জগলুল আসাদ

জগলুল আসাদ

জগলুল আসাদের কলাম ‘সাহিত্যের রাজনীতি, রাজনীতির সাহিত্য’

প্রকাশিত : আগস্ট ৩১, ২০২২

সাহিত্য জগতেও রাজাধিরাজ আছে। আছে আমত্য, পারিষদ, পাইক ও বরকন্দাজ। হুমায়ূন-ইমদাদুল হক মিলন-আনিসুল হক-সুমন্ত আসলামরা জনপ্রিয় সাহিত্যের সেকুলার ধারার মুলধারা। কেননা, এরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আনুকূল্য পান। তারা যে মধ্যবিত্তের জীবনকে রূপায়িত করেন তারা আধুনিক শিক্ষা, বা আধুনিক জীবনের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। মিডিয়ার সরবরাহকৃত জীবনের ভোক্তা তারা। যে জীবনে ধর্মের সম্পৃক্তি কম, বা আত্মপরিচয় ধর্ম দ্বারা মুখ্যত নির্ধারিত নয়, সেই জীবনের রূপকাররাই বাংলাদেশে সাহিত্যের মূলধারা।

সিরিয়াস সাহিত্যের মুলধারা হিশেবে বিবেচিত ইলিয়াস-হাসান আজিজুল হক-শওকত আলীরা লেখেন উপন্যাসের বা গল্পের বৃহৎ শৈল্পিক ঐতিহ্যের ভেতর থেকে। তাদের ভাষায় আছে কুশলী নির্মাণের ছোঁয়া। তারা উন্মোচন করেন জীবন ও জীবিকায় ত্রস্ত মানুষদের বিচিত্র ইতিকথা। যাদের অন্তরজীবনে আধ্যাত্মিকতা আছে, আছে ধর্মের অনুশাসনের বোধ, ধর্মের বিধি-নিষেধের বিবেচনা সত্যি সত্যি করে যে মানুষ, সেই আন্তরিক জীবনের অভিব্যক্তি থেকে এদের সৃজনশীল রচনা সযত্নে দূরত্ব বজায় রাখে। শিল্পের একটা চিন্তা কাঠামো থাকে।

যে চিন্তা কাঠামোর ভেতর থেকে রচিত হয় এদের কাব্য বা কথাসাহিত্য। তা এক কথায় বললে সেকুলার। যে জনপরিসরে এরা পঠিত হন তারাই বাংলাদেশের রিডিং পাব্লিক বলে বিবেচিত হন, ডমিনেন্ট বয়ানে। এরাই বাংলাদেশের একাডেমিয়াতে পাঠ্য হবেন, আলোচিত হবেন। এরাই বংগদেশের সাহিত্যের মান বা অপমান। এরাই চোখের সামনে থাকেন, আলোচিত ও সমালোচিত হন। সাহিত্যের ইতিহাসে এরাই এক কোণে হলেও জায়গা পান, পাবেন। কিন্তু যে খণ্ডিত জীবন বা অনুভবভাষ্য তারা রচনা করেন, তা ফেলে রাখা অপর খণ্ডকে খুঁজে বেড়ায়।

জীবনের অই অবহেলিত বা হারানো বাকি খণ্ডের রচয়িতারা ইতিহাসের ও বাস্তবতার নিয়মেই এক সময় পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। প্রবলদের গালে মৃদু চপোটাঘাত করে, কিছুটা বোধোদয় ঘটিয়ে, মিলিয়ে যান তারা, হয়তোবা। কাশেম বিন আবুবাকাররা ওই চপোটাঘাতকারী। তারা তাদের সীমিত সামর্থে তুলে আনেন ওই অনালোকিত-অনালোচিত কিন্তু প্রবলভাবে বাস্তব এক দুনিয়ার ছবি, যা হরফে গ্রন্থিত হওয়ার সুযোগ পায়নি বললেই চলে।

এই ডমিনেন্ট রিডিং পাব্লিকের বাইরেও আরেকটা শক্তিশালী কাউন্টার পাব্লিক স্ফিয়ার আছে। যেখানে পঠিত হন কাশেম বিন আবুবাকার, মোশারফ হোসেন সাগর, আব্দুস সালাম মিতুল, আসাদ বিন হাফিজ, তৌহিদুল ইসলাম বাবু, হাশিম রনি প্রমুখ। মাসুদরানা সিরিজের সেকুলার পরিসরের শ্বাসরুদ্ধকর সাসপেন্স ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানের বিহবল জগতের পাঠক ছাড়াও ইসলামি ঘরানার যে চারটি থ্রিলার সিরিজ জনপ্রিয় সেগুলো হলো: সায়মুম, ক্রুসেড, অপারেশন ও স্পাই সিরিজ। (তথ্যগুলো আলী রিয়াজের How Did We Arrive Here বইয়ের একটি প্রবন্ধ The New Islamist Public Sphere in Bangladesh থেকে নিয়েছি)।

এই পাঠকগোষ্ঠীর মনোজগতের অন্দরে প্রবেশ বাকি রয়েছে আমাদের তথাকথিত মূলধারার সাহিত্যসেবীদের। তবে মনে রাখি যেন, ধর্মীয় ও জাগতিক, স্যাক্রিড ও সেকুলার এগুলো কোনো জলনিরোধ ভাগে বা ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত নয়। প্রেমের আকুতি, যৌনতা, জাগতিক বাসনা পূর্ণ নিধর্মীয় বস্তুও নয়। ধর্মীয় পরিসরে এগুলোও আলোচ্য, তবে বিশেষ ডিকশন ও মুডে, যে ভাষা বা ভঙ্গিও স্থির-নির্দিস্ট নয়, এতে বৈচিত্র্য আনারও সুযোগ আছে। ধর্মের নামাশ্রয়ে যে আধ্যাতিকতা তার প্রতি সায় আছে অগণন মানুষের।

যে আধ্যাতিক বাসনা কিছুটা মেটায় এই ইসলামিক রোমান্স বা থ্রিলার পুস্তকগুলো। কাশেম বিন আবুবাকারসহ হয়তো আরো দু`এক জনের রচনায় আমাদের বহুধা বিভক্ত সমাজের একটা বড় অংশ তাদের নিজদের ছবি দেখতে পায়। দেখতে পায় তাদের দ্বিধা ও দোটানা, যা ধর্মবোধজাত। উপন্যাসকে যে বহুস্বরিক বা polyphonic হওয়ার কথা কইছিলেন বাখতিন, তা আমাদের এইখানে প্রায় কেউই আমল করে নাই। উপন্যাস নামক এই শিল্প মাধ্যমে যে বিচিত্র ভোজের আয়োজন থাকার কথা, তা কই? সাহিত্যের উচ্চতা নির্ধারণকারী আপনাদের মহাত্মা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে, বন্ধুগণ!

খোদার সাথে বান্দার প্রেমিকের মতো ঝগড়া নিয়ে তো গল্প রচিত হইলো না। ধর্ম ও জাগতিক জীবনের নানা বিচিত্র টানাপোড়েন নিয়ে তো মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখিত হওয়ার কথা। হইলো না তো। জগৎ ও ধর্ম উভয়কে নিয়া মোমিনকে প্রতিনিয়ত যে বিচিত্র ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সেটা তো কারো কথাসাহিত্যে আসলো না, ক্যান? একজন মোমিন মুসলমানের যে টানাপোড়েন সেটা সকল ধর্মের ধার্মিক মানুষদেরই টানাপোড়েন। বোঝেন কিনা জানি না, আস্তিকেরও নাস্তিক্য অনুভুতি আছে। প্রবল বিশ্বাসীও জীবনের সন্ত্রস্ত কোনো মুহূর্তে বলে ফেলতে পারে, ‘কই, আল্লাহ্ আছে নাকি? থাকলে আমার জীবনে এইটা হইলো ক্যান?

এক্ষুনি পড়ে ফেলেন George Herbert এর The Collar কবিতাটি। বুঝবেন। বিশ্বাসীর এই মাহূর্তিক অনুভবকে কথাসাহিত্যে-কাব্যে আপনি ধরবেন না? নাস্তিকও বহু মুহূর্তে অনুভব করেন পরমকে। তিনি অনুভব কি একেবারেই করেন না যে, নিশ্চয় কোনো গতিমান সত্তা অধিষ্ঠিত ওই অন্তরীক্ষে, অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিতে! কোনো এক চকিত অনুভবে নাস্তিবাদী ভাইও বোধ করেন, হয়তো জগতের কোনো পরিচালক শক্তি  থেকে থাকবেন, আছেন। বোধ করেন, জানি আমি। জীবনের কোনো তুরীয় মুহূর্তে তারও আছে এমতো পরমার্থিক অনুভব। ধর্মসম্পৃক্ত এই বিচিত্র জগৎকে তুলে আনার দায়িত্ব কথাসাহিত্যিক বা গাল্পিকরা কেউ না কেউ নেবেনই। অপর হয়ে থাকা ‘অনুভব’, ‘অপরৎ হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে যারা তুলে আনবেন তারা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা পাওয়ার যোগ্য বটে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক