কাজী নাসির মামুনের কবিতার পলিমাটি

মাহবুব ইসলাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩

Poetry is the language of a state of crisis! মালার্মে

এরকম একটা যন্ত্রণায় কবিতা জন্ম নেয় মনে। সে ভাবনা মন থেকে যখন বেরোয় তা আকার পায় সাদা পৃষ্ঠায়, একরকম ছিটকে বেরোয়, ঝাঁকুনি লাগে অকস্মাৎ। এ যেন দুর্ঘটনার মতো, অদৃশ্য শূন্য হতে হঠাৎ কালের দৃষ্টিতে তরঙ্গিত প্রবাহিনীর মতো। তারপর পাঠকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চালিত হয়। আবেগে, আবেশে আবিষ্ট হয়, প্রাণিত হয় পাঠক।

কবি নাসির মামুনের ‘মুহূর্তগুলো তরবারি’ এরকমই এক অদ্ভুত সৃষ্টি। দ্রোহ, যন্ত্রণা, স্মৃতিকাতরতা আর অপূর্ণতার আকুতি মৃত্যুর মতো ছটফট করা ‘সবুজ পাতা’র মতোই মনোরম মনোটনাস রোমান্টিক বয়ান।

 

কবি বহুল প্রচলিত উপমা ও অনুষঙ্গ ভেঙে বিনির্মাণ করে কবিতাকে দেখতে চেয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। কবির প্রথম কবিতায় নিজস্ব স্বর ও সুরের এক মরমী তাল পাঠকের হৃদয় নিংড়ে তোলে। কবির উপমা আর অনুষঙ্গের অভিনবত্বে চকিত হতে হয়। শব্দের চিরায়ত অর্থের মিথকে ভেঙে দেয়। তখন খুবই সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে কবিতা।

কয়েকটি উদাহরণ, পাতা এক নিবিড় সবুজ হাহাকার, নীরবতা কবরের স্পর্ধা, ডালে ডালে হলুদ বেদনা, সূর্যকে ভাবতে শিখি আলোর দালাল এবং মায়াবি গরুর চোখে পৃথিবীর সব মধু বোবা হয়ে আছে।

জীবন ও প্রকৃতির প্রতি এই নঞর্থক ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ব্লাকের কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। রোমান্টিক কবিদের মাঝে মৃত্যু বিষাদময় কিছু নয়। বরং এক অমৃত স্বাদ যা জীবনের চেয়েও মোহময়। সেই মরমী আকুলতা প্রকাশ পায় কাজী নাসির মামুনের কবিতায়:

আাহ পাতা!
নিঝুম মৃত্যুর দিকে আমাকেও সঙ্গে নিও।
সবুজ প্রলেপ নিয়ে ঝরে যেতে
আমি এক পাতা হতে চাই।

Solitude is the profoundest fact of the human condition. Labyrinth of solitude এ অক্টাভিও পাজের অমোঘ সত্যটা বারবার স্মরণে আসে। মানুষ মূলত একা। বরং মানুষের সব সম্পর্ক আসে আরও নিঃসঙ্গ করতে। কবি নাসির মামুনের পঙক্তিগুলো আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে জীবনের জটিল সমীকরণ নিয়ে:

বস্তুত সম্পর্ক এক জটিল পুরাণ।
মানুষ গল্পের ক্রীড়নক হয়ে ব্যর্থতার করাল সত্যকে
একদিন নিজের সঙ্কটে বুঝে ফেলে;
দেখে, কেউ তার সঙ্গে নেই।

সম্পর্কের তাঁবু নামের কবিতায় একই জিনিসের অনুরণ ঘটে:
লিখতে গেলে মনে হয়,
না-লেখা জীবনটাই আসল; যা কিছু
ঊষর, কখনো
শষ্যযোগ নয়।

কীটসের ওড টু নাইটিংগেল কবিতার মতো fade far away and dissolve তার কবিতায় একদিকে যেমন সব বন্ধন, মোহমায়া কাটিয়ে পাতাদের সাথে বিলীন হবার আকুতি দেখি, আবার সবকিছুর পর মানুষের কাছেই ফিরতে হয়, এটাও মেনে নিতে দেখি। মানবের মুক্তি নেই man is condemned to be free

কবির প্রেমময় মন থেকে উৎসারিত হয়:
মাতাল বাসনা ছিল আমারও; ভেবেছি
লোমশ আদর পেলে
একটা বিড়াল হব নারীর মুঠোয়।

তবে এই বাসনা ক্ষণস্থায়ী, ম্রিয়ম্রাণ ঠিক কীটসের নাইটেঙ্গেলের মতো।
বিভোর বাতাসে নড়ে; তবুও
চকিতে পাখির মতো উড়তে পারে না।

মূলত পাতার জীবনের সাথে কবি emphatically নিজেকে তথা সমগ্র মানুষের জীবনকে একাত্ম করার একটা প্রয়াস করেছেন। এবং কবিতায় বাঙ্ময় করে তুলেছেন মানব আত্মার গোপন দস্তাবেজ। এলিয়ট অবশ্য এর নাম দিয়েছেন transfer epithet

একটা ইনএনিমেটেড বস্তুর ভেতর প্রাণ সঞ্চার করা। তাছাড়া কবি ও বিজ্ঞানীদের চোখে তো সবই জীবন্ত ও গতিশীল। হয়তো এজন্য জগদীশ বসুও বলেছিলেন, নদীও একটি গতিশীল জীব।

কবি নাসির মামুন সবুজ পাতার মাঝে শুধু বর্ণরঞ্জক পদার্থ ক্লোরোফিল দেখতে পাননি, পাতারও যে একটা বিষাদময় উপখ্যান আছে মানুষের মতো সেটাকে উপলব্ধি করেছেন তার প্রজ্ঞা ও মরমী দৃষ্টি দিয়ে।

মুহূর্তগুলো তরবারি কবিতাটিতে কবির মিতব্যয়ী শব্দচয়ন, বুনন আর উপমা অনুষঙ্গের ব্যবহার অসাধারণ। তরবারি শব্দটি তার আপাত আভিধানিক অর্থের পোশাক ছেড়ে ভিন্নার্থকতার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্র যে একটা পুঁঝজিবাদের জালে আটকে রেখেছে মানুষকে, নিয়মের, শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছে মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিকে, কবি এই দিকটায় আঙুল তুলে দেখিয়েছেন। সাধারণ মানুষ সমঝোতা করে চলছে আর রাজা সিসিফাসের মতো পাথর বয়ে বেড়াচ্ছে। একগুঁয়ে, ক্লান্ত, রুটিনবাঁধা এই জীবন।

there is no exit কবির ভাষায়:
জাতি, রাষ্ট্রপুঞ্জ বলে যা কিছু ভেবেছি
নিয়ত সঙ্ঘের এই মৃত চরাচরে
পুঁজির পাথরে চাপা মানুষ মূলত
অসাম্য-ছত্রাক; ক্ষমতার
নির্দয় দেয়াল-ঘেঁষা তিক্ত পরজীবী।

তবে এই নিগড় ভাঙার কোনও ক্ষমতা নেই মানুষের। শুধু মানিয়ে নিয়েই চলছে মানুষ। এজন্যই কবির অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়:
যখন মুহূর্তগুলো তরবারি
ধারালো প্রান্তের দিকে কঠোর৷ হলেই
মানুষ নিজেই কাটা পড়ে।

তবে মানুষই মুহূর্তগুলোকে তরবারির মতো বিভীষিকাময় করে তুলেছে। মানুষ ওপরে উঠতে গিয়ে সবই পাচ্ছে, মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকার উৎসাহ।

অথচ সামান্য পাখি
একমুঠো বিনীত শরীর
উদ্ধত বাতাসে রেখে
গাছের ডালেই বসে থাকে।
অনন্তের সবুজ দয়ায়
তুষ্টির বিপক্ষে নেই সরল পাতাও।

বৃষ্টি-ভেজা বিড়ালের একান্ত জগৎ
নিভৃতির পরম আলোয়
কোন ইশারায় জেগে থাকে
নত বেদনায়
সকল সঙ্কটে নিরুত্তাপ?

কবি নাসির মামুন এভাবেই প্রতিটি কবিতায় সমবায়ী শব্দের সমম্বয়ে তৈরি করেছেন মায়াবী স্বাক্ষর। একদিকে তার কবিতার ধূসর জগৎ যেমন আধো চেনা আধো অচেনা, যা কল্পনাপ্রবণ করে পাঠককে করে তুলতে পারে সৃজনশীল, তেমনি তৈরি হতে পারে এক মায়বাদ, সুফির জগৎ। যা পুরোটাই অধরা। এক একটা পাতার ধমনী থেকে কেঁপে ওঠা স্বর পাঠকের মনে এমনভাবে দোলা দেয় যেন দীর্ঘদিনের ধুলোপড়া তানপুরায় পড়েছে কোন তানসেনের হাত। এমনই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নাসির মামুন। কবিতায় এটাই তো পরম চাওয়া একজন পাঠকের।

ভালোবাসার সাথে ভয়, দূরত্ব, বিচ্ছেদ, দহন সবকিছুই যে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত সেটা আমরা `মারি ও মহাস্মৃতিকাল` কবিতাসহ আরও অনেক কবিতায় পাই। বরং মানুষ একজীবনে ভালোবাসার চেয়ে হারানোর ভয়েই বেশি সময় পার করে দেয়। প্রেম আসলে এক দুইধারী তলোয়ার। একদিকে পুড়ে আরেকদিকে শান্তি পায়। কবি বলেন:

ছোঁয়াছুঁয়ি ভালোবেসে
সূর্যের আগুন ফোটে শরীরে সবার।
মানুষ পোড়ায়;
পুড়ে পুড়ে শান্তি পায় নিজের ভেতর।

আবার:
বন্ধনের মোহস্রোতে
গড়িয়ে পড়ছে ভয়; সম্পর্ক মানেই
মলিন ফারাক, এক ধূর্ত সুদূরতা;
মনের গভীরে কেউ নাই।

কবি নাসির মামুনের প্রত্যেকটা কবিতার পরতে পরতে আছে দর্শনের ছোঁয়া। কান্ট যেমন বলেন, আমরা বস্তু সম্পর্কে শুধু ধারনা পাই। আর সেটা একেক জনের একেক রকম। কেননা, হিউম তো বলেছেন, মন হলো সংবেদনশীলতার সমষ্টি। মহাবিশ্বে সুখ বা দুঃখ এমন আলাদা কোনও কিছুই নেই। সবই হলো প্রত্যেকটা জিনিস এমনকি মানুষের সাথে একটা মনস্তাত্ত্বিক ও সংবেদনশীলতার সম্পর্ক। যা সুখ, দুঃখ, আনন্দ ও ভয়ের উৎস। এর প্রতিফলন পাই মামুনের কবিতায়, পৃথিবীর সুখ আনে চোখের বিভ্রম। অথবা, পৃথিবীর সবকিছু দৃশ্যখোপ/সব দৃশ্য নিজে নিজে কারাগার/অতন্দ্র পাহারা দেয় রঙের লেঠেল/তবুও ঢুকে পড়ি; দৃষ্টি/অবারিত ঘুষের বান্ডেল। আবার: নাকি সব সৌরব্যাধি? হাওয়াই মিঠাই/সবাই চোখের মধ্যে খাঁচা নিয়ে ঘুরি?

বিষয়টা প্যারাডক্সিক্যাল যদিও। মানুষ এই ভ্রম, মায়াজালে জেনে শুনেই বন্দি হয়। মূলত জগৎটা এমনই। মানুষের যেমন প্রয়োজনবোধ রয়েছে তেমনি দূর মিছে জ্যোৎস্নার আলোয় মনের ভুবন রাঙিয়েও নিতে চায়। মানুষের রয়েছে এক অদ্ভুত aesthetic sense. তাই তো বলতে শুনি:

এইসব দৃশ্যের বৈরিতাই
পরিধির বিন্দু বিন্দু গ্রামে
নিসর্গের অনন্ত ডাকাত।
আমাদের বিদেহী মনেও হানা দেয়;
শরীর সেঁধিয়ে যায় রোদের প্রপাত
যখন বেরিয়ে পড়ি। ভ্যান চলে।
চাকার পৃথিবী গোল হয়ে ঘোরে।

পরিশেষে বলা যায়, কবি নাসির মামুনের কবিতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনাকে মোহাবিষ্ট করে রাখবে। খুব ধীরে ধীরে ছোট তরঙ্গের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চেনা জানা এই পৃথিবী থেকে অন্য কোথাও। শব্দের তিমিরে ডুব দিয়ে খোঁজ মিলবে এক মরমী জগতের, মৃত্যু আর জীবনের দোলাচালে এক অমোঘ সত্য দর্শনের।

একুশে বইমেলা ২০১৮