ইসলামে দর্শন চিন্তার পটভূমি বিষয়ক কয়েকটি বই নিয়ে আলাপ

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০২৩

ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খানের সদ্য প্রকাশিত ‘ইসলামে দর্শন চিন্তার পটভূমি’র নতুন বোধগম্যতায় আনার কর্মযজ্ঞে নেমে ইসলামি দর্শন বিষয়ক সাম্প্রতিক কালের কিছু কিতাবেও চোখ বোলানোর কৌশিশ করলাম। এর মধ্যে প্রথম কিতাবটি আবদুর রহমান ত্বহার আলাপচারিতা, যার শিরোনাম Language Matters: A  Dialogue on  Language & Logic। ত্বহার মৌলিক দার্শনিক জায়গাগুলো এর সাথে ইসলামি তুরাসের সাথে ওয়াজুদে কসবির পরিসর হিসেবে সম্পৃক্ততা ও মোকাবিলা, আধুনিক মগরিবী দর্শনের ভাষা বিশ্লেষণী ঐতিহ্য ও গাণিতিক যুক্তবিদ্যাকে তিনি কিভাবে তার এপ্রচে একীভূত করেছেন— সেসব বিষয়াদির সাথে উপরোক্ত পাটাতনগুলো তার দর্শনকে যে ঘটনা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, সে ধরনটির সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে উত্থাপিত সু`আলগুলোর জওয়াবসহ সামগ্রিক বিষয়াদির একটি প্রিসাইজ আলাপচারিতা উঠে এসেছে এই ছোট্ট সাক্ষাৎকারের কিতাবটায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিস্থ তাবাহ ফাউন্ডেশন এই সাক্ষাৎকারটির আরবি ও ইরেজি ভার্সন উভয়টাই ছাপাইছে।

এরপরে আসতেছি মাহদি হা`ইরি ইয়াযদির Universal Science: An Introduction to Islamic Metaphysics। এটি ছাপাইছে নেদারল্যান্ডের লাইডেনস্থ মশহুর ছাপাখান ই জে ব্রিল। হা`ইরি ইয়াযদি মোল্লা সাদরার দার্শনিক ভাবধারার মশহুর ইরানি দার্শনিক। তিনি ইরানি বিপ্লবের রাহবার ইমাম খোমেনির সরাসরি তালেব; আবার, হা`ইরি ইয়াযদির পিতা আয়াতুল্লাহ আবদুল করিম আল হা`ইরি ইয়াযদি ইমাম খোমেনির সরাসরি শিক্ষক। ঊনবিংশ ঈসায়ী শতকে খোম শহরকে শি`য়া জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি দরসগাহ হিসেবে ইরাকের নাযাফ শহরের সমকক্ষীয় হিসেবে পূণর্জাগরণ ঘটান।

যাই হোক, মাহদি হা`ইরি ইয়াযদি পার্সি ভাষায় ইলমে কুল্লী নামের কিতাবটি ঊনিশশো পঞ্চাশের দশকে লিখেছিলেন এবং জন ইয়াহিয়া কুপার ইংরেজি তর্জমা করেছেন ওপরে উল্লেখিত শিরোনামে। এই কিতাবটি লিখিত হওয়ার পরপরই মাহদি হা`ইরি ইয়াযদি ইরান ত্যাগ করেন এবং আধুনিক মগরিবী শিক্ষায়তনে মগরিবী দর্শনের হাল-আমলের বাচনগুলোয় রিগোরাস পন্থায় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত হন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক সফরের এই পযার্য়েই লিখিত হইছে আমাদের আজকের পোস্ট সংশ্লিষ্ট তৃতীয় কিতাব, যার শিরোনাম The Principles of Epistemology in Islamic Philosophy: Knowledge by Presence।

ইলমে কুল্লীর প্রি-ফেইচে মাহদি হা`ইরি ইয়াযদি নিজের জন্য একটা সু`আল ছুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, How `is it` possible for man to establish a cognitive (`ilmi) relationship with matters which are outside the realm of the senses? মূলত এই সু`আলের`ই একটি সামগ্রিক অনুসন্ধান হলো The Principles of Epistemology in Islamic Philosophy। এটি ছাপাইছে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ছাপাখানা। আমাদের চতুর্থ কিতাব হলো লিভনাট হলৎসম্যান লিখিত Anthropomorphism in Islam: The Challenge of Traditionalism (700-1350)। জাতে ইয়াহুদি হলৎসম্যান হাম্বলি মযহাবের ভাবধারা বিষয়ে মশহুর গবেষক। এ কিতাবটিতে মূলত সিফাতের হাদিছকে কেন্দ্র করে  উদ্ভূত তাশবিহ সংশ্লিষ্ট সাড়ে সাতশো বছরের বাহাস-মুবাহিসার ওভারভিউ হাজির করা হয়েছে। এটি ছাপাইছে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানা।

এসব কিতাব আমাদের বিবেচনায় দুটি কেন্দ্রীয় সমস্যা সামনে নিয়ে আসে, যে দুটি সমস্যার মীমাংসায় এ জমানার দর্শনচর্চা আরও বর্ধিত অর্থে সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তির পরিসর ধুকছে। এক. সাধারণ অর্থ ঐতিহ্য বা তুরাসের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিছকই কি বুদ্ধি দ্বারা পুনর্গঠনমূলক? আরও বিশ্লেষণ বলা যায়, এ সম্পর্ক নিছকই কি কগনিটিভ বা জ্ঞানীয়? যদি জ্ঞানীয় হয়, তাহলে তা তার স্বরূপ কি হিসেবে দাঁড়াবে? তুরাসকে কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনায় আমার বুদ্ধির মেশিন দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে ফিনিসড গুডস উৎপন্ন করে হাজির করার মামলা কি? নাকি কগনিটিভ বা ইলমি কর্মকাণ্ড নিজেই একটি সম্পর্কের মামলা?

যে কর্মকাণ্ড `আ`লা নাহু কুল্লী বা সার্বজনীন মিমাংসাকে তাৎপর্য দানের ঘটনা না প্রধানত বরং কোন বিষয় সম্পর্কে ইলম বা জ্ঞান হল ইয়াত্ত্বাবিয়ুল মা`লুম অর্থাৎ বিষয়ের সাথে সম্পর্ক জনিত বিশেষ দশা বা হাল (হাল ইদাফি"য়্যা)। আধুনিক পা`ইদিয়্যা বা ভ্যালু ব্যবস্হার ছায়াতলে বেড়ে উঠা লোকজন তুরাস অধ্যয়ন`কে স্রেফ বুদ্ধি দ্বারা পুনর্গঠনের মামলা হিসেবে নিতে গিয়া ইলমের স্বরূপ গঠিত এ সু`আলের দিকে যাওয়ার পদ্ধতিগত ঘটনা গাঠনিকভাবে ধরতেই পারেন নাই। ফলে আমাদের তথাকথিত `নিধর্মীকরণ` নিয়া হাজির হইতে হয় কিংবা নার্সিসিসটিকলি বলতে হয়, এ বিষয়ে আমি এ রকম মনে করি।

আমাদের দুই ও তৃতীয় নাম্বার কিতাবে ইলম`কে সম্পর্ক হিসেবে তাৎপর্য দানের এ আলোচিত ঘটনাই হাজির আছে। এ সমস্যাটির একটা সূত্রায়ন হইছে জিন হিপোলিটের হাতে হেগেলীয় দর্শনের সাথে ফেনমেনলজির সম্পর্কের আলাপে; হিপোলিট সু`আল তুলেছেন, How does the passage from the phenomenology to absolute knowledge work? এক্ষেত্রে ইন্দ্রীয়গঠিত অভিজ্ঞতার বয়ান এবং ওয়াজুদের বয়ান পরস্পর পরস্পর মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগের ভাব থেকে একটি আরেকটিকে নিজেদের সূত্রায়নে প্রি-সাপোজ করে বলে হিপোলিট উল্লেখ করেছেন।

দুই. তুরাসের সাথে সম্পর্কজনিত ঘটনা তৈয়ার হওয়ার পরও দেখা যায় ইলমের পরিসরে, ইতিহাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাজনিত যে ভাঙন তা থেকে ইস্তেনবাতের শর্তে প্রত্যাবর্তন করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভবপর হয় না। যেমন, ইলমে কুল্লীর ইংরেজি তর্জমার সম্পাদক দ্যা শি`য়া ইনস্টিটিউটের তরফে তার সম্পাদকীয় মুকদ্দমায় বলছেন, Shi`ah Islam...wholeheartedly rejected the anti-intellectualism of groups such as the literal-minded `Hadith-folk` (Ahl al-Hadith) whose most prominent figure was Ahmad ibn Hanbal...and Ash`arism, which was founded by Abu al-Hasan al-Ash`ari...who came under the influence of Ibn Hanbal and which had much common with William of Ockham. Ash`arism was further championed by al-Ghazali who repudiated philosophy and in the end bequeathed a soporific, anti-intellectual, and irrational Sufi thought to Islamic posterity.... Sunni Islam has followed a very similar path.

