কামরুল আহসানের গদ্য ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস: অনন্তকালের দীর্ঘশ্বাস’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২০

বিরান এক প্রান্তর, কাকতাড়ুয়ার মতো দঁড়িয়ে আছে একটি কালো কোট, কোটের আড়াল থেকে বেরোয় একতোড়া ফুল, একটু পর সুন্দর এক নারীমুখ, গভীর মমতায় সে জড়িয়ে ধরে কোটটিকে। হঠাৎ গুলির শব্দ! কারো হয়তো মনে পড়তে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার লাইন―

আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

হয়তো গুলির শব্দ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো এ-দুঃস্বপ্ন। ঢাকার শহরের সুন্দর এক বাড়ির সুন্দর এক ঘরে সুন্দর এক ভোরে ঘুম ভাঙে সুন্দর সেই মেয়েটির। ব্যস্ত শহরে একদিন সে আবিষ্কার করে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন একটি ছেলে। এত যে হট্টগোল চারদিকে, তার দিকে তার খেয়ালই নেই। হয়তো ছেলেটির ওই তন্ময় ভাবটুকুই ভালো লাগে মেয়েটির। একদিন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েই ছেলেটি চা খাচ্ছিল, মেয়েটিও এক গ্লাস চা হাতে তার পাশে দাঁড়ায়, আবার বলে, এভাবে রাস্তাার মাঝাখানে দাঁড়িয়ে কেউ চা খায়! ছেলেটি পকেট থেকে দুটো টোস্ট বিস্কিট বের করে, একটা দেয় মেয়েটিকে, আরেকটা খায় নিজে, চা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে খেতে দুজন হাঁটা ধরে শহরের পথে।

হয়তো এ-ও নিছক এক স্বপ্ন। মেয়েটি তার যে-বান্ধবীর সাথে ছেলেটির গল্প বলে সেই বান্ধবটি অবাক হয়ে বলে, কই পাস তুই ছেলে, তুই তো থাকিস সারাক্ষণ আমার সাথেই, কাউকে তো দেখি না তোর আশপাশে। আরেক বন্ধু বলে, মাস্টার্স শেষ হতে চলল, এখনো কোনো প্রেম হলো না তো ওর, তাই মনে মনে প্রেমের গল্প বোনে!

একদিন সেই ছেলেটির খবর আসে পত্রিকাতে। পত্রিকার বিশেষ একটি সংখ্যায় তাকে নিয়ে কাভার স্টোরি করেছে। কারণ, ছেলেটি গোপনে গোপনে বহুমানুষকে সাহায্য করে। বহু অসহায় মানুষের চিকিৎসার ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। সে কাজ করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে। ছেলেটিকে খুঁজে পেতে মেয়েটির এখন খুব সহজ হয়। পুরনো ঢাকায় সে থাকে। একদিন বান্ধবীকে নিয়ে তার ঠিকানা চিনে আসে।

তারপর বাবার গাড়ি ধার করে ছেলেটিকে বাইকের পেছনে পেছনে ঘুরে সারাদিন ধরে সারা শহর। একদিন মেয়েটি গিয়ে ছেলেটির সামনে দাঁড়ায়। বলে, অয়ন, আমি নীরা!

অয়ন তো চিনতে পারে না তাকে। নীরা ব্যাগ থেকে বের করে চায়ের বোতল, মগ ও দুটো টোস্ট বিস্টিক। অয়ন প্রথমে হয় অবাক, পরে হয় বিরক্ত। পত্রিকার একটা খবর আসার পর থেকে তার জীবনটা ঝালাপালা হয়ে গেছে। কেউ চায় তাকে দিয়ে ওষুদের বিজ্ঞাপন দিতে, কেউ শ্যাম্পুর আর এখন একজন হাজির হয়েছে বিস্কুটের বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে! এরকমই সে ভাবে, এবং নীরাকে একা ফেলে হনহনিয়ে চলে যায়।

নীরা অবশ্য তার পিছু ছাড়ে না। একদিন তাকে ঠিকই কব্জায় আনে। পুরো গল্পটা আমি অবশ্য ধারাবাহিকভাবে বলব না। এটা একটা কবিতা, এর বর্ণনা দেয়া সহজ নয়।

দুই.
মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের চলচ্চিত্র দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করছি প্রায় বারো-চোদ্দ বছর ধরে। তখন তার অসামান্য একটি টেলিফিল্ম দেখেছিলাম, ছায়াফেরী। স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন নিয়ে গল্প। ইনসেপশন তখনো বের হয়নি। টেলিফিল্মটি দেখে আমার মনে হয়ছিল, সম্পূর্ণ একটি চলচ্চিত্র। ওই গল্পটি নিয়েই কেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল তখনই চলচ্চিত্র তৈরি করলেন না, তা কে জানে!

