জগলুল আসাদের গদ্য ‘নফস ও প্রকৃত উপাস্য’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১

প্রাচীন গ্রীসের ডেলফির মন্দিরে লেখা ছিল know thyself। আপ্তবাক্যটি এস্কিলাস, সক্রেটিস ও প্লেটোতেও পাওয়া যায়, যদিও সাধারণ্যে এটি সক্রেটিসের বাণী হিসেবেই পরিচিত। ডেল্ফির মন্দিরে যেয়ে এপোলোর প্রতিনিধির কাছে মানুষ জেনে আসতো তার জীবনের অতীত ও ভবিষ্যৎ। যেমন, জেনেছিল ইডিপাস! ডেলফির দেওরিতে উৎকীর্ণ ‘নিজেকে চেনো’ বাণীটির দুটো অর্থ ছিল (ফুকোর Technologies of the self রচনায় পাওয়া যাবে এটি)। এক. নিজেকে খোদা মনে করো না। দুই. সত্যিই কী জানতে চাও, সে ব্যাপারে সতর্ক হও।

আত্মজ্ঞানের জন্যে ‘অপর’ লাগে! বাংলা অপর শব্দটি অনবদ্য: যা পর নয় কিন্তু আবার পরও, সেটাই ‘অপর’। বাংলা ‘অ=পর’ শব্দে ঝুলে আছে আপন ও পর—এই দুইয়েরই যৌথ ব্যঞ্জনা। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের ‘পরম অপর’। তিনি আমাদের পরম নিকটবর্তী, আবার পরম সুদূরও। তিনি খালিক, আর আমরা মাখলুক। আমাদের ভেতর-বাহির সম্পর্কে তিনি পরিপূর্ণ অবগত। আমাদেরকে আমাদের পরিচয়, প্রথমত ও প্রধানত, জানতে হবে আমাদের স্রষ্টার কাছ থেকে। স্রষ্টাই আমাদের পরিচয় নির্মাতা। আমরা ‘মানুষ’ না হয়ে অন্য কিছু হলেও আমরা মাখলুকই থাকতাম।

পরিচয় নির্মাণের বহুমুখী প্রচেষ্টা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমাদের পরিচয় নির্ধারিত হয়েছে যে, আমরা মাখলুক, আমরা আবদ ও আমরা খলিফা। আমরা সৃষ্ট, আমাদের যাপন ও ক্রিয়াশীলতার ম্যানুয়াল আছে, যাকে বলে ওয়াহি; আমরা আব্দ, আমাদের কাজই সন্তুষ্টচিত্ত ও স্বতস্ফুর্ততায় ঐশি ম্যানুয়াল মেনে চলা, কত ভালোভাবে ও কত পরিপূর্ণভাবে আমরা স্রষ্টার নির্দেশনা ভয়মিশ্রিত ভালোবাসায় মেনে চলতে পারি, এটাই ইনসানের সাব্জেক্টিভিটি বা আব্দের কর্তাসত্তা। আবার, জগৎকে সাজানোর আমানত গচ্ছিত মানুষের কাছে। এই কর্মময়তায় সে খলিফা, এখানেই তার এজেন্সি।

মানুষ উদ্ভ্রান্ত উপত্যকায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্তি ও অস্থিরতায়, যখন সে  নিজেকে ভুলে যায়, ভুলে যায় নিজ সত্তার দাবি ও গঠন। নিজেকে ভুলে যাওয়া মানে এটাও ভুলে যাওয়া যে, কিসের কর্তা সে, কিসেরই বা সে করণ বা কর্ম। তো, কখন মানুষ নিজেকে ভুলে যায়? আল্লাহ তায়ালা সুরা হাশরের ১৯ আয়াতে বলেছেন, তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন। তারাইতো পাপাচারী।

আল্লাহকে ভুলে গেলেই মানুষ নিজেকে ভুলে যায়, মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়। আল্লাকে চিনলেই নিজেকে চেনা যায়। রেফারেন্স পয়েন্ট আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা। তিনিই ভালো জানেন তার সৃষ্টিকে। মানুষ তার পরিচয় ভুলে গেলেই নব নব পরিচয় নির্মাণ করে, স্বরচিত শত পরিচয়ের আবেষ্টনীতে সে আটকে পড়ে। আল্লাহকে ভুলে গেলে আল্লাহর জায়গা দখল করে রিপু। রিপুর ঘেরাটপে সে খাবি খেতে থাকে নিরন্তর। আটকা পড়ে সে পরিস্থিতি ও প্রতিবেশের ঊর্ণাজালে। চারপাশের অজস্র বেড়িকেই সে স্বাধীনতা ভাবে। রাষ্ট্র ও বাজারের অদৃশ্য হাত তার transcendence।

তথাকথিত মুক্তবাজারে সীমিত অপশন থেকে বেছে নেয়াই তার স্বাধীনতা। তার কনসুমার সেলফই তার কাছে autonomous subject হওয়ার পরিচয়বাহী। পুঁজিবাদ-ভোগবাদ ও নানা ইজমের নির্মাণ করে দেয়া পরিচয়ই তার পরিচয় হয়ে ওঠে। সে রুশোর মতো মনে করবে, Self is the sufficient starting point for the analyses of the world। অসীমাগত আত্মপরিচয়কে ভুলে যেয়ে সে গ্রহণ করবে সেলফ-এর এনলাইটেনমেন্ট মডেল। মেরি শেলীর ফ্রাংকেস্টাইন মডার্ন সেল্ফ-এর প্রতীক, যাকে আমরা নির্মাণ করেছি সেই আমাদের ধ্বংস ও পতনের কারণ।

সুরা জাসিয়ার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি লক্ষ্য করেছেন তাকে, যে তার খেয়াল-খুখিকে নিজ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে?’ নিজের খেয়াল-খুশি-ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে যে ইলাহ বানায়, আল্লাহর জায়গা সে যখন নিজের ইচ্ছে ও বাসনাকে দান করে ,তখন সে বিভ্রান্ত ও উদ্ভ্রান্ত হয়। সে তখন Brave towards God হলেও Coward towards men হয়। যখন সে তার ‘হাওয়া’কে ইলাহ বানায়, স্বাভাবিক নিয়মেই তার চোখ, কান বা হৃদয় সেই হাওয়া-কেই অনুসরণ করে। ‘হাওয়া’কে ভিত্তি করে বানায় সে নিজের ধর্ম ও মতাদর্শে পরিচালনা করে সমাজ বা রাষ্ট্র।

ফিলসফিকাল লিবারেলিজম, হিউম্যানিজম ও ক্যাপিটালিজমসহ অজস্র ধর্মাচারের জন্ম দেয় সে। এগুলোকেই সে র‍্যাশনাল ভাবে। এগুলো হেদায়েত-বঞ্চিত হওয়ার উসিলা হয় তার। এই হেদায়েত আল্লাহ তায়ালার এক exclusive জোন;  যিনি পান, তিনি প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হন। এই কল্যাণ-প্রাপ্তি জগতের দূকুল ছাপিয়ে পরজগতের অসীম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।

সুরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াত আর সুরা জাসিয়ার ২৩ নম্বর আয়াত সবসময় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে হয় আমার কাছে। আল্লাহই ভালো জানেন। কেউ আল্লাহকে ভুলে গেলে নিজেকেও  ভুলে যায়। আর কেউ যখন নিজেকে ভুলে যায় তখন সে নফসকে ইলাহ বানায়। আমাদের জীবন, সমাজ ও সভ্যতার দিকে তাকালে দেখবো, নফসকেই ইলাহ বানিয়ে বসে আছি। ফলে হেদায়াত রয়ে গেছে সুদুরের ধন।  এই দুই আয়াত নিয়ে অনেকানেক দার্শনিক আলোচনা সম্ভব।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক