জগলুল আসাদের গদ্য ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২২

ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে সংঘাতমূলক দেখিয়ে লেখালেখির চল শুরু হয়নি। এমনকি Scientist শব্দটিরও ইংরেজিতে দেখা মেলেনি ১৮৩৪ সালের আগপর্যন্ত। ১৮৭৪ সালে বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘাতের ইতিহাস নিয়ে বই রচনা করেন জন উইলিয়াম ড্র‍্যাপার (১৮১১-১৮৮৮) এবং ১৮৯৬ সালে A history of the warfare of science with theology in Christendom নামে আরেকটা বই লেখেন এন্ড্রু হোয়াইট।

তারা বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করেন। ড্র‍্যাপার বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সংগঠিত ধর্মকে বাধাই মনে করেন। মানবতার পক্ষে দুটোকেই একসাথে গ্রহণ করা সম্ভব না; অবশ্যই এদের মধ্যে যে কোনো একটাকেই গ্রহণ করতে হবে, উভয়টিকে গ্রহণ করা অসম্ভব। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যকার এই সংঘাতকে Conflict thesis বা warfare thesis বলে। এটি ড্র‍্যাপার-হোয়াইট থিসিস নামেও পরিচিত।

বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম কমপ্যাটেবল না, এই পুরোনো মতের বর্তমান যুগের ফেরিঅলা হচ্ছে নব্য নাস্তিক্যবাদের চার অশ্বারোহী ও ‘বঙ্গীয় প্রগতিশীলগণ’। আবার, এর বিপরীতে মিলনতত্ত্বও আছে। সেটিও কম প্রভাবশালী নয়। বিজ্ঞানের আধুনিক ঐতিহাসিকরা দেখাচ্ছেন, ইতিহাসে দুই একটা ব্যাতিক্রম বাদ দিলে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো অনিবার্য সংঘাত দেখা যায়নি এবং অনেক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই ভূগোল, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রণোদনা আছে।

নানা ফর্মে ধর্ম ও বিজ্ঞানচর্চা যুগপৎ হাত ধরাধরি করে চলেছে মানবেতিহাসে। আধুনিকতাবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া মতাদর্শগুলোর মধ্যে অন্যতম মতবাদ বিজ্ঞানবাদও Scientism কিভাবে শত্রু-মিত্র ভেদ তৈরি করে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে বা কায়েমি ক্ষমতার সহযোগী হয়ে ওঠে, সে আলাপ অন্যদিন!

আধুনিক বিজ্ঞানকে সম্ভব করে তুলেছেন যারা, তাদের মধ্যে জোহান কেপ্লার, বয়েল, আইজাক নিউটন ছিলেন গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী। তারা মনে করতেন, প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের শৃঙ্খলার ভেতরে যে ঐশ্বরিক পরিকল্পনা পরিস্ফুট হয়ে আছে, তার অনুসন্ধান পূণ্যের কাজ।

ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ইতিহাসের অধ্যাপক জোসেফ নীডহাম একবার একটা প্রশ্ন তুলেছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম কেন পশ্চিম ইউরোপে হলো? কেন এটা ১৬/১৭ শতাব্দীতেই ঘটলো? চীনে গানপাউডার, মিশরে পিরামিড তৈরি হলেও নিয়মতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্ম ইউরোপে কেন হলো, এটা প্রশ্ন তার। মনে রাখতে হবে, আজকাল ইউরোসেন্ট্রিক বিজ্ঞানচিন্তার ‘বিপরীতে’ ভুবনময় বিজ্ঞানের বৈচিত্র্য বোঝাতে ‘বিজ্ঞানসমূহ’ বলা হয়, যার পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন ও অনেক সময় উন্মুক্ত।

এই প্রশ্নের উত্তর ইয়ান বারবার ও হার্বার্ট বাটারফিল্ড তাদের গবেষণা অনুযায়ী দিতে চেষ্টা করেছেন। ইয়ান বারবার ধর্ম ও বিজ্ঞানের মিল-অমিল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক। তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা Issues in religion and science। এখানে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত মিল ও অমিল নিয়ে, সাব্জেক্টিভ ও অব্জেক্টিভ ফিচারগুলো নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার ২০০০ সালে প্রকাশিত রচনা When Science meets religion এ তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক দেখাতে চার পর্যায়ের একটা টাইপোলোজি ব্যবহার করেন।

যেমন: Conflict, independence, dialogue ও Integration। কণাবিজ্ঞানী এই লেখক খ্রীস্টীয় দৃষ্টিতে বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক বুঝতে চেয়েছেন। হার্বার্ট বাটারফিল্ডের ১৯৫০ সালে প্রকাশিত The origins of modern Science:1300-1800 খ্রীস্টিয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। তিনি ১৬ ও ১৭ শতাব্দীকে হায়েস্ট কগনিটিভ এচিভমেন্ট হিসেবে দেখেন এবং খ্রীস্টানিটির উত্থানকে বৌদ্ধিক অগ্রগতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মনে করেন। আলোচনায় তিনি ইসলামকে বাদ দিয়েছেন।

বইটি থমাস কুনের Structure of scientific Revolutions নামক যুগান্তকারী বইটির পূর্বসূরী এবং অনেকটা কাছাকাছি মতসম্বলিত। ইয়ান বারবার ও হার্বার্ট বাটারফিল্ড এটা দেখাতে চান যে,  খোদা ও প্রকৃতি সম্পর্কে  জুডায়ো-খ্রীস্টান ট্রাডিশনের যে ধারণা সেটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সম্ভব করে তুলেছে। প্রকৃতি ও খোদা সম্পর্কে জুডায়ো খ্রীষ্টান ট্র‍্যাডিশনের যে ভাবনাগুলো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে সম্ভব করেছে, তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে:

১. প্রকৃতিকে জানা সম্ভব। খোদা মানুষকে র‍্যাশনাল মন দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে সে প্রকৃতিকে জানতে সক্ষম। খোদা র‍্যাশনালিটির চূড়ান্ত উপস্থিতি। প্রকৃতিকে জানার মধ্য দিয়ে তাঁকেও জানা যাবে।

২. প্রকৃতির অন্তর্নিহিত কিছু নিয়ম মেনে চলে। প্রকৃতি নিয়মের রাজত্ব, যাকে আমরা বলি,  ল অব নেচার। এই নিয়ম জানা সম্ভব। হোয়াইটহেড বলেন, প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলায় আস্থা না থাকলে বিজ্ঞানের কোন জীবন্ত চর্চাই সম্ভব না।

৩. মহাবিশ্ব খোদা নানাভাবেই তৈরি করতে পারতেন। কেননা খোদা যেমন ইচ্ছে তেমন তৈরি করতে পারেন। বর্তমান প্রকৃতি ও বিশ্বকাঠামো অজস্র সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে যৌক্তিক মডেলই হবার কথা।

ধর্মের এই প্রিসাপোজিশানগুলোর সাথে সিস্টেমেটিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উদ্যোগের সম্পর্ক আছে বলেই বেশ কিছু বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানের দার্শনিক মনে করেন। ধর্মের ভেতর থেকে বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্ম, এই মত কিন্তু অনেক বড় বড় একাডেমিসিয়ানদের মধ্যেও পাবেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক