কোভিড ১৯ এবং বর্তমান পরিস্থিতি

ডা, মনিকা বেগ

প্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২০

চীনের প্রথম ৪২৫ জন আক্রান্ত ব্যক্তির বিস্তারিত ক্লিনিকাল বর্ণনা থেকে জানা যায়, আক্রান্তদের মধ্য বয়স ছিল ৫৯ বছর। রোগীদের মধ্যে ৫৬% ছিলেন পুরুষ। আক্রান্তদের মধ্যে যাদের বয়স বেশি এবং যারা আগে থেকে অন্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছিলেন (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস), তাদের মধ্যেই কোভিড ১৯ সংক্রমণের তীব্রতা এবং মৃত্যুহার বেশি ছিল। এদের মধ্যে একজনও ছিল না যার বয়স ১৫ বছরের নিচে।

এর দুটি কারণ হতে পারে। হয় কোভিড ১৯ দ্বারা বাচ্চাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, অথবা বাচ্চাদের মাঝে রোগের লক্ষণগুলি এতটাই হালকা ছিল যে, তাদের সংক্রমণ শনাক্ত করা যায়নি। কোন করোনা ভাইরাস কত তাড়াতাড়ি এবং কত দক্ষতার সাথে শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তার ওপর ভিত্তি করে সেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী কৌশল এবং পন্থা নির্ধারণ করতে হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, কোভিড  ১৯ তে আক্রান্ত হওয়ার পর, প্রথম কয়েকদিনে উপসর্গ গুলো খুব কম থাকে। কিন্তু সেই সময় আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের ভেতরে এবং গলার উপরিভাগে এই ভাইরাসের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি থাকে। যার ফলে ওই প্রথম কয়েকদিনে একজন কোভিড ১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি খুব সহজেই একজন অনাক্রান্ত ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে। কোভিড ১৯ এর প্রসার রোধে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

অস্থায়ী ভিত্তিতে এই ধরনের বিধিনিষেধগুলি ভাইরাসের বিস্তারকে কমিয়ে দিতে সহায়তা করতে পারে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনে আরও কিছু বিধি নিষেধ পালনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন সামাজিক দূরত্ব, বাড়িতে স্বেচ্ছা নির্বাসন, যে কোনো জনসমাগম স্থগিত করা, যখন সম্ভব বাসা থেকে অনলাইনে কাজ করা ইত্যাদি।

কোভিড ১৯ যেভাবে ছড়ায়
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অথবা হাঁচি-কাশির সময় যে ছোট ছোট কণিকা (ড্রপলেট) বের হয়, তার মাধ্যমে সরাসরি ছড়ায়। অনেক সময় ওই ড্রপলেটগুলো আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের জিনিসপত্রের উপরও পড়ে। সেই জিনিসপত্র যদি একজন অনাক্রান্ত ব্যক্তি ধরে, হাত না ধুয়ে সেই হাত যদি তার নাকে, মুখে, চোখে দেয়, তাহলেও সেই অনাক্রান্ত ব্যক্তি কোভিড ১৯ তে আক্রান্ত হতে পারে।

কোভিড ১৯ এর প্রতিরোধ
১. ঘন ঘন এবং নিয়মিত হাত ধুতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৯০% মানুষ সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয় না। অনেক সময়ই হাতের বুড়ো আঙুল এবং আঙুলের মাথাগুলো বাদ পড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ভিডিও লিংক আছে, সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয়ার উপরে: https://youtu.be/3PmVJQUCm4E

২. কাজের জায়গাতে অথবা সামাজিক অনুষ্ঠানে সহকর্মী, বন্ধু, রোগী বা ক্লায়েন্টের সাথে করমর্দন, কোলাকুলি এবং গালে চুমু (যেটি পশ্চিমা বিশ্বে, বন্ধু মহলে বেশ প্রচলিত) দেয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।

৩. হাঁচি-কাশি দিচ্ছে এমন কারো কাছ থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

৪. অকারণে নিজের চোখ, নাক এবং মুখে হাত দেয়া বন্ধ করতে হবে।

৫. হাঁচি-কাশির সময় কনুই দিয়ে অথবা একবার ব্যবহার যোগ্য টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে এবং অন্যদেরও ঢাকতে বলতে হবে। ব্যবহারের পরে টিসু আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিতে হবে, যাতে অন্য কারোর সংস্পর্শে সেটি না আসে।

৬. করোনা ভাইরাসগুলো সাধারণ রান্নার তাপমাত্রায় (৭০°সেন্টিগ্রেড) বেঁচে থাকতে পারে না। সুতরাং একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে কাঁচা বা অল্প রান্না করা খাবার এড়ানো উচিত। কাঁচা মাংস, কাঁচা দুধ, কাঁচা ডিম বা কাঁচা মাছ রান্না করার সময়ও সাবধান হতে হবে।

৭. শরীর খারাপ লাগলে বাড়িতে থাকতে হবে।

৮. কিন্তু জ্বর, কাশি এবং শাসকষ্ট থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বা হেল্পলাইন থাকলে সেখানে ফোন করতে হবে।

কোভিড ১৯ এর লক্ষণ এবং উপসর্গ
কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষেরই লক্ষণ এবং উপসর্গ খুব হালকা হয়। আবার কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। প্রায় ৮০% রোগী কোনো চিকিৎসা ছাড়াই পুরোপুরি সেরে ওঠে। সবচেয়ে বেশি যে উপসর্গগুলো দেখা যায় তাহলো, জ্বর, ক্লান্তি ও শুকনো কাশি। কারো কারো সর্দি, গলা ব্যথা, শরীরে ব্যথা এবং ডায়রিয়াও হতে পারে। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে, যেমন যাদের বয়স বেশি এবং যারা আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছে, এটি কঠিন রূপ নিতে পারে। তবে যদি জ্বর, কাশি এবং শাসকষ্ট থাকে তার বয়স যাই হোক না কেন বা অন্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা না থাকলেও তাকে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

কোভিড ১৯ এর চিকিৎসা
আক্রান্ত দেশগুলোতে ডাক্তাররা কোভিড ১৯ এর লক্ষণ এবং উপসর্গের চিকিৎসার সাথে সাথে, প্রয়োজনে বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যেমন- লোপিনাভির–রিটোনাভির, ইন্টারফেরন -১β, আরএনএ পলিমেরেজ ইনহিবিটর রেমডেসিভির, ক্লোরোকুইন এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষুধ ব্যবহার করছে। পরবর্তীতে সফল গবেষণা সাপেক্ষে হয়তো আরও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন হবে।

আমাদের সবারই মাথায় রাখতে হবে যে, এই সংক্রামক ব্যাধিগুলো আগেও এসেছে, আবারও আসবে। এর জন্য আমাদের তৈরি থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সেই তৈরিটা যেমন ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে হতে হবে, তেমনই জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও হতে হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে, ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়াদেরও বিশ্বায়ন হয়েছে। কারোর একার পক্ষে বা কোনো একটি দেশের পক্ষে এই বিপদ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আমরা যত তাড়াতাড়ি এটি বুঝবো, তত তাড়াতাড়ি মানবজাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবো।

লেখক: চিফ এবং গ্লোবাল কোঅর্ডিনেটর
এইডস সেকশন, জাতিসংঘ সদর দপ্তর
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া