জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও প্রতিবেশীকে জানো সম্মেলন

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মে ১৯, ২০২৩

নভেম্বর মাসে ভারত ভ্রমণ সম্পন্ন করে ফিরে এলাম। দশ নভেম্বর থেকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে শুরু করবো। ভারত ভ্রমণকালে অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশীদের সম্মেলন নিয়ে। খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। কিন্তু তখনো তারিখ ঠিক করা হয়নি। জাফরুল্লাহ ভাইর কথার সূত্রে প্রাথমিক আলোচনা সেরে এসেছি। ভারত ভ্রমণ শেষে প্রথম যেদিন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম, কেন্টিনে ঢুকে দেখছি একজন অধ্যাপক একজন তরুণ শিক্ষিকার সঙ্গে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করা নিয়ে কথা বলছেন।

 

কিছুক্ষণ দুজনের আলোচনা শোনার পর বুঝতে পারলাম, জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে যে সম্মেলন করার ব্যাপারে ভারতে গিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন, এটা সেই সম্মেলনের আলোচনা। কিন্তু চরিত্র যেন কিছুটা ভিন্ন। আগে যা ছিল, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালিদের নিয়ে বাংলাদেশের বাঙালির সম্মেলন। সেই সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, বাংলাভাগ। ভারত থেকে ফিরে এসে এখন জানা যাচ্ছে সেখানে গুরুত্ব পাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর ইতিহাস এবং রাজনীতি।

 

কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিন থেকে বিভাগে চলে এলাম নিজের কক্ষে। তখনো সেই প্রথম কক্ষটাতেই বসতাম। বিভাগের একজন শিক্ষিকা খুব উৎসাহ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বললেন, স্যার আমাদের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বড় একটা সম্মেলন হবে। স্যার, আমি সেখানে প্রবন্ধ পড়বো। আপনিও চাইলে সেখানে একটা প্রবন্ধ পাঠ করতে পারেন। জানতে চাইলাম, আর কারা সেখানে প্রবন্ধ পাঠ করবে? স্যার সবাইকে বলা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলা হয়েছে।

 

জানতে চাইলাম, কদিনের সম্মেলন? কজন প্রবন্ধ পাঠ করবে?
শিক্ষিকা বললেন, স্যার, যারা প্রবন্ধ জমা দেবে সবাই পাঠ করবে।
কথা বাড়ালাম না।
শিক্ষিকা বললেন, পিএইচএ ভবনে খুব বড় করে সম্মেলন হবে। স্যার, অধ্যাপক ম মু স্যার আমাকে বলেছিলেন প্রোপোজাল লিখে দিতে। চমৎকার একটা প্রোপোজাল লিখে দিয়েছি। পড়ে দেখবেন স্যার? বড় ভাইর কাছে যাবে আমার লেখা প্রোপোজাল।

 

বললাম, জাফরুল্লাহ ভাই পড়বেন যখন, তখন আমার পাঠ করার দরকার নেই। কারণ সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন।

 

পরের শুক্রবার বা শনিবার খুব সকালে আমি পরিবাগ গিয়েছিলাম অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে দেখা করতে। যখন আমি ভারতের মুন্নার পাহাড়ে ভ্রমণ করছিলাম কাসেম ভাইর ছেলে দীপনকে হত্যা করার খবরটা পাই। সেই কারণে সকাল সকাল ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। সেখান থেকে যাব বাংলাদেশ এশিয়া সোসাইটিতে। সেখানে ভারতের নর্থ ইস্ট নিয়ে তিনদিনের সেমিনারের উদ্বোধন হবে সকাল দশটায়। কাসেম ভাইর সঙ্গে কথা বলতে বলতে জাফরুল্লাহ ভাইর ফোন পেলাম। তুমি কবে ফিরেছো?

 

বললাম, নয় তারিখ রাতে।
জাফরুল্লাহ ভাই জানতে চাইলেন, আমি এখন কোথায়। বললাম, পরিবাগে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের বাসায়।
তিনি বললেন, আমি মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশনে ভর্তি আছি। তুমি কি আসতে পারবে?
বললাম, বিকালে আসি।
তিনি বললেন, এখন কী অসুবিধা?
বললাম, আমি এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাব একটা সেমিনারে যোগ দিতে।
তিনি বললেন, আমি সকাল থেকে অধ্যাপক ম মুকে ফোন করছি। কিন্তু ফোন মনে হচ্ছে বন্ধ। তোমার সঙ্গে কি তার যোগাযোগ হবে?
বললাম, আজকে সুযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন যাব সেদিন দেখা হবে।
জাফরুল্লাহ ভাই ফোন রেখে দিলেন। সামান্য পরে আবার ফোন করলেন। বললেন, তুমি যদি পারো এখনি চলে এসো। আমি একেবারে একা আছি। পরে অনেক লোকজন চলে আসবে। তখন আর কথা বলা যাবে না। তোমার কি এখন আসলে খুব অসুবিধা হবে?
বললাম, ঠিক আছে আমি আসছি।

 

যখন কিডনি ফাউন্ডেশনে জাফরুল্লাহ ভাইর কক্ষে গিয়ে পৌঁছালাম দেখি তিনি ঘুমাচ্ছেন। হাসপাতালের ছোট্ট কক্ষের একটা চেয়ারে আমি চুপচাপ বসে রইলাম। মিনিট পনেরো বসেছিলাম কিনা জানি না, জাফরুল্লাহ ভাই ঘুম থেকে জেগে উঠে বসলেন। জানতে চাইলেন, কখন এসেছি? বললাম, অল্পক্ষণ হয়েছে।
বললেন, ভারতে গিয়ে সম্মেলনের কাজ কিছু করতে পেরেছো? মনে হয় খুব ব্যস্ত ছিলে।
বললাম, কিছু কাজ করে এসেছি। কিন্তু ভারত থেকে ফিরে এসে এখন জানলাম, সম্মেলনের বিষয়বস্তু পাল্টেছে। তাই কি?
তিনি বললেন, অধ্যাপক ম মুকে বলেছিলাম, তুমি ঘুরতে গেছ। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সম্মেলন করা নিয়ে কিছু কাজ করে আসতো পারো। সব শুনে ম মু বললেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা কেন, নর্থ ইস্ট নিয়েই করা যায়। আমার মনে হলো, সেটা আরও ভালো হবে। তখন তাকে একটা প্রোপোজাল লিখতে বললাম। প্রোপোজাল পাঠিয়েছে একটা কিন্তু কিসব লিখে পাঠিয়েছে, কিছু হয়নি।

 

জাফরুল্লাহ হাতে লেখা তিন পৃষ্ঠার প্রোপোজাল বের করে বললেন, সকাল থেকেই এ নিয়ে ম মুকে ফোন করছি, কিন্তু ওনার ফোন মনে হচ্ছে বন্ধ।

 

মনে মনে হিসাব মেলালাম, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে আজ ভারতের নর্থ ইস্ট নিয়ে তিনদিনের সেমিনারের উদ্বোধন হবে, আবার আমরাও ঠিক তাই করতে যাচ্ছি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনমাস পরে। কেন? হঠাৎ বাঙালীর সম্মেলন করার পরিকল্পনা পাল্টে গিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে মিল রেখে নর্থ ইস্ট প্রাধান্য পেল কী করে!

 

জাফরুল্লাহ ভাই আমার হাতে কাগজগুলো দিয়ে বললেন, নাও প্রোপোজালটা এবার তুমি ঠিকঠাক করে লিখে দাও।
দেখলাম, পুরো প্রোপোজালে জাফরুল্লাহ ভাই অনেক কাটাকাটি করেছেন, সেসব জায়গায় অনেক মন্তব্য লিখেছেন।
আমি বললাম, ম মু সাহেবের প্রোপোজালে আমার হাত দেয়া ঠিক হবে না। বরং উনিই প্রোপোজালটা আপনার মন্তব্য পড়ে ঠিক করে দিক।

 

প্রোপোজালের হাতের লেখা দেখে বুঝে নিলাম এটা কার লেখা। কারণ এ সম্পর্কে আমাকে একজন শিক্ষিকা আগেই বলেছিলেন।
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, সম্মেলন সম্পর্কে তোমার পরিকল্পনা কী বলো।
বললাম, আমি লিখিতভাবে আপনাকে দেব।
জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে তবুও কিছু কিছু আলোচনা হলো। কথা হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যৌথভাবে সম্মেলনটা করা যায় কিনা।

 

জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে কথা বলে এশিয়াটিক সোসাইটিতে এলাম। তখন চা বিরতি চলছে। এসে দেখি অধ্যাপক ম মু সেখানে বসে আছেন। আমি বললাম, জাফরুল্লাহ ভাই আপনাকে ফোন করে পাচ্ছেন না। সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছেন।

 

তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবেই বললেন, পাবেন কী করে? আমি ফোন বন্ধ রেখে সেমিনারে ঢুকেছি।
প্রোপোজালের কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, জাফরুল্লাহ ভাই এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
তিনি প্রোপোজালটা নিলেন। কাটাকাটি মন্তব্যগুলি দেখলেন। দেখে বললেন, দেখেছেন একজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সে কী একটা লেখা দিয়েছে! কাউকে দায়িত্ব দিলে কী বিপদ দেখেছেন?
বললাম, জাফরুল্লাহ ভাইকে দেয়ার আগে আপনি কি নিজে পড়ে দেখেননি।
তিনি জানতে চাইলেন, জাফরুল্লাহ ভাই কী বলেছেন এটা পড়ে?
বললাম, প্রথম আপনাকে ফোন করেছিলেন। সম্ভবত তিনি লেখাটার বহুকিছুর সঙ্গে একমত নন। আমাকে সংশোধন করতে বলেছিলেন। কিন্তু অন্যের লেখায় আমি হাত দিতে রাজি হইনি।

 

এরই মধ্যে জাফরুল্লাহ ভাইকে নভেম্বর মাসের সতের তারিখে একটা মেইল পাঠিয়ে সম্মেলনের নামটা পাল্টাতে চাইলাম। সেই সঙ্গে জানালাম সম্মেলনটা একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাঝখানে রেখে করতে চাই। সংক্ষিপ্তভাবে একটা অনুষ্ঠানসূচি পাঠালাম। সেই সময়ের মধ্যেই আমার কক্ষ পরিবর্তন করার ঘটনাটা ঘটে।

 

এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সভা করলাম যাতে যৌথভাবে সম্মেলনটা আমরা করতে পারি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মতি পাওয়া গেল। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলাম। তিনদিন যাতায়াত করতাম। অধ্যাপক ম মু আমাকে বললেন সম্মেলনের কারণে আমাকে ছয়দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে। আমি তার এরকম কথার যুক্তি খুঁজে পাইনি। ফলে বিশে নভেম্বর তাকে মেইলে চিঠি লিখে জানালাম, আমার পক্ষে সম্মেলনে যুক্ত থাকা সম্ভব নয়। যতটা সম্ভব দূর থেকে সহযোগিতা করবো। সেই সঙ্গে আবার নতুন করে সম্মেলনের প্রস্তাবনা পাঠালাম সকলের মতামত নিয়ে তা গ্রহণ বর্জনের জন্য।

 

জাফরুল্লাহ ভাই আমার সতেরো তারিখের প্রস্তাবনা পাঠ করে বলেছিলেন, তিনদিনে সম্মেলন শেষ করা যাবে না। টাকার কথা চিন্তা করছো তো। টাকার কথা চিন্তা করো না। সম্মেলনের সময় আরও দু-একদিন বাড়াও।

 

অধ্যাপক ম মুকে যে চিঠি দিয়েছিলাম, তার অনুলিপি পাঠালাম জাফরুল্লাহ ভাইকে। জাফরুল্লাহ ভাই আমার সেই চিঠি পাঠ করে সঙ্গে সঙ্গে জনাব মূর্তজা আলী বাবুকে পাঠালেন যাতে আমি সম্মেলন থেকে সরে না দাঁড়াই সেটা বলার জন্য। পরে জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে দেখা করে বলতে চাইলাম, এর সঙ্গে আমি যুক্ত থাকতে চাই না।

 

তিনি বললেন, তুমি কাজটা আরম্ভ করে সরে যেতে চাচ্ছো কেন? বহুজনকে নিয়ে কাজটা করতে হবে। সবার সঙ্গে তোমার মিলবে না। কিন্তু কাজটা তোমাকেই সম্পন্ন করতে হবে। কাজটা কার দ্বারা সম্পন্ন হবে তা আমি ভালোই জানি, তবুও অনেককে যুক্ত রাখতে হয়।

 

কয়েকদিন পর, সেদিন সোমবার। জাফরুল্লাহ ভাই সকালে আমাকে ফোন করলেন। আমি কম্পিউটারে বসে কিছু একটা লিখছিলাম। জাফরুল্লাহ ভাই ফোন করে প্রথম জানতে চাইলেন, তুমি কোথায়?
বললাম, বাসায়।
তিনি বললেন, তুমি কি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়াচ্ছো না?
বললাম, পড়াচ্ছি তো।
জাফরুল্লাহ ভাই জানতে চাইলেন, তুমি তাহলে আজ বাসায় কেন? তুমি নাকি কদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছো না।
বললাম, আমার আজ যাওয়ার কথা নয়। আমি মঙ্গল, বুধ আর বৃহস্পতিবার যাই।
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, তাহলে সম্মেলনের কাজ আগাবে কী করে?
বললাম, তিনদিন বিশ্ববিদ্যালয় গেলেই সম্মেলনের কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে। এখন পর্যন্ত সম্মেলনের কোনো কাগজপত্রই তৈরি হয়নি। প্রথম কাজ কাগজপত্র তৈরি করে সবাইকে আমন্ত্রণ পাঠানো, প্রচার করা। সেগুলো ঘরে বসেই ইন্টারনেটে করা যায়।
জাফরুল্লাহ ফোন রেখে দিলেন।

 

সম্ভবত তার আধঘন্টা পরেই জাফরুল্লাহ ভাই আবার ফোন করলেন। রাহমান, তোমাকে কি বিরক্ত করছি?
না জাফরুল্লাহ ভাই।
রাহমান, সম্মেলনের ব্যাপারে যদি আমরা শনি রবি সোমবার বিকালের দিকে নগর হাসপাতালে বসি, সময় দিতে পারবে?
বললাম, সবসময় পারবো না। মাঝে মধ্যে পারবো।
তিনি বললেন, যদি আজ বিকাল ছয়টায় বসি, তুমি আসতে পারবে? কয়েকজন বসে যদি আজ সম্মেলনের কাগজপত্র তৈরি, সময় দিতে পারবে?
বললাম, আজকে হলে পারবো।
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, তাহলে বিকালে চলে আসো।
যখন জাফরুল্লাহ ভাই আমার সঙ্গে এসব আলোচনা করেন, তখন পর্দার আড়ালে আর একটা ঘটনা ঘটছিল। সেটা হলো অধ্যাপক ম মুকে জাফরুল্লাহ ভাই কদিন আগে বলেছিলেন, সম্মেলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা, আমন্ত্রণের প্রস্তাবনা এবং অন্যান্য কাগজপত্রগুলি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে। কিন্তু সোমবার সকালে জাফরুল্লাহ ভাইর বাসায় গিয়ে ম মু উপস্থিত হন।

 

জাফরুল্লাহ ভাইকে বললেন, রাহমান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না ঠিকমতো, ক্লাস নেয় না। সে কী করে এই সম্মেলনে যুক্ত থাকবে।
কিন্তু তিনদিন যে আমার যাবার কথা নয়, সেটা তিনি জাফরুল্লাহ ভাইকে বলেননি। জাফরুল্লাহ ভাই সেকারণেই প্রথমে ফোনটা করেন আমাকে। জাফরুল্লাহ ভাই যখন তাকে পরে বললেন, রাহমানের তো তিনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা, তখনো তিনি তাকে বোঝালেন যে, সম্মেলনের কাজে রাহমান চৌধুরীকে পাওয়া যাবে না। ফলে দ্বিতীয়বার জাফরুল্লাহ ভাই ফোন করেন আমাকে।

 

যখন আমি বললাম, বিকালে আমি আসবো। তখন জাফরুল্লাহ ভাই ম মুকে বলেন, আপনি বললেন রাহমানকে সম্মেলনের কাজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রাহমানকে বলার সঙ্গে সঙ্গে বিকালে আসতে রাজি হলো। পর্দার আড়ালের ঘটনাটা কদিন পরে জানতে পেরেছিলাম জাফরুল্লাহ ভাইর মুখেই।

