একটা বন্ধ্যা যুগে ও ভূখণ্ডে আছি আমরা

মিনহাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০

অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র দত্তের ‘মধ্যযুগ থেকে ইউরোপে আধুনিকতায় উত্তরণ’ বইটি পড়লাম। নেহাত কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপক সে। ৭২০+ পৃষ্ঠার একটি মোটামুটি দীর্ঘ ইউরোপীয় মধ্যযুগের ইতিহাস লিখেছেন, মানে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক বা শিল্প বিপ্লবের যুগের যে উত্তরণের ইতিহাস। বইটি নিয়ে আমার বলার কিছু নাই, অত্যন্ত সমৃদ্ধ বই এবং লেখকের পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনোপ্রকার প্রশ্ন নেই নিঃসন্দেহে।

ইএইচ কারের মতে, নির্মলচন্দ্রের ও ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্য আছে। আমি সেই উদ্দেশ্য কিংবা আদর্শ তা নিয়ে বলবো না। বরং, আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম, বইটি পড়তে পড়তে আমার প্রচুর ইন্টারনেটের সহায়তা নিতে হয়েছে। উনি প্রচুর পরিমাণ বই ও লেখক এবং ইতিহাসবিদ, দার্শনিকদের রেফারেন্স দিয়েছেন। আমি মোটামুটি সবারই ইন্টারনেটে সার্চ করে পরিচয় পেলাম, কয়েকজনকে আগে থেকেও চিনতাম।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আমি একজন লেখকের বইও পাই নাই যার বইটি ইংরেজির অনুবাদ নাই। নির্মলচন্দ্রের বইতে মাঝামাঝি অংশে শুধু ইতালির রেনেসাঁস যুগ নিয়ে একশো পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ আছে। আমি দেখলাম, ওই প্রবন্ধে যে কয়জন লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, ধর্মতাত্ত্বিকের নাম নিয়েছেন এবং বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন প্রত্যেকেই ইতালীয়, তিন-চারজন ফরাসি।

আরও মজার বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকের প্রত্যেকটা বই ইংরেজিতে অনূদিত এবং তাও ১৮-১৯ শতকের মধ্যেই হয়েছে। আমি কতক্ষণ চিন্তা করলাম, যে ইংরেজি ভাষা ১৮৬০ এর দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্সটিটিউশনালি চর্চা হতো এবং বিস্তর লেখালেখি শুরু হলো, এর আগে তেমন ছিল না। ১৮ শতক পর্যন্ত মোটামোটা ল্যাটিন দাপ্তরিক ও ফরাসি কূটনৈতিক ভাষাই ছিল বলা চলে। কিন্তু সেই সময়গুলো ইংরেজিতে ওই সকল ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্য অনূদিত হয়েছিল।

আমি খেয়াল করলাম, হেন কোনো পুস্তক নাই যার ইংরেজি অনুবাদ নাই এবং যথেষ্ট সমৃদ্ধ, তা অল্প একটু পড়লেই বুঝা যায়। আমার আসলে হাসি দেয়া ছাড়া আর উপায় রইলো না। গ্রেট বৃটেন কিংবা ইউরোপ বিদ্বেষী আমি কখনোই নই। আমি উপনিবেশবাদের কট্টোর বিরোধী। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেন অর্থাৎ ইংল্যান্ডের লোকজনের এই যে অনুবাদ সংস্কৃতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এটাই যথেষ্ট ছিল, তাদের দরকার ছিল না উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করার।

আমার এক শ্রদ্ধেয় বন্ধু একটা কথা বলতো প্রায়শই, ‘বৃটেন হয়তো চুরি করেছে, করে নিজের ঘর সাজিয়েছে, উন্নত করেছে, আর আমরা নিজের ঘর থেকে নিজেরাই চুরি করে অন্য জায়গায় তা ফেলে আসছি।’ ইংরেজি ভাষা কিংবা এই যে ইংরেজি অনুবাদের শত শত বছরের সাংগঠনিকভাবে যে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতিই ইংরেজির প্রতি গোটা দুনিয়াকে ‘ইন্টেলেকচুয়ালি ঋণী’ করেছে। অনুবাদ সংস্কৃতির উপর একটা ইতিহাস যদি কেউ কখনো লেখে সেখানে আরবরা হয়তো দুই নম্বরে থাকবে। কারণ ইংরেজরা আরবদেরকে অতিক্রম করে ফেলেছে বহু আগেই।

ইংরেজি ভাষায় বর্তমানে খুব কম বিষয়ই আছে যা অনূদিত হয়নি। কিভাবে সম্ভব? এর উপর গবেষণা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। রেনেসাঁ যুগের যে সাংস্কৃতিক ও শিল্পের বিপ্লব তা ইংরেজদের কমই প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তারা প্রভাবিত কম হতে পারে তবে নাক সিটকায়নি। যার ফলে রেনেসাঁস সংস্কৃতি তাদের ধার করতে হয়নি। কিন্তু সেই যুগের চিন্তাকে তারা নিজেদের ভিতর দিয়ে নিয়ে আলাদা রূপ দিয়ে করেছিল সমৃদ্ধ। আমি ইংরেজদের বা গ্রেট বৃটেনের সমালোচনা করি সর্বদাই। কিন্তু এই বিষয়গুলোতে ইংরেজি জাতি কিভাবে এত অগ্রসর হলো, তা মাথায় আসে না।

আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজরা এত অগ্রসর হয়েছে। অনেকে বলবে, কলোনিয়ালিজম ইংরেজদের এত ইন্টেলেকচুয়াল হতে হেল্প করেছে। আমি বরং বলবো, তার ইউরোপীয় ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। কারণ ১৫ শতক থেকে শুরু করে ১৭ শতক পর্যন্ত ইউরোপে এবং সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে বড় উপনিবেশিক দেশ ছিল স্পেন। গোটা উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ পূর্ব আমেরিকা, পূর্ব আফ্রিকা, উত্তর ইউরোপ তাদের অধীনে ছিল। পূর্ব ইউরোপের বল্টিক রাষ্ট্রগুলো ছাড়া, আর বাকি অধিকাংশ দেশ এবং মধ্য এশিয়া (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান বা প্রাশিয়া, উত্তর ইতালীয় বাদে), তাদের অধীনে, এমনকি ওই সময়ের পবিত্র রোমান সম্রাটও ছিল দ্বিতীয় ফিলিপ (রাজা পঞ্চম চার্লসের পুত্র)।

কই স্পেন তো ইন্টেলেকচুয়ালি এত অগ্রসর হতে পারেনি ইংরেজদের মতো। ১৫০ বছরের স্পেনীয় সাম্রাজ্য ছিল, কিছুই তো করতে পারেনি তারা। রেনেসাঁর উপর তারা নাক সিটকিয়ে ছিল, তার প্রমাণ রাফায়েলের মতো শিল্পীরা সেই সুদূর ফ্লোরেন্সে যেত চিত্রশিল্পে শিক্ষিত হতে মিকাইল অ্যাঞ্জলের মতো শিল্পীদের কাছে। ইতিহাসকে পার্টিকুলারলি দেখার আসলে সীমাবদ্ধতা হেগেল দেখিয়েছেন। ইএইচ কার বা জ্যাকব বুকহার্টের মতো ঐতিহাসিকরাও দেখিয়েছেন যে, ইতিহাস কোনো পার্টিকুলার বিষয় না। সে অ্যাজ আ হোল অগ্রসর হয়, অগ্রসরতার মধ্য দিয়ে রেশনালিটি রিয়েলিটিতে মিলিত হয়।

আপনারা বেশি বেশি করে ইতিহাস পাঠ করুন। ইতিহাস মানেই অতীত নয়। অতীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইতিহাসবিদ্যার সূত্রপাত। আমাদের দেশে তো ইতিহাস চর্চার নামে খবরের কাগজ চর্চা করা হয়। গ্রীসের ইতিহাস লেখা হয় মাত্র দুশো পৃষ্ঠায়। তুর্কির ইতিহাস লেখা হয় মাত্র ১৮০ পৃষ্ঠায়, তিনশো পৃষ্ঠায় ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখা হয়! এটা তো ইতিহাস নয়, এগুলা বরং সংক্ষিপ্ত নোট। এদের উচিত প্রেমপত্র বা রোমান্টিক গল্প লেখা উচিত, ইতিহাস নয়। আজ পর্যন্ত কোনো আরব ইতিহাসবিদের বই বাংলায় পেলাম না, যা সন্তুষ্টজনক। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে বাংলায় ভালো কোনো বই নাই।

কী একটা বন্ধ্যা যুগে ও ভূখণ্ডে আছি আমরা! আমি বলি কি, দরকার নাই ইতিহাস লেখার। ফরাসি দেশের ইতিহাস লেখার দরকার নাই, বরং ফরাসি ইতিহাসবিদ জুলে মিশ্যেলের ‘হিস্ট্রি অব ফ্রান্স’ অনুবাদ হোক, এটাই অনেক। শিক্ষার্থীরা পড়ুক ইউরোপীয় ইতিহাস, ইউরোপীয় ইতিহাসবিদের লেখাতেই পড়ুক। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। খুবই কঠিন একটা সময় পার করছি আমরা, বন্ধ্যা যুগ ও খরার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। জানি না এর কোনো শেষ বিন্দু আছে কিনা। জার্মান ইহুদি দার্শনিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন, অবক্ষয়ের যুগ বলতে কিছু নেই, অবক্ষয়ের যুগ মানে তা নতুন কোনো যুগ আসার প্রারম্ভিক বেদনা।’

মানে গর্ভধারী মহিলার যে প্রসববেদনা, অনেকটা সেরকমই। কিন্তু কথা হলো, সেই জননী কে? কারাই বা সেই নতুন যুগের ভিত্তি গড়ার মজদুর?