
জনবিচ্ছিন্ন শিক্ষিত সমাজ এবং তাদের সংস্কৃতি
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী `বাংলা সাহিত্য ও বাংলা মধ্যবিত্ত` গ্রন্থে ঊনিশ শতকের সাহিত্যিক আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে লিখেছেন, সংস্কৃতিপ্রীতি ও ইংরেজপ্রীতি দুটাই ছিল তাদের। এই আপাত-বিরুদ্ধ দুই প্রীতির মধ্যে ঐক্যটা কোথায়? ঐক্য উভয়ের জনজীবন বিচ্ছিন্নতায়। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, জনজীবন থেকে এঁরা দূরে থেকেছেন, জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন; কখনো সংস্কৃতের আড়ম্বর দিয়ে, কখনো ইংরেজি ভাষা দিয়ে। যেমনভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন ইংরেজের কাছে, দেখা যাচ্ছে ঠিক তেমনভাবেই অধীন ছিলেন সংস্কৃতির। এই যে দুই দিকে মুখ, এটি ঊনবিংশ শতাব্দীর এবং পরেরও শিক্ষিত মানুষের বৈশিষ্ট্য; এটি তাদের জীবনেই ছিল। ইংরেজদের সামনে একরকম, ঘরে ভিন্ন রকম। এ তাদের চিন্তা-চেতনাতেও ছিল, তারা একইসঙ্গে গুরু মেনেছেন সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদকে।
বর্তমানের মধ্যবিত্ত, ইংরেজি শিক্ষিক ভদ্রলোক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বেলায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য মিলে যায়। প্রায় সকলেই এরা বাজার সংস্কৃতির এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে লুটপাটকারী ধনিকদের দোসর। মুখে বা কথাবার্তায়, কিছু লেখনি বা কাজে এঁদের বিপ্লবীয়ানা আসলে নিজেকে সংস্কৃতিবান প্রমাণ করতে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভাগ বসাতে। জনবিচ্ছিন হয়ে আসলে সত্যিকারের সামাজিক বিপ্লব ঘটনো যায় না। ঊনিশ শতকের সাহিত্যিক বা চিন্তকদের সঙ্গে এদের পার্থক্য হলো, তাদের মতন সৃষ্টিশীলতা বা কর্মযজ্ঞ এদের নেই। কিন্তু যা আছে তাহলো, ক্ষমতার সঙ্গে আপস করার পূর্ণ প্রচেষ্টা, সেখানে লজ্জা পাবার কারণটা পর্যন্ত নেই। ব্রিটিশ শাসনে ঊনিশ শতকের সৃষ্টিশীলরা ছিলেন ইংরেজ শাসকদের পদলেহনকারী, এখনকার সুবিধাভোগীরা সত্যিকারের সৃষ্টিশীল গুণাবলি ছাড়াই শাসকদের পদলেহন করে চলেছেন।
ব্রিটিশ শাসকরা দুশো বছর ক্ষমতায় ছিল। তখন সৃষ্টিশীলদের ইংরেজ ছাড়া আর কারো পদলেহনের সুযোগ ছিল না। বর্তমানকালে শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে পদলেহনকারীদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। জনগণের সঙ্গে তাদের মানসিক সম্পর্ক নেই, যা আছে নিজেদের লক্ষ্য সাধনে জনগণকে ব্যবহার করা। নিজেদের স্বার্থের নানা আন্দোলনে ভাওতা দিয়ে জনগণকে তাদের পেছনে জড়ো করে শক্তি প্রদর্শন করা, যখন আন্দোলন সফল তখন জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়ে সরকারি নির্যাতনের পক্ষে দাঁড়ানো। বাজার সংস্কৃতির সঙ্গে এঁদের আঁতাতটা খুব জোরালো। বাজার সংস্কৃতির পক্ষে দরকার হলে এঁরা নিজ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বাজার সংস্কৃতি আর সরকার সবসময় একদিকে, ফলে ভদ্রলোকদের বাজার সংস্কৃতির পক্ষ নিয়ে কখনো সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়নি। বিশেষ এক সরকারের বিরুদ্ধে এদের আন্দোলন নতুন আরেক সরকারের কাছে থেকে কিছু হাতিয়ে নেয়ার জন্য।
নিজের সমর্থিত সরকার লুটপাট করুক তাতে তাদের সামান্য আপত্তি নেই, লুটপাট থেকে নিজেদের ভাগটা পেলেই হলো। সরকারের লুটপাটের ভাগ পেতে নিজের দল বা মত পাল্টাতেও এদের সামান্য আপত্তি নেই। সমাজে সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে এরাই স্বীকৃত ক্ষমতাবানদের প্রচারমাধ্যম দ্বারা। সাম্প্রতিককালে সংস্কৃতিবান এসব মানুষের ভিন্ন একটি কাজ হচ্ছে, যে কোনো আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য মহানুভব দ্বিমুখী চরিত্রে আবির্ভূত হওয়া।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচ্য গ্রন্থে কলকাতার বাবুদের সম্পর্কে লিখেছেন, নাগরিক মধ্যবিত্ত তার বিকাশের ধাপে ধাপে শিক্ষালাভ করেছিল, সেটা ইংরেজি শিক্ষা। কিন্তু সাহিত্য চর্চা করেছে বাংলায়। বাংলা ভাষার উপর সেখানে সাহিত্যিক লেখকদের ভরসা। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, `বাঙলা সাহিত্য, বাঙালার ভরসা`। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিম প্রমুখ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, `যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের আনুকূল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন`। কিন্তু এই অমূল সম্পদ কি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব ছিল? রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, `দেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত, সাহিত্য তাদের কাছে নীহারিকার চেয়ে দূরবর্তী`। তিনি দেখাচ্ছেন যে, ভদ্রলোকরা চায়নি সমাজের সকলে শিক্ষিত হয়ে উঠুক। বরং সেই সব মনীষীরা দরিদ্রদের ধনীদের পক্ষে আরও দরিদ্র করে রাখতে চেয়েছেন।
বঙ্কিম নিজের রচিত `বঙ্গদেশের কৃষক`, `সাম্য` কিংবা মীর মশাররফ হোসেনের `জমিদারদর্পণ` ইত্যাদি রচনার প্রচার চাননি সমাজবিপ্লব ঘটে যাবার ভয়ে। বুঝতে হবে ঊনিশ শতকের মনীষীদের এই মানসিকতাটি। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ বাংলা ভাষা এবং গদ্য সাহিত্যের বিকাশ চেয়েছেন, কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষের সমাজবিপ্লব চাননি। ভিন্ন দিকে পরবর্তী বাঙালী সাহেবরা সব সময় অনুকরণ করেছেন ইংরেজি সংস্কৃতি আর চালিয়ে গেছেন ইংরেজি ভাষায় চিন্তাভাবনার চর্চা। দুপক্ষের দিক থেকেই আছে ভয়াবহ জনবিচ্ছিন্নতা। শিল্প সাহিত্য কার জন্য সেটা নিয়ে তারা ভাবতে রাজি ছিলেন না। প্রাচীন গ্রীসে প্লাটো যেমন ক্রীতদাসদের নাগরিক বা স্বাধীন মানুষ বলেই গণ্য করতেন না, ঊনিশ শতকের মনীষীদের কাছে সাধারণ মানুষরা একরকম অস্পৃশ্যই ছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, বস্তুত বিদ্যাসাগরের কালে বাঙ্গালা দেশ বলতে দেশের সাধারণ মানুষকে বোঝাতো না, কেবল উঁচু মানুষদেরকেই বোঝাত। সেই জন্য ইংরেজদের সঙ্গে কণ্ঠমিলিয়ে তাঁরা বলেছিলেন, দরিদ্রদের পাঠ করবার অবসর নেই, ফলে শিক্ষা তাদের জন্য নয়। ঠিক যেন মনু সংহিতার সেই মনুর বিধান, শূদ্রদের এবং নারীদের বেদ শোনা বা পাঠ করার অধিকার থাকবে না। সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনে ভদ্রলোকরা পড়াশুনা করার সুযোগ দিতে চাননি তাদের হাতে পড়াশুনার অবসর নেই বলে। শিক্ষিত ভদ্রলোকরা তাহলে কেন সাধারণ মানুষের উপর থেকে পরিশ্রম বা কাজ কমিয়ে দিয়ে তাদের জন্য শিক্ষালাভের অবসর করে দিলেন না? কারণ মনে প্রাণে নিজেরাই চাননি, সকলে শিক্ষা লাভ করুক। সকল বর্ণের মানুষের শিক্ষার দরকার নেই বিদ্যাসাগর সে কথাই বলেছিলেন।
গ্রামের দরিদ্র মানুষের হাতে সৃষ্ট চমৎকার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হলো ব্রিটিশ শাসনে। ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরসহ বাবুদের অবদান ছিল এই ঘটনার পেছনে, ব্রিটিশ শাসনে নিজেদের স্বার্থে পাঠশালা শিক্ষার ধ্বংস চেয়েছিলেন। ধ্বংস করেছিলেনও, তার ফলে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার কমে যায়। বলা যায়, আধুনিক ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষিতরা সর্বদাই ছিল জনবিচ্ছিন এবং জনগণের অধিকার বা স্বার্থের বিরুদ্ধে। ঊনিশ শতক, বিশ শতক এবং একুশ শতকে একই ধারা প্রবাহিত। বাংলাদেশের জন্য এটা যেন আরও বড় সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঊনিশ শতকের মানুষের বাংলা ভাষাকে বিকশিত করা, গদ্য সাহিত্য সৃষ্টি, সমাজ সংস্কার সহ নানারকম ভূমিকা ছিল, যা আজকের ভদ্রলোকদের নেই। বাংলা ভাষাকে ঊনিশ শতকের মনীষীরা বিকশিত করেছেন, আর এখন তাকে ধ্বংস করছে নতুন ভদ্রলোকরা।
ঊনিশ শতকে সব কিছুর পরেও বড় বড় বহু মনীষীর জন্ম হয়েছে, যাদের মতন মানুষ আর এখন পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান সময়ের ভদ্রলোকদের ঊনিশ শতকের ভদ্রলোকদের গুণাবলি নেই। সকল দোষ ত্রুটির পরেও ঊনিশ শতকে জন্মেছিলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ অনেক মানুষ। বিশেষ করে মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিম আর রবীন্দ্রনাথের কথা বলতেই হবে, সব বিচারে যাঁরা আজও শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাদের কেউ তথাকথিত ভদ্রলোক ছিলেন না। নজরুল জন্মেছিলেন বিশ শতকের শুরুতে। বাংলা ভাষাকে, বাঙালির জীবনকে নানাভাবে উজ্বল করে রেখে গেছেন তাঁরা। বাংলা গানের জগৎকে যা দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল, তা তুলনাহীন। কিন্তু বর্তমানের ভদ্রলোকদের প্রায় সকলের ক্ষমতাবানদের চাটুকারিতা ছাড়া আর সৃষ্টিশীল কাজ কী আছে যা আলোচিত হতে পারে যুগ যুগ ধরে!
সাধারণ মানুষের সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে তথাকথিত সংস্কৃতিবান বা শিক্ষিতরা। কিন্তু এঁদেরই সর্বদা মায়াকান্না বাংলার সংস্কৃতির জন্য। সংস্কৃতি কোনো অনড় বিষয় নয়, সাধারণের সংস্কৃতি নগরে বসে মায়াকান্না কেঁদে রক্ষা করা যায় না। বাংলার সংস্কৃতি বলতে যা বোঝানো হয়, সেটা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতে। সাধারণ মানুষের যতদিন প্রয়োজন সেটা টিকে থাকবে। নাগরিক ভদ্রলোকরা হাজার কান্নাকাটি করলেও সেটা টিকবে না, যদি গ্রামের সাধারণ মানুষ তা আর না চায়। নাগরিক ভদ্রলোকদের যে সংস্কৃতি তা বাংলার আবহমান সংস্কৃতি নয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে কখনো সেটার সুরক্ষা তাঁরা দিতে পারেন না। কারণ ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সংস্কৃতি হচ্ছে বাজার সংস্কৃতি। বাজার সংস্কৃতি মেনেই তাঁদের সামগ্রিক জীবন যাপন; বাড়িঘর, আসবাবপত্র, খাদ্যভ্যাস, পোষাক, উৎসব, কথাবার্তা বলার ঢং সব কিছু। বরং তাঁরা প্রতিদিন বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে সংক্রামিত করছে পাশ্চাত্যের বাজার সংস্কৃতির দ্বারা। প্শাপাশি মায়াকান্না চালিয়ে যাচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের নামে।
মনের গভীরে এঁরা বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতা বোধ করে তার হাজারটা প্রমাণ দেয়া যাবে। বাংলা ভাষার জন্য যদি আন্দোলন না হতো, গ্রামের সাধারণ মানুষ কি উর্দু ভাষায় কথা বলতো? কখনো না। নিজের মাতৃভাষাতেই সে কথা বলতো। ব্রিটিশ শাসকরা যখন ভারতে ইংরেজি ভাষা চালু করে, গ্রামের মানুষরা কি ইংরেজি ভাষাকে মান্যতা দিয়েছে? নাকি নিজের ভাষা চালিয়ে গেছে? ভারতের ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকরা কেউ মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করেন না, মাতৃভাষা খুব একটা বলতে চান না। বরং ভারতবর্ষের প্রতিটা অঞ্চলে মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। ভদ্রলোকদের বড় একটা অংশই এই মানুষদের শত্রু। সুবিধা পেলে জনবিচ্ছিন্ন এই মানুষদের সরকারের চাটুকার হতে সামান্য আপত্তি নেই। বাজার সংস্কৃতির হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সামান্য দ্বিধা করবে না এঁরা। জনগণের করের টাকায় এরা শিল্প সংস্কৃতির চর্চা করে, জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। জনগণের শক্তি নেই তাতে বাধা দেয়। জনগণ যদি বুঝতে পরতো তাদের করের টাকায় শিল্প সাহিত্য বা শিক্ষার জগতের লোকরা কীভাবে তাদের ঠকাচ্ছে, তাহলে এসবের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়াতো।
জনগণের ক্ষমতা থাকলে শিল্প সাহিত্য চর্চার জন্য তাদের করের টাকা প্রদান বন্ধ করে দিতো। শিল্প সাহিত্যের নামে জনগণের টাকা লুট হবে, জনগণ কি সেটা মেনে নিতে পারে? জনগণ কি দেখতে চাইতে পারে তার টাকায় তার বিরুদ্ধে শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে? দুর্ভাগ্য এই যে, বৃহত্তর জনগণ ব্যাপারটা বুঝতে পারে না এবং তাদের ক্ষমতা নেই যে সেটা রুখে দেয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক