জাতির রাষ্ট্রভাগ্য অথবা রাষ্ট্রহীনতা ও শরণার্থী জীবন

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০১৯

মানব অধিকার, রাষ্ট্রহীনতা, জাতিরাষ্ট্র ও শরণার্থী প্রসঙ্গে আলোচনায় হান্না আরেন্ড প্রায় অনিবার্য নাম। তিনি নিজেও ছিলেন শরণার্থী। ১৯৪৩ সালে স্থানীয় এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার We Refugees নিবন্ধটি, যেখানে তিনি আবেগঝরা অশ্রুমথিত ভাষায় ব্যখ্যা করেন শরণার্থী হওয়ার মানে, শরণার্থীর অনিঃশেষ উদ্বেগ, বিধ্বংসী হতাশা, ভ্রাম্যমান অস্তিত্ব আর নামমাত্র বেঁচে থাকার করুণ ইতিবৃত্ত। Hannah Arendt এর এই নিবন্ধের সূত্র ধরে অর্ধশত বছর পর একই নামে জর্জিও আগাম্বেনও প্রবন্ধ লিখেছেন। যাই হোক, জার্মান দেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে তিনি চেকোস্লোভিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছান প্যারিসে। পরবর্তীকালে নাগরিকত্ব লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের। রাজনৈতিক দার্শনিক হিশেবে ইহুদি বংশোদ্ভূত এই নারীর অন্তর্দৃষ্টি অতুলনীয়। দেশহীনতা ও শরণার্থী জীবনের দগদগে ক্ষত থেকে জন্ম হয়েছে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Origins of Totalitarianism. এই বইয়েরও একটি অধ্যায় The Decline of Nation state and the end of human rights। এই নিবন্ধের একটি পর্যালোচনা জাঁক রাসিয়েও তার Dissensus: On Politics and Aesthetics বইয়ের The subject of the of the rights of man অধ্যায়ে করেছেন। নাগরিকত্ব, মানবাধিকা, রাজনৈতিকতা ও রাষ্ট্রহীনতা নিয়ে এই তিন দার্শনিকের বয়ান মাথায় রেখে পাঠ করলে মহার্ঘ লাভের সম্ভাবনা।

হান্নাহ আরেন্ড বলছেন, স্টেটলেস পিপলদের কোনো দেশ নেই, ক্ষমতা নেই, আছে শুধু মানবিকতা। নাগরিকত্বের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন হান্না আরেন্ড। কেননা, রাষ্ট্রের অধিকার থাকে যেকোনো গোষ্ঠীকে ‘নাগরিকত্ব’ থেকে বঞ্চিত করবার। যেটা ১৯৮৩ সালে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। ‘মানুষের অধিকার’ এর জায়গা দখল করে ‘নাগরিকের অধিকার’। হান্নাহ আরেন্ড এটাকেই End of Rights of man বলেছেন। বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর প্রধান তিন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে: অস্ট্রীয়-হাঙ্গেরীয়, রাশিয়ান ও অটোম্যান সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তিচুক্তিগুলি পুরোনো এই সাম্রাজ্য ভেঙে অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্র তৈরি করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ভেঙে জন্ম নেয় অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভিয়া এবং যুগোস্লাভিয়া। রাশিয়া থেকে জন্ম হয় ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি তাদের বাড়তি ভূখণ্ড ছেড়ে দেয় পোলান্ড ও রোমানিয়াকে। অটোম্যান সাম্রাজ্যকে ভূমি ছেড়ে দিতে হয় দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে। `ইউরোপ`এ থাকে শুধু তুরস্ক। সাম্রাজ্যগুলোর ভিত্তি ছিল বিভিন্ন বিজয়ী অঞ্চলের জনসমষ্টিকে অভিন্ন আইনের অধীনে এনে শাসন করা।

সাম্রাজ্যের পতনে যেসব জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠে তাদের ভিত্তি ছিল সরকারের প্রতি ‘সমগোত্রীয় জনসমষ্টির সক্রিয় সম্মতি’। বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিভিন্ন শান্তিচুক্তির ফলে জন্ম হয় এইসব বিবিধ জাতিরাষ্ট্রের। বিশেষ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বঞ্চিত রাষ্ট্রহীন মানুষের উত্থানের মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটে। হান্না আরেন্ড এটাকে বলেন the transformation of the state from an instrument of the law into an instrument of the nation। এই রূপান্তরের মধ্যদিয়ে আইনের উপরে প্রাধান্য পেল জাতীয় স্বার্থ। হান্নাহ বলছেন, জাতি দখল করে নিল রাষ্ট্রকে: nation had  conquered the state। এটাকে জাতি রাষ্ট্রের গন্তব্য বলেই চিহ্নিত করেন আরেন্ড। প্রথমদিকে স্বেচছাচারী প্রশাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের বিপরীতে আইনের প্রাধান্যের নীতি গৃহীত হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুর্জোয়া বিকাশের মধ্য দিয়ে ‘জাতি’র স্বার্থ রক্ষাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপ মুখোমুখি হয় বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রহীন মানুষ ও ‘জাতি’চ্যুত সংখ্যালঘুর, এতে ‘আইন’ ও ‘জাতি’র ভারসাম্যও ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্রহীন যে মানুষগুলো বসবাস ও জীবিকার অধিকার-বঞ্চিত তারা প্রায়শই চলে যেতে পারে আইনের বাইরে।

তখন হোস্ট দেশের জন্য সে হয়ে ওঠে ‘এনোমেলি’, অস্বাভাবিকতা। আরেন্ড বলেন, রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য জাতিরাষ্ট্র আইন প্রণয়ণ করতে ব্যর্থ হয়ে পুরো বিষয়টা হস্তান্তর করে পুলিশের হাতে। অধিকারহীন এই লোকের সংখ্যা বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রও হয়ে ওঠে পুলিশি রাষ্ট্র। বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে এভাবে পুলিশ প্রথমবারের মতো জনগণকে শায়েস্তা ও শাসন করার সরাসরি কর্তৃত্ব লাভ করে। জাতিচ্যুতকরণ টোটালিটারিয়ান পলিটিক্সের শক্তিশালী হাতিয়ার, মানবাধিকার রক্ষায় ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের সাংবিধানিক অসামর্থ নিপীড়ক সরকারের জন্য সম্ভব করে তোলে নিজের মূল্যবোধকে। এমনকি বিরোধীপক্ষের উপরও চাপাতে। হান্নাহ আরেন্ডের এক অনন্য সূক্ষ্মদর্শিতা ধরা পরে এই পর্যবেক্ষণে: অধিকারহারা লোকের সংখ্যা যত বাড়বে নজর তত সরে যায় নির্যাতক গোষ্ঠী থেকে নির্যাতিত মানুষদের প্রতি। তখন নির্যাতকগোষ্ঠী দৃষ্টির আড়ালে চলে যেয়ে নির্যাতিতের মুখই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

জাতি রাষ্ট্র হলো সেই অবস্থা যা ‘জন্ম’ অথবা ‘স্থানীয়ত্ব’কে (ন্যাটিভিটি) তার সার্বভৌমত্বের ভিত্তি করেছে। ১৭৮৯ এর ফরাসি সংবিধান সভায় যে ১৭টি ঘোষণার নাম Declaration of the Rights of Man and Citizen তাতে জর্জিও আগাম্বেন লক্ষ্য করছেন দ্যর্থকতা। কারণ এ ঘোষণায় মানুষ ও নাগরিককে আলাদা করা হয়েছে। যখন মানুষের অধিকার শুধুমাত্র আর নাগরিকের অধিকার হয়ে থাকবে না তখনি মানুষকে ‘পবিত্র’ গণ্য করা যাবে। দুই ধরনের সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতার মডেলের কথা বলেন হান্না আরেন্ড। একটা ব্রিটিশ মডেল, আরেকটা ফরাসি মডেল। ফরাসি অভিজ্ঞতা সাম্রাজ্য নির্মাণের রোমান মডেলের কথা মনে করিয়ে দেয়, আর ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেয় গ্রীক উপনিবেশায়নকে। ফরাসিরা তাদের বিজয়ী অঞ্চল বা অধিকৃত অঞ্চলের নাগরিকদের ফরাসি নাগরিক হিশেবেই স্বীকৃতি দিত, বৃটিশরা তাদের উপনিবেশের অধিবাসীদের প্রজা বলে ভাবত না। বিজিত ভূখণ্ড ও স্থানীয় সমাজকে কখোনোই তারা ব্রিটেন কিংবা ব্রিটিশ জাতীয়তার অংশ মনে মনে করতো না। যাই হোক, জাতিরাষ্ট্রে আপনি যতটা মানুষ বা মানব প্রজাতির অংশ তারও বেশি আপনি জাতি রাষ্ট্রের নাগরিক, বা কোনো রাজনৈতিক জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। যেটা মানুষের অধিকার হওয়ার কথা সেটা হয়ে দাঁড়ালো জাতি রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার। মৌলিক মানব অধিকার হলো অধিকার থাকার অধিকার (Rights to have rights), অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক কমিউনিটির অধীভুক্ত থাকার অধিকার।

জাতিরাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এক জাতির সাথে আরেকজাতির যুদ্ধের বিস্তার দ্বারা। জাতিরাষ্ট্র তার ভৌগোলিকতায় জনসমষ্টিকে  নানা ক্যাটেগরিতে ভাগ করে তাদেরকে ধারণ বা ‘বিতারণের’ ফিকিরে। যেমন, রাষ্ট্র গঠনকারী মূল জনগোষ্ঠী (state people), সমঅংশীদার (equal partner), সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী (Minorities) ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী (Stateless people)। ধর্ম/ভাষা/গোত্র বা জাতিসত্তা বিবেচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠাংশই রাষ্ট্রের মূল নাগরিক জাতিরাষ্ট্রে। সংখ্যালঘুরা অর্ধেক রাষ্ট্রবিহীন (half stateless)। রাষ্ট্রবিহীন মানুষ অধিকারবিহীন। যেকোনো মানুষকে কোনো না কোনো জাতীয়তার অধীন করলেই কেবল তার মানবাধিকার সম্ভব। We refugees নামের প্রবন্ধটিতে Hannah Arend লিখছেন, সমসাময়িক ইতিহাস এক নতুন প্রজাতির মানুষ তৈরি করেছে যাদেরকে বন্ধুরা রাখে শরণার্থী শিবিরে, আর শত্রুরা রাখে কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পে। রাষ্ট্রহীনকে বিশ্ব যা দান করে তা হলো শরণার্থী শিবির। তাছাড়া একই নামের প্রবন্ধটিতে T Hammer এর বরাত দিয়ে আগাম্বেন উল্লেখ করেন, ‘নাগরিক’ এর ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যখ্যা করতে আর যথেষ্ট নয়। ফরাসি বিপ্লবের পরে ফরাসিদেশে বসবাসকারীজনগণকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় নাগরিক এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। তখনকার ফরাসিদেশের ২৯ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র ৪.৩ মিলিয়ন মানুষ ছিল সক্রিয় নাগরিক। নারী, দাস, শিশু ও বিদেশাগতদেরকে সক্রিয় নাগরিকত্ব বহির্ভূত রাখা হয়েছিল। উন্নত শিল্পায়িত দেশের ভেতরেও এমন মানুষ আছে যারা অনাগরিক কিন্তু সেখানকার স্থায়ী অধিবাসী, এমন গোষ্ঠীকে টি ট্যামার ‘ডেনিজেন’ নাম দিয়েছেন বলে আগাম্বেন জানাচ্ছেন। জাঁক রাসিয়ের খুব প্রিয় উদাহারণ হচ্ছে ফরাসি বিপ্লবোত্তর এক নারী অলিম্পি ডি গাওজেসের উক্তি: নারীকে যদি পাঠানো যায় ফাঁসিকাষ্ঠে (scaffold), তবে তাকে সংবিধান সভায়ও (Assembly) পাঠানো যাবে। মরণে যার অধিকার আছে, জীবনেও আছে তার অধিকার। অধিকারের এমত বোধ নিয়ে আবির্ভাব হওয়া রাজনৈতিক, পাব্লিক স্ফিয়ারে প্রবেশ। এইভাবে জাঁক রাসিয়ের রাজনীতিকে অভিহিত করেন Distribution of the sensible বলে। Ranciere আরেন্ডের অধিকার বিষয়ক আলোচনাকে ‘ডিপলিটিসাইজড’ বলে উল্লেখ করে অধিকারের প্রসঙ্গকে আরো সামনে নিয়ে যান।

The Postmodern Condition বইখ্যাত জা ফ্রাসোয়া লিওতার (Jean-Francois Lyotard) ১৯৯৩ সালে অক্সফোর্ড এমনেস্টি লেকচারে মানবাধিকার নিয়ে তার আলোচনায় বলেন, what makes human beings alike is the fact that every human being carries within him the figure of the other। নিজের ভেতরে বাহিত হতে থাকা সম্ভাব্য রিফিউজিকে আমরা আমাদের চিন্তা থেকে যেন নির্বাসনে না পাঠাই। শরণার্থীর যাতনা আমি আপনি ভোগ করার সম্ভাবনা সবাই রাখি। গভীরভাবে বোঝা দরকার, জাতিরাষ্ট্র কিভাবে তার আইন ও সংবিধান দিয়ে ‘অপর’ তৈরি করে, বলপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কিভাবে তাদের ‘ব্যবস্থাপনা’ সারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক