ঘটিই ডোবে না, নামে তালপুকুর

রহমান মুফিজ

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০

পরিবহন ভাড়া এখনো পর্যন্ত যা দিই তা-ই তো দ্বিগুণ। কখনো গণশুনানি কইরা সরকার পরিবহন ভাড়া ঠিক করছে? অভ্যন্তরীণ এবং বিশ্ববাজারে তেলের দোহায় দিয়া কতবার যে পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হইছে, তার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু সব বাজারে যতবার তেলের দাম কমছে, কখনো কি শুনছেন পরিবহন মালিকরা ভদ্রতা দেখায়া ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিছে? দূরপাল্লার গাড়ি তো আছেই, ঢাকা শহরের মামুলি সিটি সার্ভিসগুলাও মানুষরে জিম্মি কইরা কম বাটপারি করে না, কম টাকা লুটে না। কী এক সংকটের কথা বইলা সিটিং সার্ভিসের নাম কইরা বছর দুয়েক আগে ঢাকা শহরে লোকাল বাসের ভাড়া দ্বিগুণ (১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা) করা হইলো। পরে সে সংকট কাইটা গেছে, কিন্তু ভাড়া আর কমলো না। অন্যদিকে সিটিং সার্ভিসও শেষ পর্যন্ত সিটিং থাকলো না। গাদাগাদি লোক নিয়াও তারা আদায় করে সিটিং গাড়ির ভাড়া। এইভাবেই গোটা মুনাফাখোর দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেটের কাছে মানুষ জিম্মি হয়া আছে। এইসব কথা মানুষ বলবে কারে? বলার লোক রাস্তায় নাই, সচিবালয়ে নাই, আদালতে নাই, সংসদে নাই, গণভবনেও নাই।

সরকার জনবান্ধব সিধান্ত দেবে কি, উল্টা পরিবহন মোড়লদের কাছেই নিজেদের মাথা বন্ধক দিয়া আছে। মানুষের পক্ষে কথা কওয়ার তিল পরিমাণ হিম্মতও দেখাইতে পারে না। এরা নাকি সরকার, এরা নাকি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্রে। ঘটিই ডোবে না, নামে তালপুকুর, আর কি। জনগণরে এরা আবার বাটিছাঁটা গেঁয়ো শিশু ছাড়া কিছুই জ্ঞান করে না। করোনার মতো মহামারিতে বিপর্যস্ত গোটা দেশ। একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়া এ সংকট মোকাবিলা করতেছে সবাই। মহামারি যখন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছাইতেছে তখনই সাধারণ ছুটি তুইলা নিতেছে সরকার। বলা হইতেছে, উপায় নাই। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচতে এছাড়া সরকারের হাতে বিকল্প পথও নাই। অবশ্য বিকল্প পথ থাকলেও সরকার সেদিকে কখনো গেছে—সে নজির আমরা কখনো দেখি নাই। যা হোক, ছুটি তুইলা নিয়া সীমিত পরিসরে গণপরিবহনও চালু করা হইতেছে। এই সুযোগরে পুরোদমে কাজে লাগাইতে মরিয়া হয়ে উঠছে পরিবহন মালিকরা। সরকার যখন বলতেছে সীমিত পরিসরে গাড়ি চলবে, গাড়িতে অর্ধেকের বেশি যাত্রী নেয়া যাবে না—তখন মালিকদের তরফ থেকে প্রস্তাব আসছে অর্ধেক যাত্রী হইলে ভাড়া করতে হবে দ্বিগুণ!

ভাবেন একবার! বছরের পর বছর মানুষের পকেট কাইটা দ্বিগুণ ভাড়া আদায় কইরা যে টাকার পাহাড় তারা গড়ছে, সে হিসাব কেউ নিছে? আর আজ মানুষের দুর্দিনে একবারের জন্যও তারা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবলো না! মুনাফালোভে তারা এতটাই অন্ধ যে, দ্বিগুণ ভাড়ার প্রস্তাব তুলতে যায়া তাদের একবারও বুক কাঁপলো না! এই দুঃসময়ে তারা তো বলতে পারতো, আমরাও মানুষের পাশে আছি। এই সংকট কাইটা না যাওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের বাড়তি ভাড়ার চাপ আমরা মানুষরে দেব না। উপরন্তু তারা ঘোষণা দিতে পারতো, বিশেষ সেবার আওতায় কিছু পরিবহনের ভাড়া অর্ধেক করা হইছে। কিম্বা সরকারও তার বিআরটিসি নামাইতে পারতো অর্ধেক ভাড়ায়। না, সরকার আর পরিবহন মালিকরা সেই ভাবনার ধারে কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, কেমনে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষরে জিম্মি কইরা টাকার পাহাড় আরো উঁচু করা যায়—সেই পথই বাইছা নিছে। আচ্ছা, এই সরকারগুলা জনগণের সাথে এমন নিমকহারামি কেমনে করে? জনগণের পয়সায় চলা সরকার জনবান্ধব কোনো সিদ্ধান্ত ক্যান নিতে পারে না? ঘাপলাটা কোথায়?

এই যে অর্ধেক যাত্রী হইলে পরিবহন ভাড়া দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করল মালিকরা, কেউ কি এইটা বিশ্বাস করেন যে, যেদিন পূর্ণগাড়ি যাত্রী তোলা হবে সেইদিন থেকে গাড়িভাড়া আগের জায়গায় ফিইরা যাবে? এমন ঘটনা নিকট নয়, দূর অতীতেও ঘটছে কিনা খোঁজ নেন। কোনও উদাহরণ পাইবেন না। মানুষের দুঃসময়রে পুঁজি কইরা এইসব সিন্ডিকেট টাকার পাহাড়ই বানায়। এদের লগে ইচিংপিচিং থাকে সরকারের। অথচ সরকার নিরীহ, নিষ্পাপ, গোবেচারা ভাব নিয়া খাড়াইয়া খাড়ায়া তাকায়া থাকে টেলিভিশন ক্যামেরার দিকে। আর ভাবে, জণগণ বলতে যে জিনিসটা, সেইটা বোকাচোদা গার্বেজ ছাড়া আসলে কিছুই না। জনগণ হইলো গোটা দুর্বৃত্তায়িত মুনাফাখোর শাসকশ্রেণির ঘানি টানা বলদ।

কী, নিজেদের উন্নয়নের বলদ ভাইবা গর্ব হইতেছে না? আমার হইতেছে।

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী