কাস্ত্রো ও বাংলাদেশের পাট

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০২০

ফিদেল কাস্ত্রোর জন্মদিন ছিল গত কালকে। কাস্ত্রো কিউবার লোক, নিপীড়িত মানুষের লোক। তাই আমাদেরও লোক, কাস্ত্রো আমাদের নেতা। আজ দুনিয়ার সাধারণ মানুষ যে স্বাস্থ্যসেবার দাবিতে আওয়াজ তুলছ, কিউবা এরইমধ্যে তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাই এই করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দুনিয়ার যে-কোনো আলাপে বারবার কিউবার নাম উঠে আসছে। ফিদেল-চে`দের হাত ধরেই এই কিউবার উত্থান হয়েছিল ৭০এর দশকে।

 

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ এবং কিউবার মধ্যে বিস্তার ভৌগোলিক/রাজনৈতিক/সামাজিক দুরত্ব থাকলেও কিউবার নামের সাথে বাংলাদেশের পাট শিল্প কিছুটা হলেও জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের পাট শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ না করতো তাহলে বাংলাদেশের পাট শিল্প হয়তো অন্য অবস্থানে থাকতো। সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে এভাবে ধ্বংস হতো না। যদিও শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই বাংলাদেশের পাট শিল্প ধ্বংস হয়েছে এমন কথা বলা যায় না সরাসরি, কিন্তু ৭৪`এর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পাটে ব্যপক প্রভাব ফেলেছিল।

 

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-কিউবার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের ততকালীন রাষ্ট্র প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলোচনাও হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে কিউবাতে পাটের থলে রফতানির চুক্তি করে বাংলাদেশ। শুধু কিউবা না, আন্তর্জাতিক পাটের বাজারে বাংলাদেশ প্রবেশ করছিল এই চুক্তির মধ্যদিয়ে। কিন্তু কিউবার সঙ্গে এ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধাদেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত খাদ্য সহায়তাবাহী জাহাজ আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল- কিউবায় বাংলাদেশের পাট রফতানির নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সহায়তা দিতে পারবে না।

 

এদিকে ৭৪`র জুলাই-আগস্টে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। ইতিহাসের ভয়াবহতম এক দুর্ভিক্ষের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। এবং এই দুর্ভিক্ষের পিঠে ভর করেই যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো কিউবার সঙ্গে পাট চুক্তি বাতিল করে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে এই দুর্ভিক্ষ ছিল শুধুমাত্র "আইওয়াশ"। চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনই ছিল প্রধান, মূল কারণ। ৭৪ সালে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

 

৭৪ নিয়ে নানা আলাপ আছে, নানামুখী মতামত আছে। কিন্তু কিছু সোজা কথাও আছে। সেক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ার তথ্য অনেক সহজলভ্য এবং সাধারণ তথ্য হিসেবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য।

 

উইকি বলছে, "১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণায় বিভিন্ন পণ্ডিতরা দেখতে পেয়েছেন যে ১৯৭৪ সালে গড় খাদ্যশস্যের উত্পাদন ছিল `স্থানীয়ভাবে সর্বোচ্চ`।[১৫][১৬] এ কারণে পন্ডিতদের যুক্তি, "১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে, খাদ্যের প্রাপ্যতার উপলব্ধতা দুর্ভিক্ষ নিয়ে যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয় না"।পৃ. ১৪১ তারা যুক্তি দিয়েছেন যে, খাদ্যের প্রাপ্যতার ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়নি বরং বিতরণ ব্যর্থতার কারণে হয়, তখন একদল "বাজারে খাবারের উপরে আধিপত্য স্থাপন" করেছিল।পৃ. ১৬২"

 

বাংলাদেশের আরেকজন অর্থনীতিবীদ রেহমান সোবহানও প্রায় একই মতামত দিয়েছিলেন (হাতে না থাকায় তার বইয়ের আলাপে যাওয়া সম্ভব হলো না)। মোটাদাগে দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনিও একই বক্তব্য দিয়েছিলেন। কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিল না বাংলাদেশ।

 

মুক্তিযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কাদের পক্ষে এবং কাদের বিপক্ষে গিয়েছে, সে আলাপ আরো স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। আমরা সাধারণ মানুষরা এভাবেই ইতিহাস পাঠ করি।

 

অন্যদিকে, দুর্ভিক্ষের আলাপ তুলে এখনো সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষেই গান গাওয়া হয়। কাস্ত্রোদের আদর্শকে ছোট করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্যায় মাত্রই অন্যায়। কাস্ত্রো ন্যায়ের পক্ষে ছিল, ইতিহাস তাকে মুক্তি দিয়েছে আর আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। কতো দ্রুত শিক্ষা গ্রহণ করি সেটাই দেখার বিষয়।