প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘ঈমানের ক্রমোন্নতি’

প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০২০

ইসলামের মৌলিক বিষয় তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতকে সব সময় আল্লাহতায়ালা মানুষকে লজিক দিয়ে বুঝিয়েছেন, মানুষের আকলের কাছে প্রশ্ন ও আবেদন রেখেছেন। কোথাও কোথাও আল্লাহ মানুষকে কমান্ড করছেন, কোথাও কোথাও মমতা ভরে আহ্বান করেছেন বিশ্বাস করতে ও মেনে নিতে। কারণ প্রকৃত বাস্তবতা তিনিই জানেন, মানুষ জানে না। আবার দয়াপরবশ হয়েই আল্লাহ মানুষের আকলের অনুকূলে যুক্তি দেন। যদিও সে-যুক্তি কে মানবে বা মানবে না, সেটি ভিন্ন বিষয়। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত স্পষ্ট হলে বাকিগুলো ডিডাকশন প্রক্রিয়ায় ফেইথ বা বিশ্বাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কোরআনে আফাকি যুক্তি (বাহ্য প্রকৃতির উদাহরণের মাধ্যমে চয়িত যুক্তি), আনফুসি যুক্তি (মানবসত্তার উদাহরণ সহযোগে প্রদেয় যুক্তি) ইত্যাদি আরো নানা যুক্তি ও উদাহরণ সহকারে আল্লাহ মানুষকে বুঝিয়েছেন ইসলামের তিন মৌলিক বিষয়। যুক্তির এই প্রক্রিয়াকে বলে ইন্ডাক্টিভ প্রসেস। জগতে মানুষের বোঝাপড়াটা অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তির এই দুই প্রক্রিয়া ও স্বজ্ঞার মাধ্যমে ঘটে থাকে।

যুক্তিবোধ মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। তাই বলে মানুষ কিন্তু যুক্তিসর্বস্ব প্রাণী নয়, সর্বদাই। ‘শুনলাম ও মানলাম’ এটা ঈমানের দাবি। এটি তাদের জন্যে প্রযোজ্য, যাদের এরই মধ্যে ঈমান নসিব হয়েছে। আমাদের জন্যে, মুসলিমদের জন্যে। নবি বলেছেন, আল্লাহ বলছেন, সো, মানতে হবে। ঈমানের পর এটাই যুক্তি। তবে একটা প্রাক-পর্যায় আছে। তিনি নবি কিনা বা এটা আল্লাহ বলছেন কিনা। কোরআনের প্রথম শ্রোতাদেরও মেন্টালি সেটিস্ফাইড হতে হয়েছে এ বিষয়ে। ইব্রাহিমকেও (আ.) ঈমান সত্ত্বেও আল্লাহর সৃষ্টিকে জীবিতকরণ প্রক্রিয়ার নিদর্শন দেখবার একটা লজিকাল-এম্পেরিকাল প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নবিকে (সা.) মেরাজের মধ্য দিয়ে আল্লাহতায়ালার মহাজগতের ব্যবস্থাপনা দেখানো হয়েছে। ঈমানের পরই আসে ‘শুনলাম ও মানলাম’ পর্যায়।

আবু বকর (রা.) মেরাজকে যে বিশ্বাস করলেন, কারণ কি? কারণ, নবি বলছেন। কারণ, নবি এর আগে কোনোদিন মিথ্যা বলেননি। তার গোটা জীবন আবু বকরের (রা.) সামনে ছিল। সুতরাং, অটোমেটিকালি তার মন সায় দিল, নবি যদি বলে থাকেন তবে তা সত্য। ভাবেন, খাদিজা (রা.) ইসলাম গ্রহন করলেন কেন? কারণ, নবিকে তিনি বিশ্বাস করেছেন। কেন বিশ্বাস করেছেন? কারণ, নবিকে তিনি জেনেছেন যে তিনি মিথ্যাবাদী নন। তার আখলাক তার কথা ও দাবির প্রমাণ। হিউম্যানলি এভবেই মানুষ বুঝে।

তারা কি চিন্তা করে না, তারা কি বোঝে না ইত্যাদি প্রশ্ন কোরআনে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। নবিকে নবি ও আল্লাহকে ইলাহ হিশেবে মেনে নেয়ার পর আর কোনও প্রশ্ন নেই। মুমিনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও নবির কথার পর আর কোনও কথা চলে না। বাংলা বিশ্বাস শব্দ ব্যবহার না করে ঈমান ব্যবহার করার পক্ষেই অনেকে আজকাল। কারণ, কিছু অনুবাদ ভুল বার্তা দেয়। কিন্তু মানুষ কোথায় নিজেকে সাবমিট করবে এটার বিবেচনা তার ভেতরই থাকে। আল্লাহ-চেতনা মানুষের এক ডিফল্ট চেতনা, অন্তর্গত সেটিং-এর ভেতরেই এই চেতনা প্রোথিত।

আল্লাহ বলেছেন, ফা আলহামাল ফুজুরাহা ও তাকওয়াহা। ভাল ও মন্দের ইলহামি জ্ঞান বা ইন্টিউশন মানব প্রজাতিকে সৃষ্টিগতভাবেই দান করা হয়েছে। এই আকল দিয়ে সে বুঝে, বিচার করে, জানে, মানে। নবুয়ত তো আল্লাহরর সিলেকশন। তাছাড়া, এক অর্থে ঈমানও আল্লাহ যাকে চান তাকে দেন। তবে অনাগ্রহী হৃদয়কে আল্লাহ হেদায়াত দেন না সাধারণত। ঈমান অর্জনের পেছনে যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও আল্লাহর হেদায়াত কার্যকর। নবিকে আল্লাহ মেরাজে নিলেন কেন? ইব্রাহিম (আ.) কেন জানতে চাইলেন আল্লাহ কিভাবে প্রাণ দেন? ঈমান আবার একটা অভিজ্ঞতাও। দীনের পথে চলতে চলতে মানুষের হৃদয়ের ভেতরে চূড়ান্ত নিশ্চিতির বোধ হয়। সালাত, ক্রন্দন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব আমরা টের পাই। ব্যক্তিগত ধর্মীয় এই অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের আছে। সাহাবারা একে অপরের সাথে দেখা হলে প্রায়শই বলতেন, আসেন আমরা ঈমানের নবায়ন করি। মানে, দীনের আলোচনাতে ঈমান বৃদ্ধি পায়। ঈমান খুব বিশাল ব্যাপার। একে শুধু বিশ্বাস শব্দ দিয়ে বোঝা যায় না।

আবার আরেক দিক দিয়ে দেখলে, নবি কিন্তু হেরা গুহায় ধ্যানও করেছেন। যদিও এটার স্বরূপ আমরা জানি না। তিনি ফেরেস্তা দেখেছেন, আবার খাদিজার (রা.) মামা বা চাচাতো ভাই ওয়ারাকার কাছে জানতেও চেয়েছেন তার এই অভিজ্ঞতার মানে। আর তিনি ওয়াহি পেতেন খোদার। তিনি তো বুঝেইছেন, এটা আল্লাহর থেকে আগত বার্তা। অন্যদেরকেও তাই বুঝতে হবে কোরআন আল্লাহর বার্তা। নবি যেমন নিজে বুঝেছেন তিনি আল্লাহর নবি, অন্যদেরকেও বুঝতে হয়েছে তিনি নবি। চর্চা করতে করতে, চিন্তা করতে করতে ঈমান দৃঢ় থেকে দৃঢ় হয়। ঈমান তাই ক্রমাগত হয়ে ওঠার ব্যপারও। ঈমানের নিম্ন পর্যায় যেমন আছে, তেমনি আছে উচ্চতর পর্যায়ও। ঈমানের সর্বোচ্চ বিন্দুতে আছেন নবি (সা.)। কারণ তিনি আল্লাহর মনোনীত। তিনি ওয়াহিপ্রাপ্ত ও মেরাজে আল্লাহতালার বিশ্ব ব্যবস্থাপনা স্বচক্ষে দেখনেঅলা। তারপর সাহাবাগণ। কারণ সত্যকে তাঁরা চাক্ষুষ করেছেন নবির মধ্যে, যে নবির জীবনের প্রায় প্রতিমুহূর্ত তাদের চোখের সামনে ছিল।

আর আমাদের যুগে ঈমান অর্জনের পদ্ধতি কি হবে? আমাদের সামনে নবি দেহগতভাবে নেই, আল্লাহর ওয়াহি আর নাজিল হয় না নবির উপর। তো ঈমান অর্জন করতে হলে আমাদের কি লাগবে? যা লাগবে আল্লাহ তা বলছেন। ফা আলহামাল ফুজুরকহা ওয়া তাকওয়াহা। মানে, আমি তোমাকে ভালো-মন্দের জ্ঞান দিয়েছি। সুতরাং, আল্লাহর দেয়া এই জ্ঞানটুকু কাজে লাগিয়ে ঈমানের প্রাথমিক স্তর অর্জন করতে হবে। আরেকটা কথা হচ্ছে, আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দেন। কারো হৃদয়ে হঠাৎ করে সত্যের উপলব্ধি আল্লাহ প্রোজ্জ্বল করে দেন, সত্যকে বুঝবার তাওফিক এনায়েত করেন। এই যে অভিজ্ঞতা এটা ঈমানি অভিজ্ঞতা। এটা বিশ্বাস না। এটা চূড়ান্ত নিশ্চিতির বোধ। বিশ্বাস তো ধারণা, যা মিথ্যাও হতে পারে। আমলের মধ্য দিয়ে ক্রমাগতভাবে ঈমান দৃঢ়তা পায়।

নবির চেহারা, তার উপস্থিতি, চোখের উজ্জ্বল দ্বীপ্তি বা সৌম্য অবয়বও চকিতে অনেকের মধ্যে জাগিয়ে তুলতো সত্যের অনুভব, চিন্তা স্থগিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ঘটতো সত্যে নিমজ্জন। বাকি কালজুড়েই চলতো সেই সত্যে আবাহন। নবির চেহারা দেখেও অনেকে ঈমান এনেছে। তার চেহারা একজন মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে নারাসুলুল্লাহকে (সা.) দেখে বনু কায়নুকা গোত্রের তাওরাত-পণ্ডিত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বলেন এই কথা। পরে, কিছু কথোপকথনের পর তিনি ঈমান আনেন মুহাম্মাদের (সা.) রিসালাতে। নবির শারীরিক উপস্থিতি ও চেহারা-দর্শনই অনেকের ঈমানের কারণ হয়েছিল। আর তাঁর কথা শ্রবণের অভিজ্ঞতা অনেক সত্য অন্বেষীর হৃদয় ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছিল। অনেকে দূর থেকে তাঁর খবর শুনে, কাছে এসে তাঁকে দেখে ও শুনে ঈমান এনেছেন তাঁর উপর। ঈমান আনার ইতিহাস বড় বিচিত্র!

কোরআনের আয়াতের ভেতরকার সম্মোহনী শক্তিও ঈমানের কারণ হয়। সুরা ত্বোয়াহার ১৪ নং আয়াত, ‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোনও উপাস্য নেই। অতএব তুমি আমারই ইবাদত করো এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম করো। (ত্বোয়াহা ২০/১৪) পাঠ করেই ওমর (রা.) বলে উঠলেন, ‘কতই না সুন্দর ও কতই না মর্যাদাপূর্ণ এ বাণী? তোমরা আমাকে মুহাম্মাদ কোথায় বলে দাও।’ এভাবে কোরআন হয়ে ওঠে ঈমানের উসিলা।

মক্কা বিজয়ের পরেও অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইতমামে হুজ্জাত বা দলিল-প্রমাণের পূর্ণতা একেকজনের একেক সময়ে বা ঘটনায় ঘটে থাকে। মক্কা বিজয়ের পর এবং বিজয়োত্তর নবির আচরণ দেখেও অনেকের কাছে ঈমান আনার বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল। সুতরাং দ্বীন বিজয়ী হলে তার ঐশ্বর্য ও বিভা অবলোকন করলে মন সায় দিয়ে ফেলে সত্যের আহবানে। পরাজিত অবস্থাতে কেউ কেউ ঈমান এনেছিল, আর বিজয়ী হওয়ার পরও মানুষ ঈমান এনেছিল দলে দলে। তাই দ্বীনকে পূর্ণোচ্ছটায় দুনিয়ায় প্রকাশিত হতে দিলে অধিক সংখ্যক মানুষের ঈমান নসিব হয়। ঈমান একই সাথে যুক্তি-অনুভূতি-আস্থা-অভিজ্ঞতা-হেদায়াতের বাস্তবতা ইত্যাদির এক এপোরেটিক হাল, এলোজিকাল কন্ডিশন। ঈমান দিব্যমুহূর্তের আলোকিত উদ্ভাসন কারো কারো জন্যে।