ইসলামের মূল্যবোধ এবং টিএসসিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : এপ্রিল ২০, ২০২২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), যা ছিল ছাত্র অবস্থায় এবং তার পরে বহু বছর আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার বলয়। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সভা সমিতি আর নানা অনুষ্ঠানের জন্যই করা। পরে সেটা আরো বিস্তৃত হয়েছিল। সেটা কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ের জায়গা কখনো ছিল না। থাকবার কথাও নয়। সব জায়গার একটা সৌন্দর্য আছে, সব জায়গার একটা নিজস্বতা আছে। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে যারা নামাজের জন্য জায়গা চেয়েছেন, মসজিদ বানাবার কথা বলছেন; তারা কীসের ভিত্তিতে বলছেন, আমি বুঝতেই পারছি না। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র তো কারো প্রার্থনা করার জায়গা বা উপাসনালায় নয়। প্রত্যেক্যেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেটার কতগুলি বিধান আছে। ধর্ম পালন করার জন্য যার তার জায়গা দখল করে প্রার্থনাঘর বা উপাসনালয় বানানো যাবে না। বিশ্বের কোনো ধর্মেরই এমন বিধান নেই।

ধরা যাক, একজন মানুষ তার বাড়িতে আমাকে কিছুদিন থাকতে দিয়েছেন, আমি কি নামাজ পড়ার জন্য তাকে মসজিদ বানাতে বাধ্য করতে পারি? বা ভিন্ন কেউ তার উপাসনালয় বানাবার দাবি করতে পারেন? তাহলে তো যার তার বাড়ি ঘর দখল করে মসজিদ বানানো শুরু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা চার পাঁচ বছরের জন্য পড়াশুনা করতে এসেছেন। পড়াশুনার সুবিধার জন্য তারা বহু কিছু দাবি করতে পারেন। মসজিদ বানানো বা মন্দির বানানো নিয়ে তাদের বলার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রীয় নকশা আছে, সে অনুযায়ী সকল স্থাপনা হবে। কতিপয়ের স্বার্থে সে নকশা পাল্টানো যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা জাতির স্বার্থে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসেছেন, তাদের সাধারণ এই বিষয়টা বুঝতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে না হবে সেটা যেমন শিক্ষার্থীরা ঠিক করবেন না, ঠিক একইভাবে শিক্ষার্থীরা সকল বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন না।

খুব মনে আছে, আশির দশকে পল্লবীতে একটি পাঁচ কাঠার খালি একখণ্ড জমি ছিল, আমরা যেখানে থাকতাম তার পাশেই। সে জমির মালিক কে জানতাম না। একদিন এক ব্যক্তি যাকে দেখে মনে হতে পারে খুব ধর্মপ্রাণ, তিনি কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে আমাদের বাসায় আব্বার সঙ্গে কথা বলতে এলেন। প্রথম তিনি আব্বাকে ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান দিলেন। কিছু পরে তিনি বললেন, ইসলামের খেদমত করার জন্য তিনি পাশের খালি পরে থাকা জমিতে একটি মাদ্রাসা এবং মসজিদ করতে চান। আব্বা সরকারি চাকরি করতেন আর সেই সুবাদে জমিজমা এসবও বিষয়ে তার যথেষ্ট দখল ছিল। তিনি বললেন, আপনি কার জমিতে মসজিদ করবেন? জমির মালিক কি আপনাকে মসজিদ করার অনুমতি দিয়েছেন? তিনি প্রথম একটু বিব্রত হলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, জমিটা খালি পরে আছে, ইসলামের খেদমতে লাগতো। সন্দেহ নেই যে, আব্বা যথেষ্ট ধর্মকর্ম করতেন। কিন্তু তার জমি দখলের কথায় খুবই বিরক্ত হলেন। বাধ্য হয়ে তাকে ধর্ম সম্পর্কে এমন জ্ঞান দিলেন যে, তিনি আর কখনো এ বিষয়ে কথা বলতে আসেননি। কখনো সেখানে আর মসজিদ হয়নি।

ইসলাম সব জায়গায় মসজিদ বানাতে বলেনি। তাহলে বিশ্বে যখন মুসলিমদের রাজত্ব ছিল তখন শুধু মসজিদই তৈরি করা হতো। দিল্লীর বিরাট লালকেল্লায় মসজিদ তো একটি। মুসলমান শাসকরা চাইলে মসজিদ দিয়ে ভরে ফেলতে পারতন লালকেল্লা। সবচেয়ে বড় কথা, তখন মুঘলদের বহু দুর্গে মন্দির পর্যন্ত ছিল। কারণ মুঘলরা যে রাজপুত বা হিন্দু রমণীদের বিয়ে করতেন, তারা বা তাদের সঙ্গীরা চাইলে পূজা করতে পারতেন। ঔরঙ্গাবাদে মুঘল দুর্গের যে ধ্বংসাবশেষ আছে সেখানে মানুষজন থাকে না বললেই চলে। পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখি, ভাঙা দালানগুলির মধ্যে একটি ছোট মন্দির। মন্দিরের লোকরাই বললেন, এটা সেই মুঘলদের আমল থেকেই। সেটাকে তাঁরা কয়েকজন এখনো ধরে রেখেছেন। মুঘল শাসকরা ভারতবর্ষে শুধু মসজিদ করেননি, বহু মন্দির করেছেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দুর্নাম দেওয়া হয়েছে যে, তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি মন্দিরকে জমি দিয়েছেন আর টাকা বরাদ্দ করেছেন। সবচেয়ে বেশি হিন্দু অমাত্য ছিল সম্রাট আলমগীরেরই। বহু মানুষ তখন যেখানে সেখানে মন্দির বানিয়ে একটা ব্যবসা করার কায়দা বের করেছিল, সেজন্য তিনি বহু ক্ষেত্রেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেননি। এই সব কারণে তাকে বলা হয় হিন্দু বিদ্বেষী।

প্রয়োজনে তিনি যে মসজিদও ভেঙেছেন, সে খবরটা অনেকে রাখেন না। বিরাট সাম্রাজ্য্যের সম্রাট ছিলেন তিনি। কিন্তু ঔরঙ্গাবাদে রাস্তার পাশে মানুষটির আছে একটি সাধারণ কবর। নিজেই তিনি সেরকম নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। ভিন্ন দিকে সেই শহরে আছে তার স্ত্রীর বিরাট সমাধি ‘বিবিকা মকবরা’। বিবিকা মকবরা অনেকটাই তাজমহলের নকশার অনুকরণে, আলমগীরের সন্তান তা নির্মাণ করেছিলেন মায়ের কবরে।

সবকিছুকে ধর্ম প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলা যায় না। যেখানে সেখানে উপসনালয় বানানো চলে না। বিশ্বের প্রতি ইঞ্চি জমি ধর্ম প্রতিষ্ঠান বানাবার জন্য নয়। ধর্ম পালন করার জন্য তার দরকারও হয় না। যদি দরকার হতো, তাহলে সকল ধর্মের পয়গম্বররা সে কথা লিখে রেখে যেতেন। বাংলাদেশের একজন মুসলিম-কৃষক জমি চাষ করতে করতে নামাজ পড়ার কথা ভাবতেই পারেন। তিনি চাষের সেই বিশাল জমিতে চাইলে কখনো সখনো নামাজ পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু তিনি নামাজ পড়বার জন্য সেই চাষাবাদের ভূমিতে মসজিদ বানাবার পরিকল্পনা করতে পারেন না বা জমির মালিকের কাছে আব্দার করতে পারেন না, তার নামাজ পড়ার জন্য সেখানে একটা মসজিদ বানিয়ে দিতে। প্রার্থনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ, মসজিদ বানানোটা নয়। ইসলাম ধর্মে মানুষ নামাজের সময়ে যে কোনো জায়গায় নামাজ পড়তে পারেন। কলকাতায় আমার এক চিকিৎসক বন্ধু আছেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। নাম শুনলেই বোঝা যায়, তিনি ব্রাহ্মণ। তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে মাথা ঘামান না। কলকাতায় গেলে অনেক সময় তার বাড়িতে একটি কক্ষে আমি থাকি। সেই কক্ষে সাজিয়ে রাখার জন্য কয়েকটি ছোট ছোট মূর্তি আছে। বাংলাদেশের একজন মুসলিম মহিলা সেই কক্ষে কয়েকদিন ছিলেন। সেই কক্ষেই তিনি নামাজ পড়তেন।

কখনো আমার বন্ধুরা তার এই ধর্ম পালনে সামান্য প্রশ্ন তোলেনি। যিনি নামাজ পড়তেন তিনিও ভাবতে যাননি, সেখানে মূর্তি আছে সেখানে নামাজ হবে কিনা। তিনি যদি তার নামাজ আদায়ের জন্য আমার সেই বন্ধুকে বলতেন মূর্তিগুলি সেই ঘর থেকে সরিয়ে দিতে বা কক্ষটাকে তার প্রার্থনা ঘর বানিয়ে দিতে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াতো?

বিধর্মীদের ঘরে বসে নামাজ হবে না, এমন কথা বলা আছে কোথাও? বিধর্মীদের দেশেও তাহলে নামাজ হবে না। প্রচুর মন্দির আর মূর্তি আছে এমন জায়গায় নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেলে একজন ধার্মিক মুসলিম কী করবেন? স্রষ্টা যদি একজনই হন, সকল মানুষের সৃষ্টি তিনিই করেছেন। কথাটা কি ঠিক নয়, মানুষটি যে ধর্মের হোক সৃষ্টিকর্তা তো একজনই। ভারতের একটি খবরের কাগজে দেখেছিলাম, বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মহররমের তাজিয়ার অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন একটি পুরানো হিন্দু জমিদার পরিবার। উৎসব করছেন সেখানে হিন্দু-মুসলমান দুপক্ষই। মনকে প্রসারিত করা দরকার সব ক্ষেত্রে। বহু সঙ্কটের সমাধান তাহলেই হতে পারে। কেরালাতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল কয়েক বছর আগে, বহুদিন পানির নিচে ছিল অনেক এলাকা। যেখানে বন্যা হয়েছিল সেখানকার প্রায় সব মসজিদ, মন্দির, ঘরবাড়ি ডুবে গিয়েছিল। খবরের কাগজে তখন দেখেছিলাম, একটি মন্দির সম্পূর্ণ পানি নিচের ডুবে যায়নি। সেই মন্দিরের পুরেহিতের আমন্ত্রণে মুসলমানরা মন্দিরের বারান্দায় নামাজ আদায় করছেন। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরেই দেখা যাচ্ছে দেবদেবীর মূর্তি। দু-পক্ষই মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। দুপক্ষই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি মুসলমানরা দাবি করে বসেন, যেহেতু সেখানে তাঁরা নামাজ আদায় করেছেন সেটাকে মসজিদ বানিয়ে দেয়া হোক তাহলে কেমন হবে?

বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের নামে বহু কিছু করা হয়, যা বহু মুসলিম দেশে করা সম্ভব নয়। এমনকি ইসলামের জন্মভূমি খোদ সৌদি আরবেও করা যাবে না। বাংলাদেশে নামাজের জন্য ইচ্ছামতো যখন তখন রাস্তা আটকে দিয়ে জনগণের ভোগান্তি বাড়ানো হয়। সেটা কি সম্ভব হবে সৌদি আরবে? ঢাকায় যেখানে আমি বাস করি তার সামনে রাস্তার অপর পাশে একটি মসজিদ আছে। শুক্রবার নামাজের সময় বা প্রথম কদিন তারাবি নামাজের সময়ে ইচ্ছামতো মসজিদ সংলগ্ন রাস্তা আটকে নামাজ আদায় করা হয়। ফলে আমরা অনেকেই বাইরে থেকে নিজের ঘরে প্রবেশ করতে পারি না, বহুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেইদিন বহু পরিকল্পনা করতে হয় আমাদের নামাজের সময়ের ওপর নির্ভর করে? এসব কি ইসলামে আছে? যদি সত্যিই ইসলাম হয় শান্তির ধর্ম, সহনশীলতার ধর্ম, তুলনামূলক উদারতার ধর্ম; তাহলে ইসলামের সেই আদর্শ কি আমরা রক্ষা করছি? আমাদের অনেক আচরণ ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই মানুষ ইসলাম ধর্মকে ভুল বোঝে। রমজান মাসে জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়া, এটা কি ইসলামে আছে? কিন্তু এতে মানুষ দিনের শেষে ইসলাম ধর্মকেই ভুল বুঝে। ইসলামে কোথাও নেই, সর্বত্র মসজিদ বানাতেই হবে। নামাজ আদায় করা দরকার হলেও নয়। সেই বিষয়ে ইসলামের একজন মহান পুরুষের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

মুসলমানরা জেরুজালেম অবরোধ করে রেখেছে। ছয় মাস অবরোধ করে রাখার পর নগরকর্তা সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। শর্ত দেন হয়রত উমরকে আসতে হবে, খ্রিস্টানরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। যখন উমর জাঁকজমক ছাড়া উপস্থিত হলেন, সোফ্রেনিয়াস অবাক হয়েছিলেন। তিনি আত্মসমর্পণের পর হযরত উমরকে ঘুরিয়ে দেখালেন পবিত্র শহরটিকে। যখন নামাজের সময় হলো, উমর নামাজ পড়তে চাইলেন। মসজিদ সেখানে ছিল না। পরাজিত নগরকর্তা সোফ্রেনিয়াস তাই তাঁকে চার্চে নামাজ পড়তে বললেন। হযরত উমর বললেন, কারো মন্দির বা গির্জাকে মসজিদ বানানো ইসলাম বিশ্বাস করে না। যদি তিনি এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে মুসলমানরা পরে চার্চটিকে ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। সেরকম কিছু ঘটুক তিনি চান না। এতে করে খ্রিস্টানরা তার নিজের পবিত্র স্থান হারাবে। খ্রিস্টানদের শাসনামলে জেরুজালেম থেকে তাড়িয়ে দেয়া ইহুদিদেরকে পর্যন্ত হযরত উমর তাদের পবিত্র ভূমিতে ফিরে আসার অনুমতি দেন। ইসলাম ধর্মে এ কথা স্পষ্টই বলা আছে, ‘যার যার ধর্ম তার তার কাছে’। প্রত্যেক ধর্মকে সম্মান দেখানো ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ইসলাম তার শুরুতে এরকম সহনশীলতার মধ্য দিয়ে যাত্রা আরম্ভ করেছিল, পাশাপাশি বহাল রাখা হয়েছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা। সে কারণেই ইসলাম তখন প্রসার লাভ করেছিল। ইসলামে জোবরদস্তি নেই, পরাজিত শক্তিকে বা কাউকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার বিধান নেই। পরাজিত শক্তি নিজ ধর্ম বজায় রাখতে চাইলে তাঁকে জিজিয়া কর দিতে হবে। জিজিয়া কর মানে, রাষ্ট্রে তার নিরাপত্তা কর। মুসলিমরা দিতেন জাকাত। জিজিয়া কর সবার জন্য প্রযোজ্য ছিল না। যখন মুহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু জয় করেন, তিনি সেখানে জিজিয়া কর চালু করেন। কিন্তু নারী, দরিদ্র মানুষ এবং পুরোহিতদের উপর জিজিয়া কর ধরা হয়নি। স্বচ্ছল এবং ধনীরাই এই কর দিতেন। ইসলামের সেই দিনগুলি ছিল সহনশীলতার, বিজয়ের আর সারা বিশ্বের সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করার। যখন দ্বাদশ একাদশ সালে মুসলমানরা উদারতা আর মুক্তচিন্তা হারিয়ে রক্ষণশীল হতে শুরু করে, মুসলমানদের পতন আরম্ভ হয়। স্মরণ রাখতে হবে, দ্বিতীয় মুহাম্মদ যখন ১৪৫৩ সালে কনস্টানটিনোপল দখল করেন, তিনি খ্রিস্টানদের গির্জা হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেন। গির্জার দেয়ালের খ্রিস্টের ছবি গুলি সিমেন্টের নিচে চাপা পড়ে যায়। ইসলামের প্রথম যুগের মহান পুরুষদের মতো উদারতা দেখাতে পারেনি সেই সময়ের উসমানী শাসকরা। পরে কামাল পাশা ধর্মীয় সহনশীলতা দেখাতে সেটাকে মসজিদ না রেখে জাদুঘর বানিয়েছিলেন। সেটাকে আবার কিছুদিন আগে মসজিদ বানানো হয়েছে। তাতে করে সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটা মধ্যে যে উদারতা নেই সেটা উদার মানুষরা বুঝতে পেরেছে। বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা সবসময় খারাপ। ইসলামের নবী বারবার বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না।

ইসলাম ধর্ম মানে তার আছে বিরাট ঐতিহ্য। বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানকে বহু কিছু দিয়েছে ইসলাম। সকল ধর্মেরই নানা রকম ঐতিহ্য আছে। মুসলমানদের মস্ত বড় অবদান হলো, খ্রিস্টান চার্চ যখন গ্রীস-রোমের জ্ঞানবিজ্ঞান ধ্বংস করছিল, মুসলমানরা তা সংরক্ষণ করেন। মুসলমানরা তখন সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্নরকম সংস্কৃতি আর জ্ঞান আহরণ করেছেন। সেই জন্যই মুসলমানদের সংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রেই ছিল খুবই উন্নত। কূপমণ্ডুক হয়ে পড়ার কারণে সেটা আর এখন নেই। নেই আগের সহনশীলতা। ইসলাম ধর্ম যার কারণে তার প্রথম দিকের সেই মহত্ব রক্ষা করতে পারছে না। মুম্বাইতে উনিশশো তেত্রিশ সালের ছাব্বিশে নভেম্বর ‘পয়গম্বর দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে এক জনসভা হয়। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি মির্জা আলী আকবর। রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় একটি বাণী পাঠান। বাণীটি পাঠ করেন, সেকালের বিখ্যাত কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু। বাণীটির মূল কথা ছিলো: ‘জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুগামীদের দায়িত্ব তাই বিপুল। মুসলমানদের মনে রাখা দরকার, ধর্মবিশ্বাসের মহত্ব আর গভীরতা যেন তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ছাপ রেখে যায়।’

হযরত মুহাম্মাদের (স.) জন্মদিন উপলক্ষে ১৯৩৪ সালে কলকাতার বিখ্যাত ব্যারিস্টার স্যার আবদুল্লাহ সুহরাওয়ার্দি কিছু লিখে পাঠাবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠান, ‘ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে তাঁর অনুবর্তীগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁদের সাক্ষ্য দিতে হবে। ...আজকের এই পুণ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুসলিম ভাইদের সঙ্গে একযোগে মহান ঋষির উদ্দেশ্যে আমার ভক্তি উপহার অর্পণ করে উৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁর আশীর্বাদ কামনা করি।’ নয়া দিল্লী জামে মসজিদ প্রকাশিত পয়গম্বর সংখ্যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সালের সাতাশে ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। সেই বার্তায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যিনি বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হযরত মুহম্মদের উদ্দেশ্যে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে নতুন, সম্ভাবনাময় জীবনীশক্তির সঞ্চার করেছিলেন পয়গম্বর হযরত, তিনি এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যাঁরা অনুসরণ করছেন, আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তাঁরা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইসলামের মহত্ব নিয়ে যা লিখেছেন, যা আশা করেছেন ইসলামের নবীর অনুসারীদের কাছে, সেটাই তো সকলে আশা করেন তাঁদের কাছে। স্বার্থান্বেষীরা ইসলামের মহত্বকে অনেক সময়ই তাদের কাজ দ্বারা প্রশ্নবোধক করে ফেলেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