কহলিল জিবরানের গদ্য ‘হে আমার দেশবাসী’

প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২১

হে আমার দেশবাসী, তোমরা কী খুঁজে চলেছ? তোমরা কি চাও যে, তোমাদের জন্যে অহেতুক কথাবার্তা দিয়ে সাজানো জমকালো একটি প্রাসাদ আমি নির্মাণ করি? নাকি মিথ্যেবাদী ও শোষকেরা যা নির্মাণ করেছে, সেসব আমাকে ধ্বংস করতে বলো? মন্দলোকের হাত দিয়ে যা কিছু গড়া, আমি কি আমার আঙুল দিয়ে সেসব উপড়ে ফেলব? হে আমার দেশবাসী, বলো তোমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ইচ্ছেগুলো।

তোমরা কী করতে বলো আমাকে? তোমাদেরকে খুশি করতে কি আমি বিড়ালছানার মতো ঘড়ঘড় শব্দ করব, নাকি নিজেকে খুশি করতে গর্জন করব সিংহের মতো? তোমাদের জন্যে আমি গান গেয়েছি, কিন্তু তোমরা নাচোনি। তোমাদের সামনে আমি কেঁদেছি, তোমরা কাঁদোনি। তবে কি একইসঙ্গে আমি গান গাইব ও নাচব?

খিদের তীব্র যন্ত্রণায় তোমাদের আত্মাগুলো কাতরাচ্ছে। অথচ জ্ঞানের ফলগুলো উপত্যকার পাথরগুলোর চেয়েও পরিমাণে বেশি, অনেক বেশি। তোমাদের আত্মাগুলো খিদের তাড়নায় শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ দ্যাখো, জীবনের বসন্তগুলো বয়ে যাচ্ছে তোমাদের বাড়িঘরের দিকে। আমাকে বলো তো, তোমরা কেন তা পান করো না?

সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা রয়েছে। চাঁদের রয়েছে অমাবশ্যা আর পূর্ণিমা। অনন্তকালের রয়েছে শীত-গ্রীষ্ম। সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চলাচলরত একজন ঈশ্বরের ছায়ার মতো সবকিছুরই ওঠা-নামা আছে। যদিও সে ঈশ্বরের এখনও জন্মই হয়নি। কিন্তু সত্য বদলে যেতে পারে না। সত্যের মৃত্যুও নেই। এরপরও মুখের হাসিখুশিভাব কেন তোমরা বিকৃত করার চেষ্টা করো?

নিঝুম রাতে আমি তোমাদেরকে ডেকে বলেছি, চাঁদের মহিমা ও নক্ষত্রের মর্যাদার প্রতি মনোযোগ দ্যাও। কিন্তু তোমরা ভয় পেলে। ঘুম ভেঙে উঠেই তোমরা আঁকড়ে ধরলে তলোয়ার। বললে, কোথায় শত্রু? পেলেই তাকে খুন করে ফেলব। ভোরে যখন শত্রু এলো, আমি আবার তোমাদেরকে ডাকলাম। কিন্তু আরামের ঘুম ভেঙে তোমরা ওঠোনি। এর কারণ, ভীতির ভেতর তোমরা বন্দি ছিলে। ঘুমের ভেতর প্রেতাত্মাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে।

হে আমার দেশবাসী, তোমাদেরকে বলেছিলাম, চলো পাহাড়চুড়োই উঠি। দেখি পৃথিবীর সৌন্দর্য। তোমরা বলেছিলে, এ উপত্যকায় আমার পূর্বপুরুষেরা বসবাস করতেন। এখানেই তারা মারাও গেছেন। এ উপত্যকার গুহায় তাদের কবর। এ জায়গা ছেড়ে এমন একজনের কথায় আমরা কেন যাব, যাকে আমরা শ্রদ্ধা করি না?

তোমাদেরকে আমি বলেছিলাম, চলো সমতলভূমিতে যাই। সমুদ্রকে সে প্রাণখুলে দান করে। তোমরা বলেছিলে, নরকের হইচই আমাদের আত্মাকে ভীত করে তুলবে। শরীরকে অনুভূতিহীন করে তুলবে গভীরতার আতঙ্ক।

হে আমার দেশবাসী, তোমাদেরকে আমি ভালোবেসেছি। এ ভালোবাসা আমার কাছে বেদনাবহ, আর তোমাদের কাছে অর্থহীন। আজ আমি তোমাদেরকে ঘৃণা করি। ঘৃণা হচ্ছে এক ধরনের প্লাবন, যা শুকনো ডালপালা আর শিহরিত বাড়িঘরগুলি মুছে দেয়। হে আমার দেশবাসী, তোমাদের দুর্বলতাকে আমি করুণা করেছি। আমার করুণা তোমাদের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উচ্চপ্রশংসা তোমাদের কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। তোমাদের এসব দেখে আমি বিরক্ত ও ভীত।

তোমাদের মূর্খতায় আমি কেঁদেছি। স্ফটিকের মতো অশ্রু নীরবে বয়ে যাচ্ছে। অবশ্যি আমার চোখের ওপর থেকে একটি পরদা তোমরা সরিয়ে দিয়েছ। ঠিক যে, আমার কান্না তোমাদের পাথুরে হৃদয়ে কখনোই পৌঁছয় না। কিন্তু অশ্রু আমার ভেতরকার অন্ধকার ধুয়ে ফেলে।

আজ আমি তোমাদের দুর্ভোগ নিয়ে তামাশা করছি। হাসছি। অট্টহাসি ভয়ংকর একটি বজ্র, যা ঝড়কে এগিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ঝড়ের পর তা আর ফিরে আসে না।

হে আমার দেশবাসী, তোমাদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলো তো আমায়। তোমাদের কি ইচ্ছে হয়, স্থির টলটলে জলের ওপর তোমাদের উৎফুল্ল মুখ আমাকে দেখাবে? কিন্তু আমি তো জানি, তা তোমাদের নয়, প্রেতাত্মার মুখ। এসো আমার সাথে। তোমরাও দ্যাখো, কী কুৎসিত তোমাদের মুখ। দ্যাখো এবং গভীরভাবে চিন্তা করো। তোমাদের মাথার চুলকে ছাইয়ের মতো ধূসর করে তুলেছে আতঙ্ক। ক্ষতিকর ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে তোমাদের চোখে। তোমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো চোখের অন্ধকারে শূন্যতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ভীরুতা তোমাদের কপাল ছুঁয়ে রয়েছে। তোমরা এখন হতাশ। তোমাদের ঠোঁটে মৃত্যু এসে চুমু খেয়ে গেছে। শরতের হলুদ পাতার মতো জীবন তোমাদেরকে ছেড়ে গেছে।

হে আমার দেশবাসী, কী খুঁজে চলেছ তোমরা? জীবনের কাছে তোমরা কি চাও? অথচ তোমরা মানতেই পারো না, তোমরা জীবনের সন্তান।

যাজক ও জাদুকরদের শক্তমুঠির ভেতর তোমাদের আত্মা বরফের মতো জমে আছে। খুনির থাবার নিচে তোমাদের শরীর শিহরিত হয়। শত্রুর কুচকাওয়ারত পায়ের নিচে কাঁপতে থাকে তোমাদের দেশ। কী চাও তোমরা সূর্যের কাছে? সূর্যের মুখোমুখি যদিও গর্বিত বুকে তোমরা দাঁড়িয়ে থাকো। তোমাদের কোষবদ্ধ তলোয়ারে মরচে ধরে গেছে। শূন্যতায় বোঝা তোমাদের ঢাল। তাহলে কেন আর তোমরা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছো?

আসলে ভণ্ডামি হচ্ছে তোমাদের ধর্ম। মিথ্যাচার হলো তোমাদের জীবন। এবং অস্তিত্বহীনতা হচ্ছে শেষ। তাহলে বেঁচে আছো কেন? মৃত্যুই কি এখন একমাত্র আনন্দ নয়?

হে আমার দেশবাসী, জীবন হচ্ছে স্থির একটি সংকল্প। যৌবন তাকে সঙ্গ দ্যায়। অধ্যবসায় যাকে অনুসরণ করে। পূর্ণতা ও প্রাজ্ঞতা জরাগ্রস্ততার পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু তোমরা জন্মেছিলে বৃদ্ধ হয়ে। তোমাদের ত্বক বিবর্ণ, মস্তিষ্ক ছোট্ট হয়ে গেছে। এরপর তোমরা পরিণত হলে শিশুতে। কাদার ভেতর দৌড়লে এবং একজন আরেকজনের ওপর জড়ো করছে পাথর।

জ্ঞান হলো আলো। জীবনের তাপে যা সমৃদ্ধ। যারা এটা খোঁজে, ঠিকই তারা আলো খুঁজে পায়। কিন্তু হে আমার দেশবাসী, তোমরা খুঁজছ অন্ধকার। আর কে না জানে, অন্ধকার থেকে আলো সবসময়ই পালিয়ে যায়। সুতরাং অপেক্ষা করতে থাকো। দ্যাখো, পাথরের ভেতর থেকে কখন পানি বেরিয়ে আসবে।

তোমাদের প্রত্যেকের অপরাধেই আজ জাতির এ দুর্গতি। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করব না। কারণ, তোমরা জানো তোমরা কি করছ।

মানবতা হচ্ছে ছিপছিপে একটি নদী। যেতে যেতে গান গাইছে। সমুদ্রের হৃদয়ের কাছে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গোপনীয়তা। কিন্তু হে আমার দেশবাসী, তোমরা হচ্ছ বদ্ধ জলাশয়। সাপ ও পতঙ্গে ভরা।

আত্মা হচ্ছে ঐশ্বরিক নীল মশাল। জ্বলছে। গিলে ফেলছে শুকনো চারাগাছ। এবং ঝড়ের সঙ্গে বেড়ে উঠছে। আলোকিত করে তুলছে ঈশ্বরীদের মুখ। কিন্তু তোমরা? তোমাদের আত্মা ছাইয়ের মতো। বরফের ওপর বাতাস যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দ্যায়। এরপর উপত্যকার বুকে চিরকালের জন্যে ঝড় যাকে ছত্রভঙ্গ করে দ্যায়।

হে আমার দেশবাসী, আতঙ্ক মৃত্যুর প্রেতাত্মা নয়। কারণ তার ঔদার্য ও বিশালত্ব তোমার ক্ষুদ্রতার কাছে আসতে চাইবে না। ভয় করবে না ছুরিকে। কারণ, তোমার ক্ষুদ্র আত্মার ভেতর একমুহূর্তও সে থাকতে আগ্রহী নয়।

হে আমার দেশবাসী, আমি তোমাদেরকে ঘৃণা করি। কারণ তোমরা বিশালতা ও উদারতাকে ঘৃণা করো। আমি ঘৃণা করি তোমাদের, কারণ তোমরা নিজেদেরকেই ঘৃণা করো। আমি তোমাদের শত্রু, কারণ তোমরা যে ঈশ্বরীদের শত্রু, এটা তোমরা উপলব্ধি করতে চাও না।

লেখক পরিচিতি: পূর্ণ আরবি নাম জিবরান খলিল জিবরান, কহলিল জিবরান নামে তিনি পরিচিত। বর্তমান লেবাননের (তৎকালীন জাবাল লেবানন মুতাশরিফাত, উসমানীয় সাম্রাজ্য) উত্তরে বাশারি শহরে তিনি ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে তিনি তার পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। এখানে তিনি শিল্পকলা নিয়ে পড়াশুনা করেন ও তার সাহিত্য জীবন শুরু করেন। তিনি ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই লিখতেন। আরব বিশ্বে জিবরানকে সাহিত্য ও রাজনৈতিক বিদ্রোহী হিসেবে দেখা হয়। আধুনিক আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁয় তার রোমান্টিক ধারা ধ্রুপদি ধারা থেকে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষত তার গদ্য কবিতা। লেবাননে তিনি এখনও সাহিত্যের বীর হিসেবে সম্মানিত হন।


ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত তার ১৯২৩ সালের বই দ্য প্রফেটের কারণে পরিচিত। তার বইটি ১৯৩০ এর দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৬০ এর দশকেও তা জনপ্রিয় ছিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও লাউযির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের কবি। লেবানিজ এ কবি, লেখক ও শিল্পীর  মৃত্যু ঘটে ১০ এপ্রিল ১৯৩১। ‘হে আমার দেশবাসী’ ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাবানুবাদ করেছেন আবু তাহের সরফরাজ