করোনা প্রতিরোধে চীন ও ভিয়েতনামের ভূমিকা এবং বাংলাদেশ

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২০

করোনা আক্রমণ প্রথম ঘটে চীনে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষে। চীনে সম্ভবত প্রথম সনাক্তর খবরটি আসে ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু সংক্রমিত হওয়া রোগটি যে করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত, তা নিশ্চিত হয় ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা চীনে। প্রায় একশো চুয়াল্লিশ কোটি। সেই চীন বর্তমানে আক্রান্তের শীর্ষ তালিকার একুশ নম্বরে রয়েছে। চীনের বহু বহু পরে যেসব দেশ আক্রান্ত হয় এবং চীনকে ছড়িয়ে যায় সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে সর্বপ্রথমে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের লোকসংখ্যা তেত্রিশ কোটির সামান্য বেশি। সম্পদের দিক দিয়ে আবার বিশ্বের শীর্ষে। চীনে যেখানে মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম, যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে মৃতের সংখ্যা প্রায় একলক্ষ বাইশ হাজার। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ আক্রান্ত আর মৃত, দুই ক্ষেত্রেই তার মোট সংখ্যার এক চতুর্থাংশ য়ুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় নব্বই লক্ষ আর যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা তেইশ লাখের বেশি। বিশ্বে মৃতের সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ সাতষট্টি হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে একলক্ষ বাইশ হাজারের সামান্য কম। চীনের আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম দুতিন মাসে আশি হাজারে পৌঁছে গিয়ে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান প্রথম করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে বুঝে উঠতে তাদের নিশ্চয় সময় লেগেছিল। কিন্তু তারপরে তারা দু-তিমাসের মধ্যে করোনা ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে কী কারণে? যা বিভিন্ন বড় বড় অনেক দেশই পারেনি? নিশ্চয় সেটা নিয়ে ভেবে দেখার আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডা. ব্রুস চীনের সাফল্য নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তিনি পঁচিশ জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের একটি দল নিয়ে চীন ঘুরে আসার পর যে প্রতিবেদন দেন তা খুব মনে রাখাবার মতো আর শিখবার মতো। তিনি বলেন, চীন সার্সের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে খুব দ্রুত সবকিছু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারাটাই ছিল, চীনের সাফল্যের মূল কারণ। সার্সের দিনগুলিতেও চীন সাত হাজার লোককে নিয়োগ দিয়ে দ্রুত একটা হাসপাতাল বানিয়েছিল। ঠিক একইরকম কাজ করে করোনার সময়ে, মাত্র ছয় দিনে এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে আর একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে তেরশো শয্যার আর একটি হাসপাতাল সম্পন্ন হয় পনেরো দিনের মধ্যে। অন্যান্য অনেক ভবনকেও করোনার চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করার জন্য নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল। নিজের দেখা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন ডা. ব্রুস। চব্বিশ থেকে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে কয়েকটি টেনিং সেন্টার আর ঘরোয়া খেলার মাঠকে হাসপাতাল বানানো হয়েছিল। তিনি বলেন, চীনের কাছ থেকে যা শেখার আছে তা হলো দ্রুততা। কতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কতো দ্রুত কাজ আরম্ভ করা যায়। চীন দেখিয়েছে কতো দ্রুত রোগ সনাক্ত করা সম্ভব আর কতো দ্রুত সনাক্তকারীকে আলাদা করে ফেলা যায়। যারা সেসব সনাক্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিল চীন খুব দ্রুত তাদের খুঁজে বের করে। কতো দ্রুত সংক্রমিতদের সন্ধান করে সব আলামতগুলিকে উপস্থিত করা যায় সেজন্য বহু সরকারি নজরদারিরা ছিল।

চীনের সনাক্ত আশি হাজার রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছিল সকলকে খুঁজে বের করা হয়েছিল। সকল রকমভাবে তাদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিল জানার জন্য তারা সংক্রামিত হয়েছে কিনা বা সংক্রমণ ছড়াতে পারে কিনা। কর্মকর্তারা সংক্রামিতদের খুঁজে বের করতে খুব আগ্রাসীভাবেই প্রচেষ্টা নিয়েছিল। যাতে সংক্রমিতরা কিছুতেই রোগ ছড়াতে না পারে তারজন্য দায়িত্ববানরা ভীষণভাবে সক্রিয় ছিল। কাউকে সামান্য ছাড় দেয়া হয়নি এসব ব্যাপারে। ব্রুস বলেন, প্রত্যেকটা কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটা কাজের সংযোগ রক্ষা করা হয়। চীনের সবরকম কর্মবাহিনী সকলে মিলে সমস্যা সমাধান করার ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল। ফলে ভয়াবহভাবে সংক্রমণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়াকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তারা নানারকম ভুল তথ্য যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ছিল। কিছু মানুষ যেমন বলতে শুরু করে, ‘রসুন করোনা রোগ সারাতে পারে’; এসব ভুল প্রচারের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেরাই জনগণকে সচেতন করে। উহানে সে সময়ে মুঠোফোনকে অনুসরণ করে বিভিন্ন ব্যক্তির গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা হয় তারা যাতে ঘরের বাইরে যেতে না পারে। সবকিছু নজরদারি করার জন্য বহু মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা তারা সার্স ভাইরাস সংক্রমণের সময় থেকে লাভ করে। চীন সরকারিভাবেই কঠোর ছিল যাতে কেউ ঘর থেকে বের হয়ে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে।

করোনাকালে উহানের বন্দী দশায় দেড়কোটি মানুষকে অনলাইনে খাবারের নির্দেশ দিতে হয়েছে। আর সেটা সরকারিভাবে করা হয়েছে। সকলের কাছে খাবার পৌঁছে গেছে। নিশ্চয় সেখানে কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে। হয়তো প্যাকেট খোলার পর কখনো কখনো সবগুলো সামগ্রি পাওয়া যায়নি। করোনাকালে চীনের উহানের বন্ধের দিনগুলিতে কেউ কিছু কেনাকাটা করার জন্য বের হতে পারেনি। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য বাইরে থেকে চল্লিশ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে পাঠানো হয়েছিল। যাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী। কর্মীবাহিনী, পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ সবকিছু নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল। রাজধানী হিসেবে উহান নিউইয়র্কের চেয়ে এলাকায় বড়। রাতের বেলা তখন রাজধানী উহানকে মনে হতো ভূতের শহর। শুধু সারা শহরে আলো জ্বলছে। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘরে মানুষ ছিল আর তাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন মতো সাড়া দেয়া জন্য জনশক্তি নিয়োজিত ছিল। সরকার ফেসবুক বা গণমাধ্যমগুলিকে কোনো গল্প ছড়াতে দেয়নি। যাতে কেউ এসব ব্যাপারে ভুল তথ্য না দিতে পারে সে ব্যাপারে সরকার ছিল কঠোর। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো কতোটা স্বচ্ছতার সঙ্গে দরকারি কাজগুলি কতো দ্রুত করা করা যাচ্ছে সে ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া। স্বচ্ছতার প্রতি প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়ে দ্রুত সংক্রামিতদের খুঁজে বের করা গেলে আর সেই মতো প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া গেলে সব চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য স্পেন, ইতালী ইত্যাকার বিশটি দেশের সংক্রমণ চীনকে ছাড়িয়ে গেল কেন? যদিও তাদের জনসংখ্যা কম আর আক্রান্ত হতে শুরু করে বহু পরে। বহুদেশের মৃতের সংখ্যাও চীনের চেয়ে বেশি। ভারত ছাড়া বর্তমানে শীর্ষে থাকা উল্লেখিত প্রতিটি দেশের মৃতের হার চীনের চেয়ে অনেক বেশি। নিশ্চয় গবেষণা করে এর কারণ কখনো হয়তো বের করা হবে। কিন্তু বিশ্বের অন্য দেশের কথা বাদ রেখে বাংলাদেশ নিয়ে কিছুটা ভাবনা চিন্তা করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটির কম। মানে চীনের আটভাগের মাত্র এক ভাগ। বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণের সংবাদ পাওয়া যায় মার্চ মাসের আর্ট তারিখে। বাংলাদেশের করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সহ সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু সেই বাংলাদেশ যেখানে চীনের নয় সপ্তাহ পরে প্রথম সংক্রমনের খবর পাওয়া যায় এবং যার জনসংখ্যা চীনের সাড়ে আট ভাগের এক ভাগ, সেই দেশ কী করে চীনকে ছাড়িয়ে গেল? ব্যাপারটা খুব বিস্ময়কর নয় কি? বহু মানুষ হয়তো বলবেন চীন ধনী দেশ, সম্পদ বা প্রযুক্তির জোরে সংক্রমণকে দ্রুত ঠেকাতে পেরেছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রথম প্রশ্নটি হলো, চীনের চেয়ে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র তাহলে চীনের মতো সাফল্য কেন লাভ করতে পারলো না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশে সরকার কি স্বীকার করে, বাংলাদেশ দরিদ্র বা পশ্চাদপদ একটি দেশ? বাংলাদেশকে নিজেকে কানাডা এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে নাকি তুলনা দেয়।

বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণে ইতিমধ্যেই কানাডাকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান রচনাটি প্রস্তুতকালে বাংলাদেশ করোনা আক্রমণের শীর্ষ তালিকার সতেরো নম্বরে আর কানাডা আঠারো নম্বরে। সিঙ্গাপুরকে করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশ ডিঙ্গিয়ে এসেছে অনেক আগেই। সিঙ্গাপুর এখন শীর্ষ তালিকার একত্রিশ নম্বরে। বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণে এখন কানাডার প্রায় সমান। কিন্তু সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের তুলনামূলক একটি আলোচনা হতে পারে। কারণ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সিঙ্গাপুর বিশেষ একটি চমক দেখিয়েছে। সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের তুলনায় মৃতের হার সবচেয়ে কম। শূন্য দশমিক একও নয়। সিঙ্গাপুরে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা আজকের দিন পর্যন্ত ৪২৩১৩। কিন্তু মৃতের সংখ্যা মাত্র ২৬। বাংলাদেশ নিজেকে সিঙ্গাপুরের সমকক্ষ হবার স্বপ্ন দেখিয়ে সেরকম চমক দেখাতে পারেনি কেন? বাংলাদেশে জুন মাসের প্রথম দিন মৃতের সংখ্যা ছিল সরকারি হিসেবে ২২। যাক সে কথা, সরকারি হিসেবে জুন মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে তেরোতম দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিদিন সর্বনিম্ন মৃতের হার ৩০। সর্বোচ্চ ৪৬। সিঙ্গাপুরে যেখানে সর্বমোট মৃত ২৬ বাংলাদেশে সেখানে গড়ে প্রতিদিন মৃতের হার ৩৭। সবাই ধারণা করছে সেটা বাড়বে। না বাড়ার কারণ নেই। বরং মৃতের যে সংখ্যা বলা হলো, সরকারের চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিরা মনে করেন মৃতের হার তার চেয়ে বেশি। যদিও সরকারের হিসাবের গরমিল নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন রকম আলোচনা আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিজেও হিসেবের গরমিল স্বীকার করেছে কদিন আগে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করায়, বহুজন যুক্তি সঙ্গতভাবেই হয়তো বলবেন, কবে কোন ব্যক্তি বা মন্ত্রী কী বলেছেন তা ধরে বসে থাকলে কি হবে? বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে সিঙ্গাপুরের চেয়ে এতটাই পিছিয়ে যে, সামান্য তুলনা করার সুযোগ নেই। স্বভাবতই সিঙ্গাপুর নিজেদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারা মৃতের হার কম রাখতে পেরেছে।

কথাটা গ্রহণযোগ্য আবার গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সিঙ্গাপুরের চেয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল কিংবা যাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সিঙ্গাপুরের চেয়ে বিশ্বে বহুল প্রশংসিত তাহলে তারা মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না কেন? পাশাপাশি ভিয়েতনাম যাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় খুবই দুর্বল তারা কেমন করে জুনমাস অবধি দেখা যাচ্ছে সংক্রমণের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে সাড়ে তিনশোর নীচে রেখেছে। মৃত্যুর খবর এখন পর্যন্ত নেই। কিন্তু ভিয়েতনামে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয় জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে। বাংলাদেশের ন্যূনতম চল্লিশ দিন আগে। বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রের তুলনায় ভিয়েতনাম অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল, কিন্তু করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় সাফল্যটি তাদের। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে ১৯৭১ সালে। ভিয়েতনাম তেরো-চোদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। কিন্তু তারপরেও ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দেশটির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনারকম যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু করোনা ভাইরাস নিয়ে তার সফলতা সকল দেশের শীর্ষে। কী করে তা সম্ভব হলো? কারণটা বিশ্লেষণ করা সহজ। যখন মাত্র চীন দেশে ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে ভিয়েতনাম তখন সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে অনেক আগ্রাসীভাবে নিজেদের পরিকল্পনাটা করে ফেলে। ভিয়েতনাম স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, যদি রাষ্ট্রের ভিতর ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা ল্যাজেগোবরে হয়ে যাবে। সকলকে তারা সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবে না। ফলে রোগ প্রতিরোধ করাটা তাদের চিন্তায় দৃঢ়তার সঙ্গে বাসা বাধে। যাতে রোগটা কিছুতেই ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্য যা করার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সামান্য সময় তারা নষ্ট করেনি, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ভিয়েতনাম বুঝে ছিল প্রতিরোধ ছাড়া উপায় নেই, কোনাভাবে সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিরাট এক ধাক্কা খাবে দেশটা। ভিয়েতনামের সারা দেশব্যাপী এ রোগের সঙ্গে লড়াই করার আর্থিক সামর্থ ছিল না। ফলে জানুয়ারি মাসের প্রথমেই যখন পর্যন্ত ভিয়েতনামে কোনো রোগী সনাক্ত হয়নি, ভিয়েতনাম সরকার অতিকঠোর এবং কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেয়। চীনের উহানে মাত্র তখন দুজন মারা পড়েছে, ভিয়েতনাম তখন প্রাথমিক পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে। যখন ভিয়েতনামে ২৩ জানুয়ারি প্রথম উহান থেকে একজন ব্যক্তি হোচিমিন শহরে তাঁর সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, ভিয়েতনাম জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপারটাতে নাক গলায়। ভিয়েতনামে প্রথম করোনার সংক্রমণ সনাক্ত হয় ২৮ জানুয়ারি চীন থেকে আসা বিমানযাত্রীদের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে চীনের মূল ভূখ-ের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে চীনের বিমান ভিয়েতনামে আসা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভিয়েতনামের এই নিষেধাজ্ঞাকে তখন অনেকে খুব বেশি আগে চরম পদক্ষেপ নেয়া বলে মনে করেছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের জন্য সেটাই ছিল যথেষ্ট বিবেচনা প্রসূত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। কিন্তু জানুয়ারি মাসেই ভিয়েতনামের এমন উঠেপড়ে লাগাটা অনেকের কাছে যুক্তিপূর্ণ মনে হয়নি। বিভিন্ন দেশ যেসব পদক্ষেপ নিতে কম করে আরো একমাস দেরি করেছিল, ভিয়েতনাম যতো দ্রুত সম্ভব সেসব সিদ্ধান্ত নিতে কার্পণ্য করেনি।

কখনো সম্পূর্ণ ভিয়েতনাম লকডাউন করা হয়নি। সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। সকলের জন্য মাস্ক পরিধান আর দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক করা হয়েছিল। কিন্তু বারোই ফেব্রুয়ারি রাজধানী হ্যানয়ের একটি এলাকা যেখানে এগারো হাজার মানুষ বসবাস করতো, সে এলাকাটা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল তিন সপ্তাহেন জন্য। সেখানে একটি হাসপাতালের সংক্রমিত রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এটা করা হয়েছিল। সেখানে নিশ্চিতভাবে দশ জন রোগী সনাক্ত হয়েছিল। সেখানে কেউ প্রবেশ বা সেখান থেকে কেউ প্রস্থান করতে পারতো না। পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী হ্যানয়ের দশ হাজার মানুষ বসবাসকারী উত্তরের একটি অঞ্চল সম্পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছিল। কারণ সেখানেও কয়েকজন রোগী সনাক্ত হয়েছিল। দুটি শহরে শুধু দুটি অঞ্চলকে অবরুদ্ধ করা নয়, সেখানকার আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে যারা এসেছিল প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হয়। সংক্রমণ ছড়াবার সামান্য সুযোগ রাখতে চায়নি ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম সরকারের কাছে সংক্রমণ ছড়ানোটা কেবলমাত্র কিছু রোগীর মৃত্যু বা কষ্ট পাওয়া নয়, পুরো দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা যে তাতে ভেঙে পড়বে খুব গুরুত্ব দিয়ে এটা বুঝতে পেরেছিল তারা। সেরকম কিছু হলে ভয়ানকভাবে দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে যাবে সেটাও সরকার মাথায় রেখেছিল। সরকার জানতো, যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর অর্থনীতির উপর একসঙ্গে আঘাত আসে, মানুষের জীবনে নেমে আসবে চরম হতাশা। জনগণের সরকার হিসেবে এইসকল দিকগুলি সরকারকে ভাবতে হয়েছিল।

ভিয়েতনাম ভ্রমণের উপর তখন থেকেই কড়া নিরাপত্তা আরোপ করা হয়। চীন ভিয়েতনামের সীমান্তগুলিকে কড়া নজরদারির মধ্যে আনা হয়। জানুয়ারির শেষেই সকল বিদ্যালয়গুলিকে ছুটি ঘোষণা করা হয় আর তা মে মাসের মধ্য সময় পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয় সরকার। সতর্কভাবে লক্ষ্য রাখা হয় কেউ কাউকে সংক্রমিত করে কিনা। কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে মধ্যে সংক্রমণরোধে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ভিয়েতনাম ইতিপূর্বেই সার্স, এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা আর ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। ভিয়তনাম সরকার যেমন, ঠিক জনগণও এসব রোগের উৎপাত আর ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোই জানতো। তবুও সরকার জনগণকে সচেতন করার জন্য রাজধানীসহ বড় বড় শহর আর গ্রামের সকল মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে জনগণকে বোঝাতে আরম্ভ করে। কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেয়া হয় জনগণের প্রিয় সামরিক বাহিনীকে। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা নিজেরা এর জন্য প্রচারপত্র তৈরি করে জনগণের মধ্যে বিলি করার ব্যবস্থা করেছিল, যাতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কী করণীয় জনগণ তা খুব সহজ করে বুঝতে পারে।

ভিয়েতনাম সরকার মধ্য মার্চে দেশের সেই সব মানুষকে ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইনে পাঠায় যাদের শরীরে ভাইরাস সনাক্ত হয়েছিল কিংবা যারা তাদের সংস্পর্শে এসেছিল। পুরো ব্যয় সরকার বহন করেছিল। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য খুব বিলাস বহুল জায়গা দেয়া হয়নি। একজন ভিয়েতনামী মহিলা সেই সময়ে অষ্ট্রেলিয়া থেকে ভিয়েতনামে নিজের দেশে ফিরে এসেছিল ভিয়েতনামকে অধিক নিরাপদ মনে করে। ফিরে আসার পর তাকে ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইনে থাকতে হয় আর প্রথম রাতে তাকে কম্বল আর বালিশ ছাড়া শুধু মেট্রেসে ঘুমাতে হয়েছিল, মাথার উপরে অবশ্য একটা বৈদ্যুতিক পাঙ্খা ছিল। যারা কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন সকলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় তারা আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্য। ভিয়েতনাম সরকার মনে করেছিল, যারা ভাইরাস ছড়াতে পারে যদি প্রথমেই তাদের গতিবিধি সুনির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ করে ফেলা যায়, বাকিরা সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকবে। ভিয়েতনাম ভাইরাস ছড়াবার সকল পথগুলি বন্ধ করে দেয় সতর্কতা সঙ্গে। ভিয়েতনাম সবরকমভাবে সনাক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা মানুষগুলিকে খুঁজে বের করে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করে। ভিয়েতনাম সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্তর পর্যন্ত সকলকে নজরদারিতে আনে আর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য করে।

ভিয়েতনাম প্রথম থেকেই এটাকে একটা যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকারের প্রতিটা স্তর থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি আবাস এবং প্রতিটি নাগরিককে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য দূর্গ গড়ে তুলতে হবে। ফলে সকল নাগরিকরা আন্তরিকভাবে সরকারের সঙ্গে মিলিতভাবে লড়েছে ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য। সরকারি গণমাধ্যমগুলি যথাযথভাবে জনগণের কাছে করোনা সংক্রান্ত সকল তথ্য সরবরাহ করেছে। ভিয়েতনাম সরকার মনে করে, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সাড়ে তিন লাখ মানুষের করোনা পরীক্ষার করার সামর্থ তাদের নেই। করোনা ছড়িয়ে পড়লে সঠিকভাবে চিকিৎসা দেবার সামর্থ পর্যন্ত ভিয়েতনাম সরকারের থাকবে না। ভিয়েতনাম মনে করেছে, যারা শারীরিকভাবে সবল আর কম ঝুঁকিপূর্ণ তাদেরকে বিভিন্নভাবে আলাদা করে রাখা হবে সুস্থ্য হয়ে উঠবার জন্য। কিন্তু ঝুঁকিপুর্ণ সকল ব্যক্তিদের পূর্ণমাত্রায় চিকিৎসা দেয়া হবে। ভিয়েতনাম তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক সামর্থ বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভিয়েতনাম সরকার মনে করেছিল, করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলা করা জন্য তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সর্বিকভাবে প্রস্তুত নয়। সাড়ে নয়কোটি মানুষের দেশে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে, চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানারকম সঙ্কটের শিকার হবে তারা। হো চি মিন শহরের নগরপাল জানান যে, শহরের হাসপাতালে মাত্র ৯০০ শয্যা ছিল রোগীর ইনটেনসিভ কেয়ার নেয়ার জন্য। কিন্তু করোনা ভাইরাস সকলের মধ্যে ছড়াতে থাকলে তাতে কুলাবে না। রাজধানী হ্যানয়ের হাসপাতালে নিশ্চয় কিছু ইনটেনসিভ কেয়ার নেয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সরকার সাড়ে নয়কোটি মানুষের জন্য সেগুলি যথেষ্ট মনে করতে পারেনি। ফলে সংক্রমণ প্রতিরোধকে তারা প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ফলে করোনার চিকিৎসা দেবার জন্য সাড়ে তিনশো রোগী পাওয়া যায়নি সারা ভিয়েতনামে গত প্রায় পাঁচমাসে। প্রায় ক্ষেত্রেই ইনটেনসিভ কেয়ারগুলি খালি পড়েছিল।

বাংলাদেশের দিকে তাকালে কী দেখা যাবে? প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলতে শুরু করেছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে তারা যথেষ্ট প্রস্তুত। নির্লজ্জের মতো বলেছে, বিশ্বের অনেক বড় দেশের চেয়েও তাদের প্রস্তুতি ছিল। বিশ্বের গবেষকদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের মতো মহামারী প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার স্বচ্ছতা, তথ্য গোপন না করা। তথ্য গোপন করলে বিপদ বাড়বে। কিন্তু সামান্য স্বচ্ছতা ছিল না বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরগুলির, না বাংলাদেশ সরকারের। ভিয়েতনাম সরকার যথেষ্ট বিবেচনার সঙ্গে এটা ধরে নিয়েছিল, সাড়ে নয় কোটি মানুষের দেশে করোনা একবার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে, তার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা তা কিছুতেই সামাল দিতে পারবে না। মাথার মধ্যে এটা তাদের পরিষ্কার ছিল। ফলে মহামারি না ছড়ানোর জন্য সব ব্যবস্থা তারা নিয়েছিল। ভিয়েতনাম সফলভাবে এটা প্রমাণ করেছে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দরকার সবসময় ব্যাপকরকম চিকিৎসা দান নয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার চমক দেখানো নয়। বরং ভিন্ন ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাকে আটকে দেয়া যায়। দরকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো দেশ সেভাবেই সাফল্য লাভ করেছে। চিকিৎসার জন্য তাদের তেমন কিছুই ব্যয় করতে হয়নি। প্রধান প্রশ্নটা ছিল সরকারের মানসিকতার। করোনা সংক্রামণকে বাড়তে না দেয়ার জন্য দুই দেশের সরকার যতদূর সম্ভব নজরদারির মধ্যে রেখেছে পুরো রাষ্ট্রের নাগরিকদের। পরিকল্পনা গ্রহণে সামান্য কাল ক্ষেপণ করেনি। ভিয়েতনাম আর শ্রীলঙ্কার পথ গ্রহণ করেছে পরে আরো কিছু রাষ্ট্র।

চীন এবং ভিয়েতনাম রোগটি যাতে সারা দেশময় ছড়িয়ে না পড়তে তার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছিল। ফলে সাফল্যও পেয়েছে। চীন প্রথমে সামাল দিতে পারেনি। কারণ উহানের মানুষজন নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে প্রথমদিকে ব্যাপকভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চিকিৎসকরা নিউমেনিয়ার চিকিৎসা দিতে দিতে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ দেখতে পায় নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় রোগীদের উন্নতি হচ্ছে না। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, এসকল রোগীদের প্রায় সকলে উহান শহরের ‘হুয়ানান সামুদ্রিক খাদ্য পাইকারি বাজার’-এর সঙ্গে যুক্ত। তাদের কেউ ক্রেতা, কেউ বিক্রেতা বা কেউ সরবরাহকারী। সেখানে সামুদ্রিক জীবিত মাছ বা অর্ধমৃত মাছ বা জীবের মাংস বেচাকেনা হয় আর সেই সঙ্গে কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ মাছ খাওয়া দাওয়া হয়। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল হুয়ানানের এ বাজারটি করোনা ভাইরাস ছড়ানোর একমাত্র উৎস ছিল না। উহানের বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের নিউমেনিয়ার উন্নতি না হলে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর চীনের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্টোল’কে ব্যাপারটি অবগত করা হয়। কিন্তু উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের একজন চোখের চিকিৎসক তার ফোনের ইন্টারনেট মারফত ব্যাপারটি কয়েকজন বন্ধুকে জানালে ব্যাপারটি সরকারের নজরে আসে। পুলিশ তখন তাকে এভাবে গুজব ছড়াতে বা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে না করে। তিনি তার নিজের কর্মস্থলে ফিরে যান এবং কিছুদিনের মধ্যেই করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন পরে মারাও যান।

চিকিৎসকের সেই ছড়ানো গুজবটিকে প্রথম মহামারী হিসেবে উড়িয়ে দিলেও, ঠিক পরদিনই ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি তদন্ত পর্ষদ গঠন করে। পরদিনই সামুদিক মাছ বিক্রয়ের বাজারটিকে জীবাণুমক্ত করার জন্য বিশেষ অভিযান চালানো হয় এবং ক্রেতাদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা হয়। সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে এই অভিযানে কথা প্রচার করা হয়েছিল। সরকার পরদিন আকস্মিকভাবে মার্কেটটি বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে আরো রোগী ভর্তি হয় হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় প্রথম রোগী মারা যায় জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে। পরপর চারদিন চারজন রোগী মারা যায়। পরের চারদিন মারা যায় দুইজন করে। মৃতের সংখ্যা তারপর বাড়তেই থাকে। চীন সঙ্গে সঙ্গে উহান শহরকে অবরুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু চীনের রোগটিকে বুঝে উঠতে উঠতে জ্যামিতিক হারে বহু মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়ে। বহু মানুষ মারা যেতে থাকে। চীন রোগটিকে প্রতিরোধ করার জন্য তখন নানাভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয় যাতে রোগ উহানের বাইরে ছড়িয়ে না পরে। রাজধানী উহান ছাড়াও হুবেই প্রদেশে আরো অনেকগুলি বড় বড় শহর ছিল। চীন সরকার হুবেই প্রদেশের সকল শহরের সঙ্গে উহানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। হুবেই প্রদেশের অন্যান্য শহরগুলির উপরেও নজরদারি রাখে। কিন্তু ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসটি মহামারী আকারে উহানকে গ্রাস করে ফেলেছিল। চীন সরকারের তিনমাসের মধ্যে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। চীন সংক্রমিতদের খুজে বের করতে প্রচুর মানুষকে পরীক্ষা করছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পরে উহানে মে মাসের ১৪ থেকে ২৩ পর্যন্ত দশদিনে পঁয়ষট্টি লাখ মানুষকে করোনা পরীক্ষার অধীনে এনেছে। দিনে দশ থেকে পনেরো লাখ মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে। করোনা প্রতিরোধে উহানের এককোটি দশ লাখ মানুষের সকলকে পরীক্ষা করা হয়।

ভিয়েতনাম আর চীনের করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের এই সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের কিছু রাষ্ট্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বহু দেশ চীনের সাফল্যকে মানতেই রাজি নয়। চীনের সাফল্যকে ছোট করার জন্য বলছে চীনের দেয়া পরিসংখ্যানে লুকোচুরি আছে বলে তাদের অভিযোগ। কেউ কেউ একই অভিযোগ তুলেছে ভিয়েতনাম সম্পর্কে। কিন্তু চীন আর ভিয়েতনামের সাফল্যে পাশ্চাত্যে কিছু দেশ আস্থা রাখতে না পারলেও, সিঙ্গাপুরের সাফল্য নিয়ে বক্র কথা বলছে না। বক্রকথা বলছে না শ্রীলঙ্কার সাফল্য নিয়ে। বক্র কথা বলছে না মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মুত্যুর সংখ্যা কম নিয়ে। কারণ কী? সিঙ্গাপুর আর মধ্যপ্রাচ্যের সাফল্য নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন নেই, কারণ সেগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে চীন আর ভিয়েতনাম নিয়ে। কারণটি খুব সহজ, দুটি দেশেই সমাজতান্ত্রিক দেশ, দুটি দেশে বর্তমানেও সাম্যবাদী দলের সরকার রয়েছে। সত্যিকারের সমাজতান্ত্রিক দেশ কিনা সে প্রশ্ন বহুজন তুলতে পারে চীন বা ভিয়েতনাম নিয়ে। কিন্তু কাগজেকলমে সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং একদলীয় সাম্যবাদীরাই দেশ দুটি চালাচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র দুটির জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। ভিন্নদিকে নানারকম উন্নয়নের মাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে দুটি দেশই। ভিয়েতনামের পথ চলা শুরু হয়েছে বলতে গেলে সেদিন, সে তুলনায় যথেষ্ট ভাল করছে দেশটি। ফলে পাশ্চাত্যের অপপ্রচার সহজে বন্ধ হবে না।

চীন বিশাল দেশ, বিরাট অর্থনৈতিক শক্তি। তার কথা বাদ দেই। ভিয়েতনাম আর শ্রীলঙ্কা যা পারলো, বাংলাদেশ তা পারলো না কেন? শ্রীলঙ্কা আর ভিয়েতনাম যেভাবে সংক্রমণকে প্রতিহত করেছে, বাংলাদেশ সেই একই পথে আগালো না কেন? খুব ব্যয়বহুল পথ সেটা নয়। নিন্দুকরা অবশ্য বলে, যেখানে বহু টাকা খরচ করার সুযোগ নেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজরা নাকি সেসব কাজ করতে উৎসাহ পায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, কম মূল্যের প্রয়োজনীয় সামগ্রি কেনার চেয়ে, অনেক বেশি দাম দিয়ে অপ্রয়োজনীয় সামগ্রি কিনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উৎসাহী। বাংলাদেশে অক্সিজেনের অভাব কেন, করোনা চিকিৎসায় যা ব্যাপক দরকার ছিল? কারণ হিসেবে জানা যায় কম মূল্যের অক্সিজেন ক্রয় করার চেয়ে যেখানে বেশি টাকা পকেটে ভরার সুযোগ, সংশ্লিষ্টরা সেরকম সামগ্রি কিনতে চায়। বাংলাদেশ সরকারের বা জনস্বাস্থ্যের ব্যর্থতা নিয়ে এখন সরকারী দলের চিকিৎসরা পর্যন্ত সমালোচনায় মুখর। সরকারের জাতীয় কমিটির চিকিৎসকরা প্রতিদিন এখন চিকিৎসকদের মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বিশ্বের আর কোনা দেশে এত চিকিৎসক মারা যাননি। চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে চিকিৎসকরা ক্লান্ত কিন্তু তা এখনো সহজলভ্য নয়। সবার আগে, বলতে গেলে সেই মার্চের শুরু থেকে চিকিৎসক আবদুন নূর তুষার চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা আরম্ভ করেছিল। বহুজন তখনো ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারেনি। বহু মূল্য দিয়ে এখন চিকিৎসা জগতের সরকারি দলের নেতারা পর্যন্ত বুঝতে পারছেন ভয়াবহ অঘটন ঘটে গেছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার নানা অব্যবস্থাপনার কথা নাকি চীন থেকে আগত বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করলেও কিন্তু চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিকতার প্রশংসা করেছেন তাঁরা। বলেছেন বাংলাদেশের চিকিৎসাদানের সঙ্কট হচ্ছে অব্যবস্থাপনা, কিন্তু চিকিৎসকরা দক্ষ। চীনা বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেছেন, ‘চিকিৎসকদের কাছ থেকে আমরাও বহু কিছু শিখেছি’। চীনাদের এ স্বীকারোক্তি আমাদের চিকিৎসকদের সম্পর্কে মানুষের মনের বহুদিনের হতাশা দূর করবে নিশ্চয়। বাংলাদেশে সফররত চীনের করোনা ভাইরাস বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লি ওয়েন ঝিও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মেধা ও দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রশংসা করেছেন হাসপাতালের সেবিকা আর স্বাস্থ্যকর্মীদের। কিন্তু সরকারের বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনা করোনা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছেন বলে চীনা বিশেষজ্ঞ দল মনে করেন। চীন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের পার্থক্য বোঝাতে ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন চীনা বিশেষজ্ঞ দলের চিকিৎসক লি। লি বলেন, সঠিক তথ্য বা অব্যবস্থাপনার কারণে করোনা ভাইরাস যে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় আছে সেটাই জানা দুষ্কর। বলা যায়, তা জানা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। কিন্তু এভাবে ভাইরাস মোকাবেলা করা সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। চীনা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য দরকার কার্যকর লকডাউন, সংক্রমিতদের সনাক্ত করার জন্য দ্রুত পরীক্ষানিরীক্ষা, সকল সংক্রামিতদের খুঁজে বের করা এবং চিকিৎসার পরিধি বাড়ানো। করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা বহুগুণ বাড়াবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তুবাস্তবে পরীক্ষা করাবার সহজ পন্থা বা সুযোগ নেই। সরকারের তেমন আনুকূল্য নেই। খবরে প্রকাশ, ব্যক্তিগত বা বেসরকারী হাসপাতালে পরীক্ষা করাবার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক লুটপাটের শিকার হচ্ছেন মানুষ, সরকারি ক্ষেত্রে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে বা কখনো কখনো ঘুষ দিতে হচ্ছে। সংক্রমিতদের সকলে জন্য চিকিৎসা নেই। বহু মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন এসব বহুদিন ধরেই খবরের কাগজ পাঠ করে জানা যাচ্ছে।

চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য খানিকটা আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাত পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কেবলমাত্র সুষ্ঠুভাবে চালু আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল, সিএমএইচ এবং কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী যা বলছেন তার সঙ্গে চীনা বিশেষজ্ঞদের কথার মিল রয়েছ। কিন্তু সিএমএইচ-এ সকলের যাবার সুযোগ নেই। বাকিগুলিতে কমবেশি নানারকম অব্যবস্থাপনা যে নেই তা নয়, কিন্তু সেটা চিকিৎসকদের কিছু করার নেই। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। চীনের বিশেষজ্ঞ দলের কথায় সেটার প্রমাণও পাওয়া গেছে। কিন্তু উল্লেখিত হাসাপাতালগুলিতে তো আর অফুরন্ত শয্যা নেই যে, সকলের চিকিৎসা জুটবে। বর্তমান মারাত্মকরকম আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক। কিন্তু সারা দেশেই সে তুলনায় শয্যা নিতান্ত অপ্রতুল। চিকিৎকরা জানপ্রাণ দিলেও হাসপাতালগুলিতে আছে অক্সিজেনের অভাব। কিন্তু অক্সিজেনই করোনা চিকিৎসার সবচেয়ে প্রধান অস্ত্র। বরিশালের শের-ই-বাংলা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অভিযোগ এসেছে, শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে সেখানে রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় সামগ্রি বা যন্ত্রপাতির অভাবে তাঁরা মারাত্মক রোগীদের দরকার মতো অক্সিজেন দিতে পারছেন না। ন্যূনতম যেখানে প্রয়োজন প্রতিদিন রোগীদের ত্রিশ থেকে-সত্তর লিটার অক্সিজেন দেয়া, সেখানে ন্যাসাল ক্যানালের অভাবে মাত্র ছয় লিটার অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হচ্ছে। ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা চতুর্দিকে। মানুষজন করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবে না বলে আতঙ্কিত।

সংকট থেকে বের হবার উপায় কী? বহু দিন ধরে মনে হচ্ছিল সংকট উত্তরণের পথ নিশ্চয় আছে। না থেকে পারে না। কিন্তু গত কদিন আগে নতুন একটি খবর জানতে পারার পর সংকট উত্তরণের আর ভরসা খুঁজে পাচ্ছি না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের খবরে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি নিয়ন্ত্রিত হয় বিদেশে থাকা এক বাংলাদেশের ব্যবসায়ীর দ্বারা। তিনিই নাকি গত ত্রিশ বছর যাবৎ ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। পুরো মন্ত্রণালয় নাকি তার কুক্ষিগত। স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন বলে খ্যাত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ইচ্ছাতেই নাকি চলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মিঠুর আঙ্গুলি হেলনেই নাকি চলছে স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় সরবরাহ এবং কেনাকাটার কাজ। কিন্তু তিনি নাকি এতটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে, দুদুক নাকি তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না। বরং তার দৌরাত্ম নাকি এতটাই যে, দুদক আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তারাই তার কাজের সহযোগী। চার বছর ধরে তার বিরুদ্ধে সকল দুর্নীতির তদন্ত নাকি থেমে আছে। বিদেশে অর্থ পাচারকারী হিসেবেও নাকি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীন একটি দেশে কেমন করে একজন মানুষ পুরো একটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ন্ত্রণ করে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে? বাংলাদেশের মানুষ কি এরকম একটি পরিস্থিতি দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল যে, তার স্বাস্থ্য সেবা একজন ব্যক্তির নিজস্ব মুনাফা লাভের খেয়াল খুশিমতো পরিচালিত হবে? মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবে তার জন্য কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল! মানুষ মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল কি দেশটা নানাভাবে লুটপাট হবে সেইজন্য!

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাণ্ডিং কমিটির সদস্য সাংসদ একরামুল বলেন, স্বাস্থ্য খাত বিরাট সিণ্ডি কেটের নিয়ন্ত্রণে। বিরাট সেই সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্য আমি নিজেও বিপদে পড়তে পারি। তিনিও প্রসঙ্গক্রমে বলেন, মিঠু নামক ব্যক্তিটিই নাকি বাইরে বসে চালাচ্ছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সাংসদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাণ্ডিং কমিটির সদস্য হিসেবে আমি বুঝতে পারি না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কারা চালায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চালায়, নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চালায় তিনি নিজেই সেটা বুঝতে পারছেন না। কীরকম হয়েছে রাষ্ট্রের চেহারাটা! সাংসদ একরামুল বলেন, স্বাস্থ্য এবং ব্যাংক খাত দুটো বিরাট সিণ্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়, যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম এই দুটি খাতের সিণ্ডিকেট সম্পর্কে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন ব্যাংক লুটেরা আর স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কিছু বলা তার নিজের জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশ্ন দাঁড়ায় তাহলে সরকারের ভূমিকাটা কী? রাষ্ট্রের এইসব অনিয়ম কার দেখবার কথা? মিঠু দেখা যাচ্ছে একানব্বই সাল থেকেই তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। যা প্রমাণ করে তিনি সরকারি দলের কেউ নন। তাহলে তাঁর ক্ষমতার উৎসটা কী, তিনি ত্রিশ বছর ধরে তাহলে কীভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন? বাংলাদেশের একজন সাংসদ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। সাংসদ মনে করেন, স্বাস্থ্য সিণ্ডিকেটের নেতার ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই একমাত্র সেটাকে সামাল দিতে পারেন। যদি কথাগুলি সব সত্যি হয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? স্বাস্থ্য খাতের পরণতি তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে? করোনার ভাইরাসের এই বিপজ্জনক অব্যবস্থাপনার সময়ে নতুন করে কী আশা করবার কিছু থাকে?

সবকিছু বিচার করার পর নিশ্চয় হতাশ হতে হয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাঁচার পথ দেখাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। শর্ষে ভূত ছাড়াবে, সে শর্ষের মধ্যে যদি ভূত বসে থাকে, তাহলে উপায় কি? যদি প্রাকৃতিক ভাবে ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সার্স ভাইরাসের মতো রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যায় তাহলেই বাংলাদেশের মানুষ করোনার বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। কিংবা স্পেনিশ ফ্লুর মতো সবাই যদি ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজেদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে, সংক্রমণ তাহলেই বন্ধ হবে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে সুবিধাটি এই যে আশি শতাংশ মানুষ এর আক্রমণ টেরই পায় না। বাকি চোদ্দ শতাংশ মানুষ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ছয় শতাংশ মানুষের দরকার হয় নিবিড় পরিচর্যা আর অক্সিজেন। ইতিপূর্বে “করোনা ভাইরাসকে ভয় পাওয়ার আদৌ কিছু আছে কি?” শিরোনামের একটি রচনায় আমি দেখিয়েছি, সবচেয়ে মারাত্মক রোগীদের অক্সিজেন দরকার হয়। যদি ঠিক মতো তাঁরা অক্সিজেন পেয়ে যান তাহলে নিরানব্বই শতাংশ মানুষই করোনার সংক্রমণের পরেও বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনায় মারা যেতে পারেন বহু মানুষ যাদের মরবার কথা ছিল না। বাংলাদেশে যে চিকিৎসা সেবায় অব্যবস্থাপনা চলছে, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের সকল ত্যাগ-তিতিক্ষার পরে কতো সংখ্যক মানুষ যে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবে তা এখন সত্যিই অনিশ্চিত। চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা জগতের বহু গুণী চিকিৎসক ইতিমধ্যেই প্রাণ দিয়েছেন।

সকলের ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে এর হাত থেকে মুক্তি কোথায়। চিকিৎসা খাতের বিভিন্ন রকম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বহু চিকিৎসক এখন সরব। সরকারি দলের চিকিৎসক নেতা, এমনকি সাংসদরা পর্যন্ত মুখ খুলেছেন। স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের ডাঃ ইকবাল আর্সলান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ, বিএমএ-র মহাসচিব ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী, বিএমএর সভাপতি মোস্তফা জালাল মহীউদ্দিন প্রতিবাদ জানিয়েছেন বর্তমান স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন পত্রিকার সম্পদকরা। রাষ্ট্রের এইরকম মহামারীকালে সেটাই হবার কথা। সরকারি দলের একজন সাংসদের ভাষায়, তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। স্বাস্থ্য খাতের এ অব্যবস্থাপনা গত দশ বারো বছরের নয়। বলতে গেলে গত উনপঞ্চাশ বছরের। গত ত্রিশ বছরে সেটা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনা আক্রান্ত অবস্থায় চমৎকারটি একটি নিবন্ধ লিখেছেন সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মুনাফা আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে। কিন্তু আমাদের সমাজের খুব পরিচিত একটি অংশের ব্যক্তিত্বরা নিজদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানা দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে নীরব কেন বুঝতে পারছি না। নিজেদের ব্যক্তিগত প্রচারে সকলেই তারা বেশ সরব। করোনার মতো মহমারীর সময়কালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনিয়ম নিয়ে কিছু বলছেন না কেন দেশদরদী এই মানুষগুলি!