করোনাকালে দু’ভাগে বিভক্ত দেশের মানুষ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ০২, ২০২০
বাংলাদেশের মানুষ করোনাকালে স্পষ্ট দুটো শিবিরে বা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যার একদিকে আছে, লকডাউনের পক্ষের মানুষ যাদের খাওয়া-থাকার চিন্তা নাই। মাসের পর মাস তারা ঘরে বসে থেকে নিশ্চিন্তে আহার জোগাতে পারে। স্বচ্ছল এরকম মানুষের বিপরীতে আরেক পক্ষ আছে, যাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এত তীব্র যে, করোনা ভাইরাস নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তাদের নেই। লকডাউনে ঘরে বসে বসে নিশ্চিন্তে খাবার মুরোদ নেই তাদের। অনেকের আবার সামান্য মাথা গোঁজবার আশ্রয় পর্যন্ত নাই। করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকার চেয়ে না খেয়ে মরে যাবার ভয়টা তাদের বেশি কাজ করে। সমাজে তাদের এমন ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠা নেই যে, ঘরে বসে থাকলে কেউ তাদের খাবার দিয়ে আসবে, নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেবে। সাদামাটাভাবে করোনাকালের এই হলো দুটো পক্ষ; যারা লকডাউনের জন্য হাহাকার করছে, অন্য পক্ষ করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত নয়; বরং আতঙ্কিত তাদের জীবিকা নিয়ে। কারণ নানাভাবে অতিরিক্ত আয় করে তারা কিছু সঞ্চয় করে রাখতে পারেনি যে, দু’এক সপ্তাহ ঘরে বসে নিশ্চিন্তে খেতে পারবে। বরং সন্তানের লাশ ফেলে বা পরিজনের লাশ ফেলে তখনি কাজের সন্ধানে তাদের অনেককে বের হয়ে পড়তে হয়। করোনার জন্য আতঙ্ক প্রকাশ দূরের কথা, সবচেয়ে প্রিয় আপনজনের জন্য শোক প্রকাশের অবসর তার নেই। ফলে লকডাউন যারা চায়, আর যারা চায় না, তারা যে আলাদা দুটি অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বাস করে, এ নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাই মূলগতভাবে তার জীবনযাপন আর সকল কার্যক্রম বা পন্থা নির্ধারণ করে দেয়। প্রশ্ন আসতে পারে, যে দুটি পক্ষের কথা বলা হলো, এর বাইরে কি আর পক্ষ নেই? হ্যাঁ আছে। তবে সেটা হলো, সম্পূর্ণ ভিন্ন পক্ষ যাদের চরিত্রটা বুঝে ওঠা কঠিন। সে তৃতীয় পক্ষ হলো সরকার। করোনা ভাইরাসের তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করা কঠিন। বর্তমান আলোচনায় তাদের নিয়ে খুব বেশি কথা বলার ইচ্ছা নেই। কারণ সরকার পক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এমন জায়গায় অবস্থান করছে। নারী সম্পর্কে একটা প্রবাদ আছে, নারীর মন দেব না জানন্তি। নারী সম্পর্কে সেটা সত্য কিনা বিতর্ক সাপেক্ষ। তবে সরকারের মন বোঝা বড়ই কঠিন।
করোনা ভাইরাসের এই মহামারিকালে বাংলাদেশের সরকার লকডাউন কথাটা কখনো বলেনি। প্রথম থেকেই ছুটি ঘোষণা করেছে। পুনরায় কয়েকবার ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। কথাটা খুব স্পষ্ট, ছুটি আর লকডাউন এককথা নয়। ফলে মানুষজন ছুটিকালীন সময়ে অফিস আদালতে যাবে না এটা বোঝা যায়, কিন্তু মানুষজন আর কী করবে বা করবে না এ ছুটিকালীন সময়ে তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ছুটি মানে তারা কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামে বা অন্যত্র যেতে পারে ছুটি কাটাতে, বা নাও যেতে পারে। সম্পূর্ণ এটা তাদের স্বাধীনতা, তাদের এখতিয়ার তারা কী করবে। সরকারের এ ব্যাপারে সামান্য নির্দেশনা নেই। ঢাকার বহু ভদ্রলোক তখন তাদের গৃহকর্মীকে সাময়িক ছুটি দিয়েছে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ বিদায় করে দিয়েছে। ফলে এদের হাতে কাজকর্ম নেই, ঢাকায় এদের থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। ফলে নিজেদের বিবেচনা মতো তারা নিজনিজ গ্রামে চলে যাবার কথাই ভাবলো। সকলে তারা গ্রামে যাত্রা করলো। সম্পূর্ণ এটা ছিল তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু পরদিন বহু প্রগতিশীল ভদ্রলোকদের বার্তায় এ সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ হতে দেখা গেল। সকলে মনে করলো, এরা করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। কীসের ভিত্তিতে ভদ্রলোকরা নিশ্চিত হলো যে, তারা সকলে করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত?
দ্বিতীয়ত, যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেউ প্রমাণ করেনি তারা আক্রান্ত তখন ঢালাওভাবে এমন অভিযোগের ভিত্তি ছিল না। পরে তা প্রমাণিতও হয়নি। সর্বশেষ কথাটা হলো, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষিত হলে গ্রামে যাবে না শহরে থাকবে, এ ব্যাপারে আদৌ কারো নাক গলাবার সামান্য অধিকার ছিল কি? সাধারণ মানুষ ভিড় ঠেলে যাবে না আরাম করে যাবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার অধিকার কি দিয়েছে কেউ কাউকে? সাধারণ মানুষ প্রতি ঈদে এরকমভাবে নিজ ঠিকানায় যাত্রা করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এটা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অধিকার। ভদ্রলোকদের বা কারো এ নিয়ে তাদের প্রতি সামান্য কটূক্তি করার অধিকার ছিল না। রাষ্ট্রের বা দেশের ভালোর জন্যও নয়। যদি দরিদ্র সেসব মানুষরা দেশের মঙ্গলের জন্য ভদ্রলোকদেরকে কখনো জিজ্ঞেস করতো, ‘কেন তোমার দেশের ক্ষতি করে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাও, কেন তোমরা দেশের এত টাকা ব্যয় করে সন্তানদের বিদেশে পড়াও, কেন তোমরা বিলাসিতার পেছনে এত অর্থ ব্যয় করো, কেন তোমরা প্রয়োজনের চেয়ে এত অতিরিক্ত খেয়ে রোগশোক ডেকে আনো,’ ভদ্রলোকরা কি সেটা পছন্দ করতো নাকি সেটাকে পাত্তা দিতো?
যারা কয়েক মাসের খাবার দাবার নিয়ে ঘর নিশ্চিন্তে বসে ‘লকডাউন; পালন করে সময় কাটাতে পারে, তাদের সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্ক নেই। ভালো রান্না করে খাওয়ার সুযোগ যেমন তাদের আছে, ঠিক নিয়মিত আবার ফেসবুকে খাবারের বা ছাদবাগানের ছবি দিতে পারে। সন্তানের বা পরিবারের জন্মদিন পালনে করোনা ভাইরাস সামান্য সঙ্কট সৃষ্টি করে না তাদের জন্য। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মরে যাওয়ার আতঙ্কটুকু ছাড়া জীবনযাত্রা তাদের যথেষ্ট স্বাভাবিক। লকডাউন তাদের কাছে এখন বিরাট চাহিদা, চাহিদাটা তৈরি হয়েছে তাদের নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য। লকডাউন রক্ষা করা হচ্ছে না বলে তারা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। নিশ্চয় আমাদের মতো এ সকল ভদ্রলোকদের দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে কায়িকশ্রম দিতে হয় না। চাল ডাল তরকারি মাছ মাংস কোথা থেকে উৎপাদিত হয় তা পর্যন্ত সকলের জানতে হয় না। যথেষ্ট টাকা আছে, দরকার মতো নিত্য প্রয়োজনীয় চাল ডাল মাছ মাংস তরকারি বা বিলাসদ্রব্য কিনতে পারে, দাম যাই হোক। লকডাউন লকডাউন করে তাই তারা সবকিছু মাতিয়ে তুলছে। যারা লকডাউন মেনে চলছে না তাদের সম্পর্কে যখন যা খুশি মন্তব্য করছে। যারা কাজের সন্ধানে বা খাবারের সন্ধানে লকডাউন মানছে না যদি পুলিশ বা প্রশাসন তাদের ঠেঙিয়ে ঘরে বন্দি করে তাতে আমার মতো এসব সুধীজনদের সামান্য আপত্তি নেই। বরং পুলিশ তখন আমাদের বন্ধু বা আপনজন হয়ে দাঁড়ায়। লকডাউন প্রীতি আমাদের এতবেশি যে, সামান্য এ কথাটা পর্যন্ত বিবেচনা করতে রাজি নই তখন যে, সাধারণ নাগরিকদের গায়ে হাত তোলবার সামান্য অধিকা নেই প্রশাসনের। সংবিধান তা অনুমোদন দেয় না। ভদ্রলোকরা নিজেরা তারা সুস্থ থাকতে চায়, সেজন্য তারা নিজের ইচ্ছায় নিজের আরোপিত লকডাউন মেনে নিয়েছে, ইউরোপ আমেরিকার অনুকরণ করে। নিশ্চয় সে অধিকার তাদের আছে। ফলে সরকার লকডাউন না বললেও তারা ছুটিটাকে লকডাউন হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। তাতে দোষের কিছু নেই, নিজের ভালো তারা চাইতেই পারে। কিন্তু নিজের ভালোর জন্য আগবাড়িয়ে অন্যের ভালো চাইতে পারে না। নিজেদের উপর আরোপিত লকডাউন অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাইতে পারে না। কারণ সরকার এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি লকডাউন কথাটা বলেনি। বারবার ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু আগেই বলেছি, সরকারের মন বোঝা দায়।
আইইডিসিয়ার বলেছে, যারা করোনা আক্রান্ত নয় তাদের মাস্ক পরার দরকার নেই। কিন্তু দেখা গেল, মাস্ক না পরার জন্য পুলিশ জনসাধারণকে পেটাচ্ছে। সরকার বলেছে, কাঁচাবাজার দোকানপাট খোলা থাকবে। কিন্তু মানুষ হাটবাজার করতে গিয়ে পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছিলে। লকডাউন সরকার যেহেতু ঘোষণা করেনি, তাহলে নাগরিকদের এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে যেতে বাধা থাকার কথা নয়, কিন্তু পুলিশ বাধা দিয়েছে। সরকারের মন বোঝা এসব ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সরকারের মন বুঝতে না পারার আর উদাহরণ না টানি। কারণ সকলের এসব অনেক কিছু জানা। সরকারের কাছে নিশ্চয় জবাব আছে এসব প্রশ্নের, জবাবদিহিতা কতটুকু আছে তা জানি না। লকডাউন নিয়ে সরকারের মন বুঝতে না পারার কারণেই আসলে ভদ্রলোকদের সঙ্গে অভদ্রলোকদের ভুল বুঝাবুঝিটা অনেক বেড়েছে। ভদ্রলোকরা বলতে চাইছে, সরকার কী করবে মানুষ তো কথা শুনছে না। ভদ্রলোকদের কথায়, সরকার সঠিক জায়গায় আছে, হতচ্ছাড়া মানুষগুলি কথা না শুনলে সরকার কী করবে। দিনের শেষে যত দোষ নন্দ ঘোষ। সব দোষ ছোটলোকের বাচ্চাদের। কিন্তু প্রশ্ন সরকার আদৌ লকডাউন দিয়েছিল কি? ছুটির মধ্যে পোষাক শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল কেন? সত্যি বলার সাহস আমাদের মতো ভদ্রলোকদের থাকে না, সবসময় বহু দূর থেকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলি। বলির পাঁঠা সেখানে সমাজের দুর্বলরা। যাদের এখন ছোটলোক বলে নিন্দা করা হচ্ছে, ক’দিন পর তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের রান্নাঘরে হাঁড়ি চড়বে না। নিজেদের চেহারাটা ভালো করে আয়নায় দেখি না, তাহলে বোঝা যেতে কতেটা উচ্চস্তরে বাস করি আমরা!
সরকার এখন ছুটি তুলে দিয়েছে। সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত বা দ্বিমত পোষণ করতে পারি। দেখলাম একজন সরকারকে নির্বোধ বলেছে এজন্য। কিন্তু আমি বোধসম্পন্ন আর সরকার নির্বোধ এমন বাক্য ব্যবহার করার মতো অতটা নিশ্চিত বোধসম্পন্ন মানুষ আমি নই। নিজেকে আমি এতটা সঠিক মনে করি না। ভাষা ব্যবহারে কাউক চট করে নির্বোধ বলাটাও আমি সঙ্গত মনে করি না। কারণ কে নির্বোধ আর কে বোধসম্পন্ন, তার বিচার করবে কে? কিন্তু এটা বলতে পারি, করোনা ভাইরাস আক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট দ্বিমত আছে, বিভিন্ন সমালোচনা আছে। সরকারের জাতীয় কমিটির সদস্যরা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও অনেক ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের সমালোচনা করেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা দানে সরকারের ব্যর্থতা সর্বত্র আলোচিত। ফলে সরকারের নানা সমালোচনা আছে আমার দিক থেকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। শুধু করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বলছি কেন, বহুক্ষেত্রেই সরকারের নীতির সঙ্গে দ্বিমত আছে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে যেমন আছে, গত উনপঞ্চাশ বছরের প্রতিটি সরকারের সঙ্গে নাগরিক হিসেবে আমার চিন্তার নানা অমিল ছিল। তারমানে এ নয় যে, সর্বদা আমি ঠিক ছিলাম। কিন্তু ভুল বা ঠিক হই, সরকারের সমালোচনা করার অধিকার রাষ্ট্রে আমার থাকতে হবে, সেটাই প্রকৃত গণতন্ত্র। বর্তমান প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। বর্তমান ছুটি আর না বাড়ানোতে সরকার ভুল ঠিক যাই করুক, সরকার যে ছুটি বাড়ায়নি বা তথাকথিত লকডাউন তুলে দিয়েছে তাতে বেশিরভাগ খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থন আছে। ঢাকায় বসে সেটা আমরা অনেকে বুঝতে পারছি না। কারণ খেটে খাওয়া মানুষরা ঘরে বসে না খেয়ে মরার চেয়ে কাজ করে উপার্জনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনলাভের নিশ্চয়তা চাইছে। যদি তারা স্বাভাবিক জীবন লাভ করার শর্তে করোনার আক্রমণে মরতে ভয় না পায়, সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার কিছু নেই। যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবন বিসর্জন দিতে চায় কার কি বলার আছে? শ্রমিকরা যখন নোংরা পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়, শ্রমিকরা যখন কয়লার খনিতে বিষাক্ত পরিবেশে কাজ করে, কিংবা যখন অনেক বাড়িতে গৃহকর্মীরা অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের জীবন-মরণ নিয়ে আমরা তো চিন্তিত থাকি না। আজ তবে আর চিন্তিত কেন? যদি তাদের জীবন বিনাশ হয়, হবে। না খেয়ে রোগেশোকে তারা তো মারা যাচ্ছেই, এ আর এমন কী। যখন আগে কখনো এসব নিয়ে ভাবিনি, আজ ভাবছি কেন? বরং যারা লকডাউনে না থেকে স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখতে চায় না, বিভিন্ন কারণে তাদেরকে ধন্যবাদ দেবার আছে। মনে রাখতে হবে, সকল সত্যের বিপরীত সত্য আছে। নিশ্চয় যারা লকডাউন চেয়েছে তারা যে বিরাট ভুল করেছে, তা তো নয়। কিছু মানুষ লকডাউনে থাকতে চেয়েছে বলে বা লকডাউনে তাদের থাকার সৌভাগ্য ছিল বলেই, পথেঘাটে ভিড় বা জনস্রোত কম ছিল। সেটা অন্যদের আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। সেটা আরো ভালোভাবে হতে পারতো যদি সরকারের এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা থাকতো। হয়তো তাহলে লকডাউন এতটা দীর্ঘ করতে হতো না। কিন্তু আসলে না হয়েছে ঘরকা, না হয়েছে ঘাটকা। কিন্তু দুঃখজনক যে, সঙ্কটের আসল কারণ সন্ধান না করে ভদ্রলোকরা সকল দোষ চাপিয়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। সাধারণ মানুষ ঘরে থাকেনি কেন, কারণ রাষ্ট্রটা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র নয়। বহুদিন ধরে সেখানে বিধিবিধানগুলো জনকল্যাণমূলক নয়। সরকার জনবিচ্ছিন্ন তো বটেই, ভদ্রলোকরা পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না। যারা কায়িকশ্রম দেয়, তাদেরকে মনে করে নির্বোধ ছোটলোক। হ্যাঁ, মার্কস, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ তারা সকলে দেখিয়েছেন, পুষ্টির অভাব, মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার না পাওয়া, কাজের একঘেঁয়েমি তাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে ভোঁতা করে দেয়। ফলে জীবনের কঠিন লড়াইয়ের ব্যস্ততায় গভীর চিন্তাভাবনার প্রতি তাদের দৃষ্টিকে আর সহজে প্রসারিত করতে পারে না। চিন্তাভাবনা হয়ে পড়ে গণ্ডীবদ্ধ। ভয়ভীতি তাদের সেভাবে তাড়িত করে না। তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় শুধু টিকে থাকবার লড়াই। সেজন্য তারা ভালোমন্দ যেকোনো পথ বেছে নিতে পারে। হতে পারে চরম নিষ্ঠুর। কারণ টিকে থাকাটা তখন আসল কথা। ফলে দেখা যায়, এরা অনেকে হয়ে দাঁড়ায় গোপন জগতের সহযোগী যোদ্ধা, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে সেই নিষ্ঠুর কঠিন পথ বেছে নেয়। স্বভাবতই, সে দোষাটা তাদের নয়। রাষ্ট্র এবং সমাজ তাদেরকে সে পথে নিয়ে গেছে। সে অপরাধটা রাষ্ট্রের আর তার জন্য দায়ী ধনীদের শোষণ আর লোভ।
দরিদ্র মানুষেরা করোনাকালে কী করছে বা করবে সেটা তাদের ব্যাপার। যারা লকডাউনে এখনো থাকতে চায়, তাদের তা থাকতে বাধা নেই। কেউ তাদের লকডাউনে থাকতে না করবে না। সবটা তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার। লকডাউনটা এতদিন চলেছে আসলে আমাদের অনেকের সুবিধা মতো। নিজেরা আমরা ঘরে নিরাপদে থেকেছি, অথচ বাড়ির চাকরবাকর বা দারোয়ানকে হাজার কাজে বাইরে পাঠিয়েছি। সামান্য তখন চিন্তা করিনি যে, সে মানুষটা আক্রান্ত হতে পারে কিনা। তখন আমরা আমাদের অর্থের দাপট দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থে লকডাউন ভঙ্গ করেছি। সত্যি কথাটা হলো এই, আমরা ভদ্রলোকরা যখন যে কথাটা বলি, শুনতে তা ভালোমন্দ যাই হোক, বলি নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে। ভাব করি নিজেদের এক একটা মহাপ্রাণ হিসেবে।
সত্যি বলতে কি, এবার আমাদের ভয় কাটিয়ে সতর্ক হবার সময় এসেছে। ভয় আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। যদি আমরা সতর্ক থাকি সেটা আমাদের অনেক বেশি কাজে আসবে। আমাদের ভাবতে হবে, লড়বার জন্য শক্ত মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাবার কথা। যদি মরণের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে সকলে আমরা ‘কড়া লকডাউন’ এ চলে যেতে চাই, তাহলে চিকিৎসাসেবা দেবে কে? চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের ভয় নেই? তাদের সংসার নেই? সকলে লকডাউনে যেতে চাইলে, সকলে লকডাউনের ব্যাপারে আন্তরিক হলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। সকলেই তখন ঘরে বসে থাকতে চাইবে। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাবে। যদি কাল কৃষকরা লকডাউনে চলে যেতে চায় বহুলোককে না খেয়ে মরতে হবে। সেটা হবে হয়তো করোনা ভাইরাস আক্রমণে মারা যাবার দশগুণ। কারণ চাষাবাদ বন্ধ থাকলে দুর্ভিক্ষে মানুষ শুধু মারা যায় না, মানুষ হিংস্র আর উন্মাদ হয়ে ওঠে। বাঁচার জন্য মানুষ তখন ভয়াবহ স্বার্থপর হয়ে যায়। সেটা না দেখতে পারাই ভালো। সম্পূর্ণ লকডাউন হলে ভয়াবহরকম বিপদ বেড়ে যেত আরো আগেই।
লকডাউন হতে হবে, অবশ্যই তা প্রয়োজন মতো। বাড়াবাড়ি সবকিছুর ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। কিন্তু কথা হলো, তৃতীয় পক্ষ সরকারের নানান কাজ এবং সিদ্ধান্ত এত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে যে, আমরা এখন আর বলতে পারছি না বাড়াবাড়ি কোনটা আর সঠিক হতে পারতো কোনটা। কারণ করোনা মোকাবেলায় সরকারের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, যা অনেকেই বলেছে। আবার মাঝপথে নানা রকম বিপত্তি ঘটেছে একটার একটা। কিন্তু শেষটা সুন্দর হোক আশা করি। সব ভালো তার শেষ ভালো যার। কিন্তু শেষটা ভালো না হলেই ভয়াবহ বিপদ। আমি ধারণা করছি, প্রাকৃতিকভাবে আর চিকিৎসাবিজ্ঞানী আর চিকিৎসকদের উদ্ভাবনী শক্তির জোরে খুব শীঘ্রই আমরা সঙ্কট কাটিয়ে উঠবার লক্ষণ দেখতে পাব। তবে সঙ্কট কেটে গেলেও মানুষ তখনো বিভক্ত থাকবে দুটি ভাগে: যাদের প্রচুর আছে, আর যাদের নেই। যতক্ষণ না এ সমাজ শ্রেণিহীন চরিত্র লাভ করবে, সমাজ বিভক্ত থাকবে আরও বহু কাল, করোনা থাকলো কি থাকলো না তাতে কিছু যায় আসে না।