জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘কবিতার ধ্বনিগুণ’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯

কবিতার এক আশ্চর্য শক্তি আছে শব্দ দিয়ে শব্দ শোনাবার, ধ্বনি দিয়ে ছবি আঁকার। করাত কলের আওয়াজ শুনতে পাবেন The buzz-saw snarled and rattled in yard পঙ্‌ক্তির `র` ধ্বনির পুনরাবৃত্ত ব্যবহারে। রররররররর। হেমন্তের ভরা মৌসুমে যখন ফুটে থাকে শত পুষ্পদল, মৌমাছির মনে হয় এ মধুমাস যেন শেষ হবার নয়। অজস্র মৌমাছির গুঞ্জরণ কবি তৈরি করেন flowers, bees, days ও cease এর ক্রমোচ্চারিত জ (z) ধ্বনির মধ্য দিয়ে:

still more, later flowers for the bees,
Until they think warm days will never cease,
For summer has o`er-brimm`d their clammy cells.

এই `জ` ধ্বনির অনিবার উচ্চারণের ভেতর দিয়ে মৌমাছির `বাজিং" সাউন্ড ধরা পরে। আবার এই পঙ্‌ক্তি For summer has o`er-brimm`d their clammy cellsটি "m" এর ভারে যেন নুয়ে পড়ছে, ঠিক যেমন মধুতে পূর্ণ মৌচাক মধুর ভারে নুয়ে পরে। কবিতা শুনবার যেমন, তা দেখবারও, দেখাবারও।

কোলরিজের কুবলা খান নামের একটি কবিতা আছে, যেটিকে বলা হয় মেটা পোয়েম বা কবিতা বিষয়ক কবিতা। কবিতাটিকে পাঠ করা যায় কোলরিজের সাইকোপোয়েটিক ক্রাইসিসের এলিগরি হিশেবেও। এই কবিতায় একটি ঝর্ণার জন্মের উদ্দাম বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেটিকে সমালোচকেরা কবির ভেতরে কাব্যের জন্মের উন্মাদ ও আন্দোলিত মুহূর্তের প্রতিতুলনা ভাবেন। তো, কবিতার এই অংশে ভূ-গর্ভ থেকে উত্থিত ঘূর্ণায়মান শিলাখণ্ড ও পরস্পরের আঘাতে উপলখণ্ডসমূহের বিচূর্ণায়নের আওয়াজ ও দৃশ্য কবি তার ব্যবহৃত শব্দরাশির ভেতরে ধরে রেখেছেন অনবদ্য দক্ষতায়:

A mighty fountain momently was forced:
Amid whose swift half-intermitted burst
Huge fragments vaulted like rebounding hail,
Or chaffy grain beneath the thresher`s flail

ল, ম, ট ও ড ধ্বনির প্রাচুর্যে ভূ-ভাগ ভেদ করে শিলারাশির উত্থান, ঝর্ণার সজোরে নির্গমন ও উপলখণ্ডের সংঘাতে তাদের টুকরোগুলো দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়বার দৃশ্য `শোনাবার` জন্যে দরকার ছিল এমন হার্ড সাউন্ডিং শব্দাবলির ব্যবহার। সত্যিকার কবি প্রাণ ভাষাকে বাজিয়ে তুলতে পারেন। শব্দ ঘষে তুলতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি।

আবার শেলীর ‘ঔড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতার দ্বিতীয়াংশে আছে বজ্র, বিদ্যুচমক, শিলাবৃষ্টির বর্ণনা। দিগন্তের মৃদু প্রান্ত থেকে মধ্যগগণ পর্যন্ত কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে আকাশের যে গম্বুজ সদৃশতা তৈরি হয় তা যেন বিগত বছরের সমাধিঘর। কাল বৈশেখি যেন একই সাথে শোক ও শক্তি হয়ে আকাশের কালো জমিন ফাটিয়ে ঝড়ায় কৃষ্ণ বৃষ্টি ও শিলাপাত:

Thou dirge
Of the dying year, to which this closing night
Will be the dome of a vast sepulchre,
Vaulted with all thy congregated might
Of vapours, from whose solid atmosphere
Black rain, and fire, and hail will burst: oh hear!

শেলীর শব্দ ব্যবহারেও আমরা যেন দেখি আসমানের বিপুল কলোরল, শব্দের ঘর্ষণে বিদ্যুৎচমক ও বজ্রধনি। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ পঙ্‌ক্তিতে প্রলম্বিত "আ" ধ্বনি যে বিলাপ ও বেদনা তৈরি করে, যে হাহাকারের ব্যঞ্জনা তোলে তা রসিকের কান শুনতে পায়, অন্তর তার আর্দ্রতা বুঝে যায়।

 

শোনা যাক আরেকটি কবিতা, কবিতা তো প্রথমত শুনবার ও শোনাবার জন্যেই:

বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল

গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।

গাঙের ঢেউয়ের কুলকুল ধ্বনির সাথে কী আশ্চর্য দক্ষতায় আল মাহমুদ মিলিয়ে দিলেন ‘কবুল কবুল’ এর বিরতিহীন ধ্বনি। কুলকুল শব্দদ্বয় ব্যবহৃত না-হলেও পাঠকের কল্পশ্রুতি `কবুল কবুল`কে মিলিয়ে দেয় নদীর কুলকুল প্রবাহে ব্যঞ্জিত ধ্বনির সাথে। ‘মহা মাতৃকুল’ আর ‘কবুল কবুল’ এর অন্তমিলের তলদেশে প্রবাহিত নদীর দুকুলপ্লাবী কুলকুল ধ্বনির সাথে এমন আকুল কবুলের বিহ্বল সমতান আল মাহমুদ ছাড়া আর কে শুনিয়েছে! ঠাকুরের ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ পঙ্‌ক্তিও ‘লেগেছে’ শব্দের মধ্যস্থতায় ফাগুনের সাথে আগুনের জোড় ঘটায়। যেন কানে বাজে ‘আগুন লেগেছে বনে বনে’। যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ফাগুন, বনে বনে, আলো ও উত্তাপ নিয়ে।

 

এভাবেই কবিতায় চলে ধ্বনির খেলা, শব্দ দিয়ে শব্দ করা, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, অনুভব আঁকা, শব্দ দিয়ে আগুনের ফুলকি তোলা, বেদনার দীর্ঘায়িত বিলাপকে ধরে রাখা, মুহূর্তকে গ্রেফতার করা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক