জগলুল আসাদের কলাম ‘ইসলামের সৌন্দর্যশিল্প’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২১

সৌন্দর্য পিপাসা মানুষের সহজাত অনুভব বা ফিতরাত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ`লা পুরো দুনিয়াকেই বানিয়েছেন তাঁকে সিজদা করবার স্থান। তাই, মুসলিম জীবনে মসজিদ নির্মাণ, জায়নামাজ ও কার্পেট তৈরিতে শিল্পের অনবদ্য ছোঁয়া দেখতে পাই যুগে যুগে। দুনিয়াজুড়ে কত বিচিত্র স্থাপত্য সৌন্দর্যের মসজিদ যে নির্মাণ করা হয়েছে, তা প্রায় অগণনীয়। মুমিনের জন্যে সিজদার চেয়ে বড় ইবাদত আর মহোত্তম শৈল্পিক অভিব্যক্তি আর কী হতে পারে!

ওহির শিক্ষা হৃদয়ে গেঁথে দিতে সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও  শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রয়োজন স্বীকার করা হয় ইসলামে। শব্দশিল্পের ইসলামি নিদর্শন তেলাওয়াত বা আযানের ভেতর পাওয়া যায়। কত অভিনব সুরের তিলাওয়াত যে দেখা যায়! এগুলো ওহির বাণীর প্রতি বিহবল বিষ্ময় ও ভালোবাসা তৈরিতে সহায়তা করে মুমিনের দিলে। আযান আমাদের হৃদয়কে তৃপ্ত করে। সালাতের আহবানের উদ্দেশ্য ছাড়াও আযানের কথাকে সুরেলা ও শিল্পময় করে তোলার পেছনে হৃদয়ে দীনের প্রশান্ত ভালোবাসা ও ভালোলাগা তৈরির উদ্দেশ্য অস্বীকার করা যাবে না।

উঠের পিঠে ‘হুদি’ পাঠ করার প্রচলন রসুলের যুগে ছিল। হুদি এক প্রকার সুরেলা ও ছন্দময় কবিতা। এটি গাওয়াতে উটের গতি বেড়ে যেত। আহযাবের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় আল্লাহর প্রসস্তিগীতি গাওয়াতে শ্রমের ক্লান্তি দূর হতো, প্রেরণা হতো অধিক পরিশ্রমে। হিজরত করে নবিজি যখন মদিনায় প্রবেশ করেন তখন আনন্দের অভিব্যক্তিস্বরূপ আনসার ছেলেমেয়েদের সুললিত আবৃত্তি সানায়াতুল বাদরি মনে করিয়ে দেয় সুরেলা প্রকাশের অর্থাৎ শিল্পের প্রয়োজনকে। আনসাররা গান পছন্দ করে বলে বিয়েতে এক নাবালিকা পাঠানো হয়েছিল, যে গান শোনাবে। নবির (সাঃ) নির্দেশে।

আরবে কাব্য প্রতিযোগিতা ও আরবীয়দের কাব্যপ্রেম তো জানাই আছে। ইসলামের বাদ্যযন্ত্রবিহীন হক ও সুন্দর কথার গান পুঁজিবাদী নান্দনিক বিশ্ববীক্ষার সশব্দ ও যিনা-উদ্দীপক অভিব্যক্তির গালে নীরব চপোটাঘাত এখনো। মজার ব্যাপার, আরবে নাট্যশিল্পের বিকাশ হয়নি বললেই চলে। আর উপন্যাসের জন্ম তো সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তাই এগুলো নিয়ে ইসলামের ইঙ্গিত দিচ্ছি না। তবে, কাসাস বা গল্পশিল্পের নজির দেয়া যাবে। তাছাড়া, খুতবা বা ভাষণ, ওয়াজ বা বক্তব্যশিল্পও ইসলামি সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে আছে।

প্রাণীর ভাস্কর্য বা মূর্তি ছাড়া অন্য ভাস্কর্য ইসলামে জায়েজ বলেই জানি। আমরা যে সুন্দর কিছু দেখলে আলহামদুলিল্লাহ বা সুবহানাল্লাহ বলি, এটা কিন্তু একটা সাড়া মুমিন হৃদয়ের! এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি— জগৎ নিজেই আল্লাহর সৃষ্টি এক অপূর্ব ছবি। শিল্পের ভেতরে সিমেট্রি থাকতে হয়, কোন আপাত বিসদৃশতাও বৃহত্তর কোন সিমেট্রিরই অংশ। এরিস্টটল কথিত Beauty is bound up with size and order এই বাণী শিল্পসাহিত্যের জগতে প্রায় সর্বমান্য। আল্লাহর সৃষ্টির দিকে তাকালে আমাদের চোখ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে কিন্তু তবুও কোন খুঁত খুঁজে পাবে না। মহোত্তম স্রষ্টাও একমাত্র তিনিই। আল্লাহু আকবর।

পরোক্ষতা শিল্পের  অন্যতম বৈশিষ্ট্য। Art often speaks by implications. এ জগৎ-মধ্যস্থ সবই যেন পরোক্ষে ইশারা দেয় এর কারিগরের। আলাম বা জগতের এক অর্থ, যা অন্য কিছু জানবার মাধ্যম হয়। তাই তো, কোরান আয়াত যেমন আয়াত বা চিহ্ন, এ জগতও তা-ই। জগৎ ও সমাজকে চিহ্ন হিসেবে পাঠ করা শিখতে হবে।

স্যুট, কোট, টাই বা প্যান্ট-শার্ট এগুলোর সৌন্দর্য ইন্ট্রিনসিক কোনো কিছু নয়। এগুলো আমাদের রুচিতে সুন্দর ও ফর্মাল হিসেবে আবির্ভূত হয় ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-সম্পর্কের হাত ধরে। দাড়ি-টুপি-পাজামা-পাঞ্জাবি বা জোব্বা-জামাও জগতের কাছে সুন্দরতম আভরণ হিসবে প্রতিভাত হবে যদি ক্ষমতার দান উলটে যায়, দুনিয়া ইউরো-আমেরিকান বীক্ষার না হয়ে, ইসলামের হয়।

হাদিস শরীফে এসেছে, আল্লাহ নিজে সুন্দর ও তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তাহসানিয়াত তো ইসলামের ভেতরের জিনিসই। একারণে, ক্যালিগ্রাফিরও জন্ম। ইসলাম তো ব্যক্তিকেও শৈল্পিক সৌন্দর্যে ভরপুর করে দিতে চায় সুন্দরতম আখলাক তৈরির মাধ্যমে, যার উপস্থিতিই খোদার কথা মনে করিয়ে দিবে, অন্তরকে প্রশান্ত করবে। আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন বলে সুরা তীনে জানাচ্ছেন। লাক্বাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানা তাক্বভীম। কালো, সাদা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালার সুন্দরতম সৃষ্টি, বাহ্যিক ও অন্তরগত উভয় দিক থেকেই। মানুষের বাহ্যিক অনবদ্য রূপময়তা কদর্যতায় পর্যবসিত হয়। আসফালা সাফিলীন, যখন সে  খোদাবিমুখতা, অন্যায় ও অবিচারে খাবি খায়। আহসানা তাকবীমের সাথে যখন ইমান ও আমালে সালিহ যুক্ত হয় সেটাই তখন আসল শিল্পময়তা; শিল্প-সাহিত্য যেমন মূল্যবান হয়ে ওঠে ফর্ম ও কন্টেন্ট, আধার ও আধেয়ের যুগ্মতায়ই।

ইসলাম ব্যক্তিকেই তাযকিয়া ও তাহারাতের মধ্য দিয়ে শৈল্পিক করে তুলতে চায়। ব্যক্তিকেই, যেন, কবিতা করে তুলতে চায়। তাঁর আবাস ও চারপাশ সহযোগেই।  তাখলিয়া (পরিশোধন) ও তাহলিয়া (সুসজ্জিতকরণ) এর মধ্য দিয়ে মানুষকে আখলাকে হাসানা বা আখলাকে হামীদা অর্জন করতে হয়। মানুষের সাথে মানুষের কথাবার্তাকেও ইসলাম সৌন্দর্যে ভরপুর করতে চায়। কোরানুল করীম জুড়ে ছড়ানো আছে শৈল্পিক কথনের বিভিন্ন রূপ। যেমন, কাওলুন মারুফ (উপকারী কথা), কাওলুন মাইসুর (স্বস্তিদায়ক কথা), কওলুন আহসান (সুন্দর কথা), কাওলুন কারীম (সম্মানজনক কথা), কাওলু লায়্যিন (কোমল কথা), কাওলু সাদিদ (ভারসাম্যপূর্ণ কথা) প্রভৃতি। আবার, জালিমের সামনে হক কথা বলাও সৌন্দর্যের আরেক রূপ।

নিজেকে প্রকাশ ও প্রণয়ণের প্রিমরডিয়াল তাগিদকে ইসলাম অস্বীকার করে না, তাকে শুধু এক অভিমুখ দেয়, গন্তব্যের দিশা দেয়, পথের ইশারা দেয়। ওয়ার্ল্ড ভিউবিমুক্ত কোন এস্থেটিক্স হয় না। ক্ষমতা-সম্পর্কের সাথেও সংযোগ আছে তার। ইসলামী বিশ্ববীক্ষা জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন এস্থেটিক্সের স্বাদ পাবে দুনিয়া । রাসুলের বাণী, আল্লাহপ্রেম মানুষের ভেতরে, মনে ও মননে প্রোথিত করে দিতে শিল্প ও সৌন্দর্যের বিবিধ মাধ্যম তো ব্যবহৃত হতেই হবে। তখন পুঁজিবাদ ও ইহবাদজাত শিল্প বিষের মতোই লাগবে মুমিনদের কাছে, এখনো যেমন অনেকের কাছে লাগে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক