‘খুদে বই’ বাংলা বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ পাঠ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৩

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাওয়া যাচ্ছে আবু তাহের সরফরাজ প্রণীত ‘খুদে বই: বাংলা বর্ণপরিচয়’। বাংলা বর্ণমালার ওপর এর আগে এরকম বই লেখা হয়নি। বাংলা বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ পাঠ পাওয়া যাবে বইটাতে। প্রকাশনা সংস্থা ‘সহজ প্রকাশ’ থেকে বের হওয়া বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। ১৩৬ পৃষ্ঠার বইটির গায়ের দাম ২৪০ টাকা। বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে গ্রন্থরাজ্য স্টলে। স্টল নম্বর ১৪৯। বইটির বিষয়ে ধারণা পেতে বইটির ভূমিকায় চোখ বোলানো যেতে পারে:

 

আধো আধো স্বরে ছায়াবীথি কথা বলে ওঠে, বাবা বাবা, ফুল। বাবা বাবা, পাখি। উঠোন দিয়ে ঘুরছে একটা মুরগি। ছায়াবীথি আমার গালের সঙ্গে গাল ঠেকিয়ে বলে, বাবা বাবা, মুগ্গি... কক কক। আমি হেসে উঠি। হেসে ওঠে ছায়াবীথি। তার হাসিতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি মুগ্ধ হই। বাড়ির আশপাশে নানা রঙের বুনোফুল ফুটে আছে। গাছে গাছে পাখি। তাদের কিচিরমিচির। ঘাসবনে রোদ আর গাছের ছায়া জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ছোট্ট ছায়াবীথিকে বুকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই প্রকৃতির ইসকুলে। প্রজাপতি দেখে খিলখিল হেসে ওঠে ছায়াবীথি। হাততালি দ্যায়।

 

ভাঙা ভাঙা স্বরে কত যে কথা বলে আমার মেয়েটি! আমার ভাল্লাগে। সারা দিন ওকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। কাগজ দিয়ে খেলনা বানিয়ে আমরা খেলাধুলা করি। বিকেলবেলা যাই গাঙপাড়ে। দাঁড়াই গোধূলির মুখোমুখি। গোলাপরাঙা আলো পশ্চিমের দিগন্তে। আনন্দে ছায়াবীথির চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমরা হেঁটে বেড়াই গাঙপাড় ধরে। মাছরাঙা কিংবা বক ঠোঁটে মাছ তুলে নিয়ে উড়ে যায়। ছায়াবীথি দ্যাখে আর আধো আধো স্বরে কথা বলে যায়। যে যে শব্দ সে বলে, সে সে শব্দ আমার কল্পনায় ছবি হয়ে যায়।

 

তিন বছর চলছে ছায়াবীথির বয়স। হঠাৎ মাথায় এলো, এবার ওকে বাংলা বর্ণ চেনানো শুরু করা দরকার। বসলাম একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ নিয়ে। আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ছায়াবীথি পড়তে লাগল, ‘ছোটো খোকা বলে অ আ/শেখেনি সে কথা কওয়া।’ কিন্তু আমার মেয়েটা এরপর হ্রস্ব ই উচ্চারণ করতে পারল না। তাহলে কি আর সবার মতো তাকে রোস্্সোই উচ্চারণ শেখাবো? কিন্তু এটা তো হ্রস্ব ই এর বিকৃত উচ্চারণ। আর তাছাড়া, রোস্্সোই শব্দটি বাংলা অভিধানেও নেই। চট করে মাথায় এলো, হ্রস্ব মানে তো খাটো আর দীর্ঘ মানে লম্বা। তাহলে এরকম হতে পারে যে, ‘খাটো ই লম্বা ঈ/গরম ভাতে খায় ঘি।’ ছায়াবীথির সঙ্গে উচ্চারণ মেলালাম। উত্তীর্ণ হলাম। ফুলপরিদের ছা এর মতো আমার ছোট্ট ছায়াবীথি অনায়াসে বলতে পারল শব্দগুলো। এই তো শব্দের খেলা। সহজ উচ্চারণ কত সহজে বর্ণ দুটোকে পরিচিত করে তুলছে ছোট্ট এক শিশুর মানসজগতে। এই ভাবনা আমাকে মুহূর্তেই এই প্ররোচনা দিল যে, তুমিও লেখো না হে এরকম আরেকটি বাল্যশিক্ষা। তোমার উত্তরসূরীকে যা যা শেখাতে চাও, তা তা লিখে ফ্যালো।

 

বইয়ের কয়েকটি দোকান ঘুরে কিনলাম কয়েকটি বাল্যশিক্ষা। দোকানি জানালেন, এই বইগুলোই তারা বেশি বেচেন। বাড়ি ফিরে বইগুলো দেখলাম। পড়লাম। বুঝলাম। হে আল্লাহ, এই কী তব বঙ্গে শিশুপাঠ্যের নমুনা! ছন্দে তীব্র অমিল। বর্ণগুলো পরিচয় করিয়ে দেয়ার কৌশলও মোটাদাগে হাস্যকর। বর্ণগুলো নিয়ে যে আনন্দের এক একটি জগৎ তৈরি করা যায়, এ চিন্তাই যেন কেউ করেনি। অথচ কে না জানে, শিশুকে যেভাবে আপনি পৃথিবী চেনাবেন, সেভাবেই সে চিনবে। এবং এই পৃথিবীর মানুষ হয়ে উঠবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আমার বই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা খুলে বসলাম। বিরক্ত না হলে আপনাদেরকেও একটু পড়িয়ে নিতে চাই।

 

ক এ কলা খ এ খাই
এত বেশি খেতে নাই।
গ এ গরু ঘ এ ঘাস
কত ঘাস খেতে চাস?

 

বর্ণগুলো পরিচয় করিয়ে দিতে যে বাক্যগুলো এখানে লেখা হয়েছে, তা যে মোটেও সুখপাঠ্য নয়, আমার সাথে আপনারাও নিশ্চয়ই একমত হবেন। শিশুদের মানসজগৎ আনন্দের সরোবর। প্রতিমুহূর্তে সেখানে সৌন্দর্যের পাপড়ি মেলে ফোটে কল্পনার মানসপদ্ম। আর তাই, আনন্দের ভেতর দিয়েই তাদের কাছে ক আর খ বর্ণদুটো তুলে দেয়া দরকার। কীভাবে? মাথায় এলো:

 

ক করে কোলাকুলি
খ খেলে ফুটবল
গ গান গেয়ে ওঠে
ঘ ঘুমে টলমল।

 

প্রেরণা এলো আমার ভেতর। শুরু করলাম খুদে বই লেখা। লিখছি আর ছায়াবীথিকে পড়ে শোনাচ্ছি, ছায়াবীথি মজা পাচ্ছে। আমারও প্রেরণা বাড়ছে। কখনও কখনও মনে হয়েছে, হচ্ছে না, আমি আসলে সময় নষ্ট করছি। আমার অন্তর্জগতের ছবিগুলো হয়তো ঠিকঠাক আমি আঁকতে পারছি না। সে যাক, ছায়াবীথি তো মজা পাচ্ছে। আর খুব যে যা-তা হচ্ছে, তাও কি? এই সান্ত¡নায় লিখে শেষ করলাম খুদে বই। ছায়াবীথি আর তার সহপাঠীদের জন্যে।

 

লিখতে লিখতে বুঝতে পারলাম, যা প্রচলিত তা ভুল হলেও মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত। সেই ভুলকে শুধরে সঠিকটা প্রতিষ্ঠা করা খুবই মুশকিল। আর তাই, খাটো ই লম্বা ঈ কিংবা খাটো উ লম্বা ঊ না লিখে লিখতে বাধ্য হলাম হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ। হ্রস্ব তো ছায়াবীথি উচ্চারণ করতে পারবে না, পড়–ক সে আরসব শিশুর মতো রোস্্সোই। বাংলাভাষী মানুষের কাছে এই শব্দটাই প্রতিষ্ঠিত, হ্রস্ব কিংবা খাটো নয়। ¯্রােতের বিপরীতে গিয়ে ছায়াবীথি রোস্্সোইকে খাটো ই উচ্চারণ করলে নানাজনে নানাকথা বলবে। হয়তো হাসবেও। কী দরকার মেয়েটাকে ঝামেলায় ফেলার! আরও একটি বিষয় বুঝতে পারলাম, ষ, স, ং, ঢ়, ৎ ও ণ বর্ণ ছয়টি বাংলা ভাষায় জটিলতা তৈরি করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা পালন করে না। যেসব তৎসম শব্দে ষ রয়েছে তা বাংলায় অবিকৃত আছে। কেবলমাত্র তৎসম শব্দের জন্যে বাংলা ভাষায় বাড়তি একটি বর্ণ ষ সংযোজন করা হয়েছে। অথচ শ বর্ণটি দিয়ে তৎসম শব্দগুলো লিখলে ষ বর্ণের দরকার পড়ত না। এছাড়া স বর্ণটিও বাংলা ভাষার বাড়তি একটি বর্ণ। শ ও ছ বর্ণ দুটোর যে কোনো একটি স বর্ণের জায়গায় বসালে সমস্যা হয় না। কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের মতে, ঙ বর্ণকে সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে ং বর্ণের সৃষ্টি। ঙ বর্ণকে সংক্ষিপ্ত কেন করতে হবে? ঙ বর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণের কার যুক্ত থাকলে ঙ বর্ণের জায়গায় ং বর্ণ বসানো যায় না। আবার, ঙ বর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণের কার যুক্ত না থাকলে ঙ ও ং বর্ণ দুটোর উচ্চারণ অভিন্ন। তাহলে ং বর্ণটি কি বাংলা ভাষায় বাড়তি নয়? একই কথা ঢ় বর্ণের বেলাতেও। ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় বইতে ঢ বর্ণের নিচে বিন্দু বসিয়ে ঢ় বর্ণটি প্রবর্তন করেন। সংস্কৃত ও আর্যভাষাগুলোতে ঢ বর্ণের উচ্চারণ অবস্থাভেদে কখনো কখনো ঢ় বর্ণের মতো উচ্চারিত হতো। আর তাই, ঢ ও ঢ় বর্ণদুটির পার্থক্য বোঝাতে বাংলা ভাষায় ঈশ^রচন্দ্র ঢ় বর্ণটি প্রবর্তন করেন। আমার কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষায় তো ঢ বর্ণের উচ্চারণ ঢ় বর্ণের মতো উচ্চারিত হয় না। তাহলে কেন বাড়তি ঢ় বর্ণের সংযোজন? র ও ড় বর্ণদুটি দিয়েই তো শব্দ লেখার কাজ সহজ হয়। রাঢ়, আষাঢ়, গাঢ়, গূঢ়, দৃঢ়, রূঢ়, মূঢ়, বিমূঢ় ও প্রৌঢ় শব্দগুলোয় র কিংবা ড় বর্ণের যে কোনো একটি ব্যবহার করলে অসুবিধা কোথায়? আরেকটি বাড়তি বর্ণ ৎ। যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দে ৎ বর্ণটি ব্যবহৃত হয়। যেমন: ঈষৎ, জগৎ, মহৎ। ৎ ব্যবহৃত হওয়ার কারণ, তারা যে সংস্কৃত শব্দ এই পরিচয়টা ধরে রাখা। অথচ ত বর্ণটি দিয়েও ওইসব শব্দ লেখা যায়। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ থেকে ণ বর্ণযুক্ত যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেসব শব্দ অবিকৃতভাবে লিখতেই বাংলা ভাষায় ণ বর্ণটি ব্যবহৃত হয়। অথচ ওইসব শব্দে ণ বর্ণের জায়গায় ন বর্ণটি লিখলে কোনোই সমস্যা হয় না। শুধু শুধু ণ বর্ণটির বোঝা বইতে হচ্ছে বাংলা ভাষাকে। অনেক বিদেশি ভাষার শব্দ ধারণ করে বাংলা এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিপূর্ণ একটি ভাষা। আর তাই, জটিলতামুক্ত বাংলা বর্ণমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।

 

বাংলা অভিধানের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ শব্দের সঙ্গে খুদে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি এই বইতে। ছন্দের আনন্দে দুলতে দুলতে তারা পড়ে ফেলতে পারবে বইটি। এই বয়সে শব্দের মানে জানা তাদের জন্যে খুব জরুরি নয়। জরুরি হলো, স্বরবর্ণের দশটি চিহ্ন ধারণ করে বাংলা ভাষায় যে বিশাল শব্দভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। এই উদ্দেশ্যে শব্দগুলো হয়ে উঠেছে এক একটি চরিত্র, দস্যিগুলোর প্রতিদিনকার খেলার সাথি। খুদে বই পাঠশেষে খুদে শিক্ষার্থী যে কোনো বাংলা বই সাবলীলভাবে পড়তে পারবে। বাংলা যেহেতু তার মায়ের ভাষা, তাই প্রতিনিয়ত সে তার চারপাশের মানুষজন থেকে বিভিন্ন শব্দের মানে শিখতে শিখতে বেড়ে উঠবে। এছাড়া ইসকুলের উঁচু শ্রেণিতে তারা এসব শব্দের মানে ও বাক্য গঠন জানতে পারবে। পাঠ্যবই ছাড়াও তাদের হাতে তুলে দিতে হবে শিশুসাহিত্য। বাংলা ভাষায় কালোত্তীর্ণ অনেক শিশুসাহিত্য রয়েছে। এসব বই পড়তে দেয়ার পাশাপাশি খুদে শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে বাংলা অভিধানের ব্যবহার। এতে করে অভিধান খুলে তারা যে কোনো শব্দের মানে সহজেই জেনে নিতে পারবে। আমার প্রার্থনা, ছায়াবীথি আর তার সহপাঠীদের ভেতরকার কল্পনাকুসুম ফুটে উঠুক নানা রঙের বর্ণছবিতে। বেড়ে উঠুক তারা বাংলাদেশের রুচিমান নাগরিক হয়ে। এরচেয়ে আনন্দ আর কী আছে!