভাবগত জায়গা থেকেও জগৎকে দেখতে পারি। ধরা যাক, আপনি বলতে পারেন, মার্ক্সবাদেও বেদাত ঢুকছে। মানে, মার্ক্সবাদের ডমিনেন্ট ব্যাখ্যাগুলোর বাইরে অন্য নতুন কিছুকে কেউ `মার্ক্সবাদ`-এর নামে চালাতে চাইলে আপনি বলতে পারেন এটা `বেদাতি মার্ক্স`। আবার, পাশ্চাত্য ভাবের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আপনি বলতে পারেন, ইসলামের ইনসাফের ধারণাই ইসলামের সেকুলারিজম। এভাবে বেদাত, সেকুলারিজম পরিভাষাগুলো ইউনিভার্সাল হয়। এবং এদের পার্টিকুলার প্রেক্ষিতসংলগ্নতা হারায়। বিশ্বজনীতার রাজনীতি আধিপত্য ও বঞ্চনার শর্ত তৈরি করতে পারে।

এক পরিমণ্ডলের পরিভাষা দিয়ে আরেক পরিমণ্ডলকে ব্যাখ্যা করাতে অর্থের হেরফের ঘটবে, বিকৃতিও ঘটতে পারে। আবার দুই পরিমণ্ডলই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, লাভের সম্ভাবনাও আছে। যেমন জীববিজ্ঞানের ডারউইনিজম পদকে সোসাইটি ব্যাখ্যায় ব্যবহার করে সোসাল ডারউইনিজম তত্ত্বের ক্ষতির দিক নিয়ে অনেকেই বলেছেন। আবার জীববিদ্যার আইসোমরফিক মিমিক্রির Isomorphic Mimicry ধারণা অনুন্নত দেশের উন্নত দেশকে হুবহু অনুকরণের ক্ষতি বোঝাতে উন্নয়ন অধ্যায়ন বিদ্যায় বা Development Studies এ লাভজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। তবে কোরআন যখন বলে, জলে-স্থলে যে বিপর্যয় তা মানুষের দুই হাতের কামাই, তখন এই যে মানুষের দুই হাতের কামাই, তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য আপনি নানাবিধ এনালাইটিকাল টুলস ব্যবহার করতে পারেন, বিবিধ শাস্ত্র ইউজ করতে পারেন। তাছাড়া হাদিসে বলা হচ্ছে, জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্পদ। তার মানে, জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট শাখাকে আপনি মানবীয় ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যায় ব্যবহার করতে পারবেন।

তবে এই জ্ঞানীয় লেনাদেনা ইসলাম কিছুটা সতর্কভাবে করে, নিজের আত্মসংরক্ষণের স্বার্থে। ইসলামের অনেক পরিভাষাকে ডিথিওলাইজ করা হচ্ছে। এর ভেতরকার ধর্মীয় অর্থকে নিধর্মীয়ও করা হচ্ছে। জিহাদকে শ্রেণি সংগ্রাম, আখিরাতকে জাগতিক অনাগত ভবিষ্যত, নাজাতকে ইহলোকের মুক্তি, উম্মাহকে মানবজাতি, গায়েব বলতে আনকনসাস, বাজার বা পুঁজির অদৃশ্য হাত ইত্যাদি বহু অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ব্যবহার করছেন তারা ইসলামের ইন্টেলেকচুয়াল হিস্টোরির ভেতরকার মানুষ নন, তারা হয় ইসলামকে দেখেন বেনিয়ামিনের চোখ দিয়ে, কেউ আগাম্বেন বা মার্ক্সের চোখ দিয়ে, কারো ইমাম হয়তো জিজেক। সেক্ষেত্রে ইসলামকেই ডিফ্যামিলিয়ারাইজ করে ফেলা হয়, ইসলামকে আর ইসলাম বলে চেনা যায় না। এগুলা ইসলামের ঐশীত্ব ধসিয়ে দিয়ে ইসলামকে সেকুলারাইজ করার নতুন ফিকির। এই তৈরিকৃত ইসলামকে আপনি গ্রহণ করবেন কিনা সেটা আপনার বিবেচনা।

ইসলামি ক্রিটিক খুব সৃষ্টিশীল কাজ। কিন্তু আমার ধারণা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও আরো কিছু প্রপঞ্চকে ইসলামের `বিশ্ববীক্ষা`র নির্যাস দিয়ে কী করে ব্যাখ্যা করা যায় সেটার বাস্তব নজির আমরা তেমন দেখি না। মনে রাখা দরকার, ইসলাম সব কিছুকে নৈতিক-অনৈতিক এই ফ্রেইমওয়ার্কে দেখে না। সমাজ-রাজনৈতিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করতে ইনসাফ, আখলাক, দায়িত্ব-কর্তব্যের কাঠামো, ইতিহাসবিদ্যা, সম্পর্কের ধারণা, আমাতদারিত্বের ধারণা, ক্ষমা, শাস্তি, বস্তুগত পরিস্থিতি ইত্যাদি বহুবিধ ধারণাকে ব্যবহার করা যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক