কর্পোরেট সমাজের অফিস মূলত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

পর্ব ১১

প্রকাশিত : মে ০১, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো দশম পর্ব।

২৫ এপ্রিল ২০২১ রোববার
কিছু কিছু দিন খুব আলোড়নহীন যায়। মজা পুকুরের মতো শান্ত, স্থির। ঢিল না ছুঁড়লে তরঙ্গ ওঠে না। আজকের দিনটি ছিল তেমনই তরঙ্গহীন।

সকালের দিকে অফিসে গেলাম। নাক ডুবিয়ে কাজ করলাম। মাঝে নয়নদা একবার ফোন করলেন। তার সঙ্গে একটা অনুবাদ নিয়ে আইডিয়া শেয়ার করলাম। তিনি আইডিয়া পছন্দ করলেন। বললেন, দ্রুত অনুবাদটা করে পাঠাও। আমি ‘যথাজ্ঞা’ বলে ফোন রেখে দিলাম।

এছাড়া আরও কিছু ফোনকল এসেছিল অবশ্য। সেসব অফিসের কর্মহেতু ফোন। আমার বস হোম অফিস করছেন। বাসা থেকে তিনি একটু পর পর ফোন করছিলেন। ভীষণ উত্তেজিত। তাকে শান্ত রাখা এক কঠিন দুষ্কর্ম।

দুপুরের পর বাসা থেকে ছোটবোনের ফোনকল এলো। বলাই বাহুল্য, অপ্রত্যাশিত। সে জানালো, মা আবার খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সব শুনে প্রয়োজনীয় ওষুধের কথা বললাম। ‘ওষুধটা খাইয়ে দে, আমি বাসায় আসছি’ বলে ফোন রাখলাম।

কিন্তু তৎক্ষণাৎ বেরুতে পারলাম না। অফিসেরই আরেকটা কাজ বাগড়া দিলো। ভেবেছিলাম, কাজটা আগামীকাল করব। তা আর হলো না। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের উপর্যুপরি ফোন। বিরস বদনে আবার কম্পিউটারের সামনে বসলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় ফোন করলাম একাধিকবার।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, যাকে কর্পোরেট সমাজ আদর করে নাম দিয়েছে অফিস, সেখান থেকে বের হতে হতে ছয়টা বেজে গেল! সন্দিহান হয়ে পড়লাম, বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারব তো?

দ্রুত রিকশা ধরতে চাইলাম। কিন্তু কথায় বলে না, অভাগা যদ্যপি চায়, সমুদ্র শুকায়ে যায়, আমার হলো সেই দশা। কোনো রিকশা মোহাম্মদপুর যেতে রাজি নয়। কেন? কেউ জানে না। প্রশ্ন করলে উদাস মনে অন্যদিকে থাকিয়ে থাকে রিকশাচালকগুলো। অগত্যা হাঁটা দিলাম।

সাতাশ নম্বরে এসে এক রিকশা পেলাম, দয়াপরবশ হয়ে যেতে রাজি হলেন। ভাড়া টারার ঝামেলায় না গিয়ে টুক উঠে পড়লাম। এখানে আকাশ নীল। ঘনশ্যাম মেঘেরা ছায়া হয়ে আছে উঁচু উঁচু দালানের উপর। সূর্য প্রায় অস্তমিত। এসব দালানোর আড়ালে তার মুখ দেখা যায় না।

বাসা অব্দি রিকশা নিয়ে না গিয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডেই নামতে হলো। কিছু জরুরি ওষুধ কিনতে হবে। কিনলাম। কিন্তু যত দ্রুত কাজ সারতে চাচ্ছি, ততই জট পেকে যাচ্ছে। ওষুধের দোকানির কাছে খুচরো টাকা নেই। আমি যতই তাকে বুঝাই, আমার কাছেও নেই, তিনি ততই গজর গজর করতে থাকেন। সবাই খালি নোট দেয়, সবাই খালি নোট দেয়, এত খুচরা কই পামু? দাঁত পিষতে পিষতে চাপাস্বরে বলছিলেন তিনি।
শেষে তার ক্যাশ ড্রয়ার থেকেই খুচরো বেরুলো। শুধু শুধু ক্যাচাল করে দশটা মিনিট নষ্ট করলেন আমার।

কাজ তখনো শেষ হয়নি। মনে পড়ল, সেদিন মাছবিক্রেতা বলেছিল, আমার কপালে মাছ নাই। কী আর করা। আজ তাহলে মুরগি নিয়ে যাই। দেখি, কপালে মুরগি জোটে কিনা। মুরগীর দোকানদার পূর্বপরিচিত। সে দাঁত কেলিয়ে বলল, ইফতারের টাইমে আইছেন! ওই… ভাইরে একটা ভালা সাইজ মুরগি দে।
আমি বললাম, দাম কি একটু কমছে? নাকি আগেরটাই?
সে আবারও দাঁত কেলিয়ে বলল, আর কত কমব? আড়াই শো ট্যাকা।
আমি বললাম, তা ঠিক। আর কত কমবে। মাত্র আড়াইশো টাকা কেজি। জলের দামে মুরগি দিচ্ছেন!

মুরগির চামড়া ছিলতে বেশি সময় লাগলো না। এরা একদম ম্যাজিকের মতো চামড়া খুলে ফেল, যেন মুরগির গায়ে একটা কাপড় ছিল, টান দিয়ে খুলে ফেলল আর কি!
মুরগিটা নিয়ে এক ছুট দিলাম বাসার দিকে। মাগরিবের আজান পড়তে তখনো সাত মিনিট বাকি। চলবে