সুন্নী দুনিয়ায় সংগঠিত পোস্ট-ইসলামি বুদ্ধবৃত্তিক উৎকর্ষতা নিয়ে সাম্প্রতিককালে গোটা দুনিয়ার বিদ্যায়তনগুলোয় হাজার হাজার গবেষণা সত্ত্বেও এই ২০২৩ এসে ইলমে কুল্লীর সম্পাদক হিসেবে সাইয়িদ নিজামুদ্দিন আহমাদকে এসব পুরাতন প্রাচ্যবাদী ছাইপাঁশ নতুন করে উগড়ে দিতে হচ্ছে। তাই শুধুই তুরাসের সাথে সম্পর্ক`ই যথেষ্ট নয়। এই হালকে সুসংবদ্ধ ও সুসংগঠিত উপায়ে মূল্যায়ন ও পুনর্গঠনের এনডেমিক তরিকা এস্তেমাল করতে হবে। এক্ষেত্রে আমদানি করা (নকল)  এবং জবরদস্তি করে হাজির থাকা (দখল) পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ব্যাপক বুঝাপড়া লাগবে। এ সময়ের ইলমি পরিসর যে দ্বিতীয় সু`আলে ধুঁকছে তা হলো. মগলুবুল হালকে অতিক্রম করে যাওয়ার তরিকা কেমন হবে?

আমাদের চতুর্থ কিতাবে সিফাতের হাদীসকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত `আল্লাহর উপর মানবীয় গুণাবলী আরোপ` বা তাশবিহ সংশ্লিষ্ট বাহাস-মুবাহিসার একটি চমৎকার ও বুনিয়াদি ওভারভিউ হাজির করলেও শুধুমাত্র একটি যথাযথ থিওরিটিক্যাল লেন্স বা তরিকা এস্তেমালের অভাবহেতু লিবনাট হলৎসম্যান এ দীর্ঘ সময়ের বাহাস-মুবাহিসাকে tell a story ন্যারেটিভে ন্যুনীকৃত করেছেন, যেখানে আবার জাল হাদীছকে নির্দেশ করার জন্য fictional narration ও imagination বর্গ আরোপ করেন এবং জাীবন্ত ইতিহাসে এর ক্রিয়াশীলতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

এ তরিকা হাদীছ অধ্যয়নের জন্য তার টেক্সট্যুয়াল ঐতিহ্যের সাথে মৌলিকভাবে সম্পর্কিত না এবং এমন একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর থেকে এটা আমদানি করা হয়েছে, যা উলুমুল হাদীছের সাথে কো-হেরেন্ট না এবং এর পদ্ধতিগত ধাপগুলো উলুমুল হাদীছের আওতায় ক্রিটিকলি রিভিউ করা হয় নাই। ফলে পদ্ধতিগত অর্থে এ আমদানি করা তরিকা হাদীছ অধ্যয়নের লজিক্যাল রিকয়ারমেন্ট মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তুরাসের সাথে সম্পর্কজনিত অবস্থাকে মূল্যায়ন ও পুনর্গঠনের তরিকা বিষয়ে খুব দরকারি আলাপ এসেছে আমাদের পোস্ট উল্লেখিত প্রথম কিতাবে।

এখন একটা দরকারি উপসংহার। লিবনাট হলৎসম্যানের কিতাবে এস্তেমাল করা হাদীছের মতন ও এর ইতিহাস অধ্যয়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা থেকে আসা সু`আল এবং ত্বহার আলাপ থেকে উঠে আসা আমদানী ও জবরদস্তি করে হাজির পদ্ধতিগুলোর পদ্ধতিগত অনুপযোগীতা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে মুঈন স্যার কর্তৃক তার ‘ইসলামে দর্শন চিন্তার পটভূমি’তে কালাম শাস্ত্রের মূল প্রবচনগুলোর আলাপে হাদীছকে সম্পর্কিত করার জন্য যে কর্মপন্থার আনজাম দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে এ তরিকা উল্লেখিত বিষয়-আশয়ের মীমাংসায় আমাদের সম্ভাব্য একটা দিশা হতে পারে।

একুশে বইমেলা ২০১৮