 

বিকালে আমি নগর হাসপাতাল গিয়ে উপস্থিত হলাম। সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম সম্মেলন সম্পর্কে আমার লেখা কাগজগুলো। সেই প্রস্তাবনাটি ছিল বাংলায় লেখা। যার অনুলিপি দু তিনদিন আগে অধ্যাপক ম মু এবং জাফরুল্লাহ ভাইকে পাঠিয়েছি। নগর হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম জাফরুল্লাহ ভাই আসেননি। উপস্থিত আছেন গণমুদ্রণের সফিক ভাই। তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আর আছেন অধ্যাপক ম মু। আরো আছেন ডা. আরমান।

 

ম মু একটা প্রস্তাব লিখে এনেছেন হাতে, সেটা ইংরেজিতে লেখা। আরমানের দায়িত্ব হলো সেটা কম্পোজ করা। শফিক ভাই আগামীকাল সেটা গণ মুদ্রণালয় থেকে দ্রুত ছাপিয়ে দেবেন। ম মু তার পরদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন একটা সেমিনারে। তিনি সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্রটি এবং কাগজপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন সেমিনারে উপস্থিত সব প্রতিনিধিদের হাতে হাতে দিয়ে দেয়ার জন্য।

 

পরিকল্পনাটা খুব ভালো। লক্ষ্য করলাম, আমি যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলাম তার কিছুই নেই। সম্পূর্ণ নতুন একটা লেখা। আমি ম মুর লেখাটার কিছু অসঙ্গতি শুধরে দিতে চাইলে তিনি শুনলেন না। সফিক ভাই আমার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তিনি বললেন, আপনি ওনার লেখায় হাত দিচ্ছেন কেন। বুঝলাম আমি ঠিক করছি না, তখন আমি চুপ করে গেলাম। সবাই কাজ করছেন, আমি চুপচাপ বসে আছি। আমার আজকে আসার দরকার কী ছিল বুঝতে পারছিলাম না।

 

জাফরুল্লাহ ভাই আসলেন বেশ দেরি করে। আমি সোফায় বসে পা এলিয়ে দিয়েছিলাম। জাফরুল্লাহ ভাই আসার সঙ্গে সঙ্গে সফিক ভাই বললেন, আপনি ওদিকটায় গিয়ে বসুন। আমি ওনার কথা শুনলাম না। নিজের জায়গায় বসে রইলাম। সফিক ভাই তখন বললেন, আপনি পা ঠিক করে বসেন। আমি তাও করলাম না। সফিক ভাই ছিলেন সত্যিকারভাবে একজন ভালো মানুষ। পরে সেটা টের পেয়েছিলাম।

 

ঠিক তেমনি তিনিও সেদিন টের পেয়েছিলেন, মানুষকে সম্মান দেখাবার নামে সামন্ততন্ত্রের দাসত্ব আমি পছন্দ করি না। অকারণে হুজুর হুজুর করা আমার স্বভাব নয়। সফিক ভাইর সঙ্গে পরদিন থেকে আমার খুব আন্তরিক একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। জাফরুল্লাহ ভাই প্রবেশ করে প্রথম ম মুর লেখাটা পড়লেন। কিন্তু একেবারেই পছন্দ হলো না। ফলে জাফরুল্লাহ ভাই নিজে সেটা সংশোধন করে দিতে আরম্ভ করলেন। রাত বাড়ছিল। কিছুক্ষণ পর জাফরুল্লাহ ভাইকে বিনয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দিকে লেখা বাংলা সেই প্রস্তাবনাটা দেখালাম।

 

জাফরুল্লাহ ভাই পড়ে বললেন, রাহমানের লেখাটার মধ্যে সবকিছু আছে। শুধু শুধু আমরা পণ্ডশ্রম করলাম। এটা অনুবাদ করে দিলেই হয়ে যায়। তখন রাত নয়টা বেজে গেছে। বললাম, জাফরুল্লাহ ভাই এবার আমি যাই? ছয়টা থেকে এসে বসে আছি, বাসায় অনেক কাজ আছে। জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও। কালকে পারলে গণ মুদ্রণালয় গিয়ে লেখাটা দেখে দিও। পরদিন লেখাটা মুদ্রিত হলে অধ্যাপক ম মু মুদ্রিত লেখা নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন। একই লেখা আরো সম্পাদনা করে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেইলে পাঠিয়ে দিলাম।

 

কলকাতার সেমিনার সেরে অধ্যাপক ম মু ফিরে এলেন। তিনি এসে জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা খুব উৎসাহী গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমেলনে যোগ দিতে। দুই বাস বোঝাই করে তারা চলে আসবে। এ খবর শুনে অনেকে খুব খুশি। আমি বললাম, দু বাস আসুক আর তিন বাস আসুক সকলের আসতে গেলে ভিসা দরকার হবে। সবাইকে বলেন, আগে আমাদের ইমেইলে তাদের বৃত্তান্ত দিয়ে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করতে। ম মু বললেন, `দু তিনদিনের মধ্যেই তাঁরা সব কিছু পাঠাবেন। আমি আমার ইমেইল দিয়ে এসেছি। আপনাদের ইমেইল আছে আমাদের আমন্ত্রণপত্রে।`

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব পালন করবেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আতিকুর রহমান। ম মু, আতিক আর আমার ইমেইলের ঠিকানা দিয়ে পঁচিশে নভেম্বর কয়েকশো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ পাঠানো হলো পনেরো ডিসেম্বরের মধ্যে যোগাযোগ করতে। সম্মেলনের মূল শিরোনাম হলো, প্রতিবেশীকে জানো, নো দ্য নেইবারস।

 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিঠি পাঠাবার পর সেই বিশ দিন সময় পার হয়ে গেল। তিনটি ইমেইলের ঠিকানায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজনও যোগাযোগ করলন না। অধ্যাপক ম মুর কলকাতা থেকে বাস বোঝাই করে আসা লোকদেরও পাত্তা পাওয়া গেল না। কী দুর্ভাগ্যজনক, মাস খানেক সময়ের প্রচার বা আমন্ত্রণের কোনো জবাব এলো না। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে যদিও চিঠি লেখা বিশ দিন আগে মাত্র।

 

জাফরুল্লাহ ভাই ফোন করলেন আমাকে পরদিন ষোলই ডিসেম্বর খুব ভোরবেলায়। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ঘুম ভাঙ্গালাম? বললাম, না। যদিও জাফরুল্লাহ ভাইর ফোনেই ঘুমটা ভেঙেছিল । আমি খুব ভালো জানি, জাফরুল্লাহ ভাই কেন এতো ভোরে ফোন করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানি, তার মনটা ভেঙ্গে যাবার মতো তথ্য দিতে হবে আমাকে। জাফরুল্লাহ ভাই নিজেও জানেন, কী খবর পাবেন। তবুও আশার ছলনায় ভুলি। জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোনো খবর? বললাম, না। একজনও না? বললাম, প্রথম দিকে একজন করেছিলেন। এখন তার সঙ্গেও আর যোগাযোগ করতে পারছি না।
তিনি জানতে চাইলেন,কেন হলো এরকম।
বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। বললেন, তাহলে সম্মেলন হচ্ছে না? দশজন প্রতিনিধি পেলেও সম্মেলনটা করে ফেলতাম।
বললাম, তাইতো মনে হচ্ছে। সম্মেলন আর হচ্ছে না, তবে...
তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে জানতে টাইলেন, তবে কি?
বললাম, আপনি মাসুদ পড়েছেন কি না জানি না। মাসুদ রানাকে তার বস রাহাত খান বলেছিলেন, রানা কখনো হাল ছেড়ো না। উপায় একটা আছেই।
জাফরুল্লাহ ভাই জানতে চাইলেন, তুমি কি ভাবছো?
বললাম, ইমেইলে কোনো জবাব না পেয়ে তিন চারদিন আগে ভারতের বিশেষ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি ডাকযোগে। সেখানে যোগাযোগের শেষ তারিখ বলেছি একত্রিশে ডিসেম্বর ২০১৫।
জাফরুল্লাহ ভাই জানতে চাইলেন, তাতে কাজ হতে পারে?
বললাম, জানি না। কিন্তু চেষ্টা করলাম। আপনি যেমন চান, আমিও চাই সম্মেলনটা হোক। চলবে