একটি আত্মহত্যা ও আমার শেষ প্রেম

লতিফ জোয়ার্দার

প্রকাশিত : মে ১৯, ২০২০

শেষবার যখন প্রেমে পড়েছিলাম তখন আমার বয়স বিয়াল্লিশ বছর। আর যার প্রেমে পড়েছিলাম সে ততটা সুন্দরীও ছিল না। তবে কেন কী কারণে তার প্রতি আমার এই ভালোলাগা। কেন কী কারণে তার প্রতি আমার এই ভালোবাসা! এই ভাবনাগুলো কখনো কোনোদিন ছিল না আমার। এক প্রকার ভেবেই নিয়েছিলাম, এ সবই আমার পাগলামি। তাই তার কাছে থেকেও দূরে থেকেছি বারবার। হয়তো সে বিষয়টা বুঝেছিল। তাই হয়তো তার ব্যকুলতা অনুভবে ছিল আমার। কিন্তু আমার এই ভালোলাগা কখনো তার কাছে প্রকাশ করেনি আমি। আমি আমার মনের বিরুদ্ধে তাকে দূরে রাখতে চেয়েছি বারবার। কিন্তু আমাদের অভিমানগুলোর স্থায়িত্ব খুব কম সময়ের ছিল। সে দ্রুত মেনেজ করে ফেলতো আবার। হয়তো আমার জন্যেও তার বুকের অধরে রক্তক্ষরণ ছিলো। হয়তো আমার জন্য তার বুকে মায়াবী কোনো একরাত লুকিয়ে কেঁদেছিল একদিন।

এখন আমার বয়স পঞ্চাশ। আর বর্ণার বয়স বিয়াল্লিশ। বর্ণা তার প্রকৃত নাম নয়। গল্পের প্রয়োজনে এই নামটিই মনে করুন তার আসল নাম। অথবা পাঠক ইচ্ছে করলে অন্য যে কোনো নামেও তাকে ডাকতে পারেন। আমাদের ছোট্ট এই জীবনের জন্য আট বছর দীর্ঘ সময়। এই আট বছরে অসংখ্যবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। ফোনে কথা হয়েছে। একসাথে আমরা দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ঠোঁটে মেখে ফুলের পরাগ ভেবে ভুল করেছি। কখনো অভিমানে দূরে থেকেছি। আবার কখনো সেই অভিমানগুলো দু`পায়ে মাড়িয়ে কাছে এসেছি আমরা। একটা মায়ার পথ তৈরি করে সেই পথে বারবার হেঁটেছি আমরা। জাগতিক সব কোলাহলে নিজেদের ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগলো নিজেদের করে তুলেছি আবার। সেই বর্ণাকে কোনো ভাবেই কোনো কারণে দূরে রাখতে পারিনি কখনো আমি। আমার গল্প কবিতা উপন্যাসের চরিত্র হয়ে আমার কাছে সব সময় থেকেছে বর্ণা। বারবার আমার হাতে হাত রেখে আমার হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে বর্ণা।

পাঠক হয়তো আমাদের এই প্রেমকে পরকীয়া বলবেন। কারণ সংসার সীমান্তে আমি এক দীর্ঘযাত্রী। আমার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে। আমার বয়স বাড়ছে। কারো কারো কাছে আমাদের এই প্রেম অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বাইরে নয়। বছর দুই হলো বর্ণারও বিয়ে হয়ে গেছে। এক প্রকার সংসারী হয়ে উঠেছে বর্ণা। তারপরও মধ্যরাতে স্বামীকে ঘুমিয়ে রেখে ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেতে ওঠে বর্ণা। কখনো বাথরুমে ফিসফিস করে না পাওয়ার বহু বর্ণিল ব্যর্থতার গান বেঁজে ওঠে তার কণ্ঠে। আমি আমার বর্তমান ভুলে যাই। বর্ণা ভুলে যায় সামাজিক জগত সংসারের দায়। সে বিশ্বময় তার বুকের সব অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে চায়। আর আমি আমার কবিতার খাতায় একটা দীর্ঘ কবিতার ব্যঞ্জনায় আমার মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেই। আমার সামনে আমাদের বয়স কোনো প্রতিবন্ধতা হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা মধুর মুগ্ধ আলিঙ্গনের আশায় বিশ্বসংসার তছনছ করি প্রতিদিন।

একটা বেসরকারি সংস্থার চাকরি করে বর্ণা। সপ্তাহের ছয়দিন অফিস। আর আমার অফুরন্ত অবসর। বিশ্ব বাউণ্ডুলে বললে কম বলা হবে। বাবার রেখে যাওয়া জায়গাগুলোও তদারকি করে আমার বউ। রাতদিন সংসার ছেলে মেয়ে নিয়ে তার একটা নিজস্ব জগত আছে । মাঝে মাঝে মনে হয়, তার সে জগতে আমার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আমি আমার কবিতার সংসারে থেকে পরকীয়া করি। মাঝে মধ্যে পাঁচ পেগ মদের বুদবুদের মধ্যে নিজেকে হারাই। আমার নিমগ্ন দুঃখ কষ্টের দিনে হাত ধরাধরি করে, যে আমার কাছে থেকেছিল। তাকে আমি প্রতিদিন ঠকায়! প্রতিদিন বঞ্চিত করি। আর এই জন্যে তার কোনো দুঃখবোধ দেখিনা আমি। কখনো আমার মনে হয়, মেয়েদের জীবন কী এমনি। সব মধু ঢেলে দিয়ে সংসারে একদিন কীট হয়ে মরে যাওয়া। আমার সেই মানুষটাও একদিন জেনে গেল বর্ণার কথা।

যে মানুষটার আমার বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিল না। বাদবাকি জীবনে থাকারও কথা ছিলো না। গল্পের বাদবাকি অংশে এসে পাঠক আমাকে ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন জানি। সেখানে বর্ণা মলিন হয়ে যাবে। আমার বউ হয়ে উঠবে চিরচেনা নির্যাতিত বাংলার নারী। তার জন্য কেউ কেউ চোখের জলে ভাসবেন। বর্ণাকেও ক্ষমা করে দিবেন আশা করি। আর আমার মুখে থুতু ছিটাবেন। আপনারা সবাই জেগে উঠবেন। ফেসবুকে ভাইরাল করবেন আমাকে। আমার এত এত প্রেমের কবিতার জন্য। আমার অসাধারণ বেশকিছু গল্পের জন্য আমাকে যেমন ক্ষমা করবেন না আপনারা। আর দেশের প্রচলিত আইনে যতদিন আমার ফাঁসি কার্যকর না হচ্ছে! ততদিন আপনারা থামবেন না। কারণ আমার বউ। যার জন্য আপনারা সঠিক কাজটিই করেছেন। কিন্তু আমার ভুল শুধরানোর সময় কেউ দেয়নি আমাকে। হয়তো বর্ণাকেও সাথে পাবেন আপনারা। কারণ এক মধ্যরাতে আমার বউয়ের আত্মহত্যা। আপনাদের এত সময় নিশ্চয়ই অস্থির করে তুলেছে।

লেখক: কবি ও কথাসহিত্যিক