বাংলাদেশের অনেক নির্মাতাই অসামান্য কিছু টেলিছবি বানিয়েছেন। এমন কি, তাদের টেলিছবিগুলো তাদের নির্মিত চলচ্চিতগুলোর চেয়েও ছিল অনেক অনেক গুণ ভালো। অনায়াসেই আমি কয়কজনের নাম নিতে পারি, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, নুরুল আলম আতিক, অনিমেষ আইচ এবং মাসুদ হাসান উজ্জ্বলও।

উপরোক্ত নির্মাতাদের টেলিছবি দেখে যত মুগ্ধ হয়েছি চলচ্চিত্র দেখে তত মুগ্ধ হতে পারিনি। মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দেখে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু তার ‘ছায়াফেরী’ বা ‘যে-জীবন ফঙিংয়ের, দোয়েলের’ দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার কাছে যতটা প্রত্যাশা ছিল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দেখে।

একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ মানে শুধু গল্প বলা নয় নিশ্চয়ই। অভিনয়, পোশাক, দৃশ্যধারণ, বিশেষত আলোর ব্যবহার সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ যেমন, তেমনি কোনোটা একটু খামতি হলে পুরো ব্যাপারটাই মাঠে মারা যেতে পারে। বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র পরিপূর্ণ না হয়ে উঠতে পারার যে ব্যর্থতা তা কেবল নির্মাতার নয়, তার জন্য আমাদের জাতিগত অস্থিরতা, শিল্পের প্রতি উদাসিনতা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক দুর্বলতাও বিশেষভাবে দায়ী। এ দেশে চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াসলি সমালোচনাও হয় না। ১৪-১৫ বছর আগে দু’চারটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা বের হতে দেখতাম, এখন তাও দেখি না।

এখন সবকিছু আমাদের ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ। একটি বই বা চলচ্চিত্র প্রকাশিত হলে কাছের লোকজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফেসবুকে দু’এক ছত্র প্রশংসাবাচ্য লিখে উৎসাহ যোগায়। হায়, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের শিল্প এখনো কেবল উৎসাহযোগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ!

আমি খুব সিরিয়াসলি ঊনপঞ্চাশ বাতাসের একটি সমালোচনা লেখার কথা ভাবছি।

তিন.
ছবির কয়েকটা সীমাবদ্ধতার কথা আগে বলে নিই। পুরো ছবিতে একটা তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা গেছে। নাটকের শটকাটিংয়ের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি অনেক দৃশ্যে। পুরো গল্পটি এক জায়গায় ঘুরেছে। ফলে কিছুটা একঘেয়েমি জাগানো অসম্ভব নয়।

নায়িকার অভিনয়ে প্রথম দিকে কিছুটা জড়তা ছিল বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে দুষ্টমি করার সময়। হাত ছোড়াতে নায়িকার একটু জড়তা আছে। চোখ নাড়াতে ততটা ছিল না। যদিও পরে তা তিনি যথেষ্ট ভালোভাবেই সামলে নিয়েছেন। আর এরকম একটা গল্পে অভিনয় করা খুব সহজ কথা নয়।

অসামান্য অভিনয় করেছেন নায়ক ইমতিয়াজ বর্ষণ। যদিও নায়িকার দাপটে তিনি অনেকটা ম্লান। কিন্তু যে-চরিত্রের জন্য তাকে বাছাই করা হয়েছে, শান্ত, সৌম, নিষ্পাপ একটি চরিত্র, চোখে-মুখে, চাউনিতে, কথায়, প্রতিট শব্দের ডেলিভারিতে, প্রতিটা অঙ্গ-ভঙিতে বর্ষণের তা ছিল। আমি সত্যিই বিহবল হয়েছি তার অভিনয়ে, অভিনয় সম্পর্কে যতটুকু বুঝি, তা দিয়ে ভবিষ্যৎ-বাণী করতে পারি, বাংলাদেশ একজন অসামান্য অভিনেতাকে পেল।

নায়িকা শারলিন ফারজানা যে-চরিত্রে অভিনয় করেছেন, পুরো ছবিটা আসলে তাকে একাই টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে। তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য নীরা চরিত্রটার সাথে মানানসই ছিল। আমার কাছে কিছু সমস্যা মনে হয়েছে তার ডায়লগ থ্রোতে, আর কিছু হাত নাড়ানোতে তিনি খুব একটা সাবলীল ছিলেন না। হয়তো তার হাত অধিক লম্বা বলেই। অনেকে ভাবতে পারেন, সব থুয়ে আমি এমন হাত নিয়ে পড়লাম কেন! আসলে অভিনয়ের সবচেয়ে জটিল জায়গা মনে হয় ওই হাত দুটোই। হাত দুটো প্রচণ্ডভাবে প্রকাশিত, আর কখন তারা কী করবে তা যেন স্বয়ং মানুষটিও বুঝতে পারে না। একজন ভালো অভিনেতা সবচেয়ে দক্ষভাবে সামলায় তার দুটো হাত!

তবে শারমিলের এ ব্যর্থতার ভার আমি তার কাঁধে দেব না। দেব পরিচালকের কাঁধেই। একটি চলচ্চিত্র ব্যর্থ হওয়ার সব দায় একমাত্র পরিচালকের কাঁধেই বর্তায়। শুধু শারলিনের ওটুকু হাত নাড়ানোর কারণেই কি চলচ্চিত্রটি ব্যর্থ হলো! কিংবা চলচ্চিত্রটি কি আসলে ব্যর্থ হয়েছে? একটি সার্থক চলচ্চিত্র নির্ধারণের মানদণ্ডই-বা কী! এই তর্কে আমি এখন যাব না। চলচ্চিত্রটির অন্য কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করি।

এই ছবিতে এমন কিছু বিষয় আছে যা শুধু ‘টেক্সট’ হিসেবেই আলোচনাযোগ্য। যেমন, সামর্থও যে হতে পারে অসহায়ত্ব তা নিয়ে। যেমন, মৃত্যুর বিপরীতে ভালোবাসা কী তা নিয়ে। যেমন, কিছু না থাকার বদলেও যেসব আছে তা নিয়ে। এই চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে আমি বলবো, গিলগামেশ মহাকাব্যের কথা। গিলাগামেশ তার বন্ধু এনকিদুকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে ওঠে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যায় মৃত্যুকে জয় করতে। মৃত্যুসায়র পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সে এই খবর নিয়েই ফিরে যে, মৃত্যুর হাত থেকে কারো রেহাই নেই, আর ওপারের জগৎ থেকে কেউ ফিরে আসে না।

অয়নকে হারিয়ে নীরা পাগলের মতো হয়ে যায়। কী করে মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায়, এই নিয়ে সে গবেষণা করতে থাকে। সত্যিই একদিন আবিষ্কার করে ফেলে সেই সঞ্জীবনী― না, মন্ত্র নয়, সূত্র! বৈজ্ঞানিক সূত্র। কীভাবে ডিএনএ, জিন থেকে নতুন মানুষ আবিষ্কার করা যায় তার সূত্র। একদিন ঠিকই কবর থেকে উঠে এসে হাজির হয় অয়ন! আহা, তার ভালোবাসার ধন, তার সমগ্র জীবন, সত্যিই কি সে এসেছে!

বন্ধুরা, আমি আর গল্পটি বলবো না। চলচ্চিত্রটি দেখবেন। দেখলে আপনার ভালোবাসার মানুষকে আরেকটু গভীরভাবে আপনি জড়িয়ে ধরবেন। যেমন আমি ধরেছি সোহেলীকে, ছবিটি দেখে সে যখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। এ-ছবি আমাদের আত্মার গোপন কান্নার। আরেকটা কথা না বলে পারছি না, স্টার সিনেপ্লেক্সের সাউন্ড কোয়ালিটি খুব বাজে। মধুমিতা বা বলকায় এ সিনেমা দেখলে নিশ্চয়ই অন্যরকম অনুভূতি হবে। স্টার সিনেপ্লেক্স আসলে সিনেমা দেখার জায়গাই না। এতটুকু হল, অন্ধকারও হয় না ঠিক মতো, মানুষের পপকর্ন চিবানোর আওয়াজ পাওয়া যায়, এর মধ্যে এ ধরনের সিনেমা দেখা যায়!

ভালোবাসা প্রিয় মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। ভালোবাসা আপনার পুরো টিমের প্রতি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক