জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও প্রতিবেশীকে জানো সম্মেলন

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মে ২০, ২০২৩

গণবিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, তাদের অনেকে তখন আমাকে নিয়ে এক সঙ্কটে পড়েছিলেন। আমি একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক। চুপচাপ পড়াচ্ছিলাম, কারো তখন সমস্যা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন আমাকে একদিন যৌক্তিক কারণেই অধ্যাপক মাহমুদ শাহর কক্ষে বসিয়ে দিলেন, কম্পিউটার ও রঙিন প্রিন্টার দিলেন, অনেকে সজাগ হয়ে উঠলেন। প্রথম অনেকের মধ্যে সমীহ তৈরি হলো। যখন আমার মতো খণ্ডকালীন একজন শিক্ষককে প্রতিবেশীকে জানো সম্মেলনের ভার দিলেন তখন আবার অনেকে ভয় পেলেন, এরপর কী ঘটবে? পরে আমি বুঝেছিলাম, জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে প্রথম দায়িত্ব দেওয়ার পর আবার একই সঙ্গে অধ্যাপক ম মুকে বিশেষ দায়িত্ব দেন সেটা এজন্য যে, যাতে কেউ মনে না করে যে, আমিই সবকিছু।

 

অধ্যাপক ম মুকে তিনি সামনে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনা আপন নিয়মে গতি পাল্টে ফেললো। ভারতে আমাকে পাঠানোটা অনেকের কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল। মনে করলেন, একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক মাত্র চার-পাঁচ মাস আগে যুক্ত হয়ে এতকিছু করার দায়িত্ব পাবেন কেন? কিন্তু এসব রাজনীতি আমার মাথায় ছিল না। চিঠি দিয়ে আমি সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জাফরুল্লাহ ভাই দেননি। যদি সত্যিই আমি সরে দাঁড়াতাম এ সম্মেলন হতো না, সেটা পরে বুঝেছিলাম।

 

পরদিন জাফরুল্লাহ ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেন। সম্মেলন সংক্রান্ত জরুরি সভা ডাকলেন। কিন্তু বিশেষ কারণ দেখিয়ে উপাচার্য উপস্থিত থাকলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সভায় উপস্থিত। সকল বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপকরা উপস্থিত। জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে বললেন, রাহমান, তুমি ভারত ঘুরে এসেছো তার ফলাফল কী বলো। সব বললাম। তিনি বারবার নানা প্রশ্ন করলেন। সবটাই ইচ্ছাকৃত। সকলকে বুঝিয়ে দেয়া যে, কত রকম প্রতিনিধি পাওয়া গেছে এ সম্মেলনে। সবকিছু আমি বলার পর তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন এমন ভাব করে রেজিস্ট্রারকে বললেন, সম্মেলন করতে আর সমস্যা দেখি না। সময় হাতে কম সেটা ঠিক, কিন্তু ডা. মঞ্জুর কাদের বলেছে তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। সবাই প্রস্তুতি নেন। নির্দিষ্ট দিনে সম্মেলন করার জন্য যা যা করা দরকার সব করতে হবে।

 

কারো মুখে আর রা নেই। রেজিস্ট্রার বা কেউ বললেন না যে, সম্মেলন একবছর পিছিয়ে দেয়া হোক। শুধু সভা শেষে জানা গেল, রেজিস্ট্রার রক্তচাপের কারণে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সভা শেষে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক ডা. মঞ্জুর কাদেরের সঙ্গে আমার সেদিনই পরিচয় হলো। তিনি বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রতিনিধিদের সময় মতো আসতে বলুন। মঞ্জুর কাদেরর কথা শুনে আমি রীতিমত মুগ্ধ হলাম এবং সম্মেলন করার সাহস ফিরে পেলাম। মঞ্জুর কাদের যা বলেছিলেন তা মুখের আস্ফলন নয়। সত্যিই তিনি খুব কম সময়ে অসম্ভব সুন্দর একটি সম্মেলন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। কারণ প্রতিনিধিদের থাকা খাওয়া এবং যাতায়াতের সব দায়িত্ব ছিল তার হাতে।

 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চারজন মানুষের কথা আমি ভুলতে পারবো না। যাদের আন্তরিকতা ও পরিশ্রম ছাড়া এ সম্মেলন সফল হতে পারতো না। শফিক খান ভাই, ডা. মঞ্জুর কাদের, প্রকৌশলী অনিল এবং ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার। শফিক ভাইর গণ মুদ্রণালয়ের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ। ভিন্ন দিকে মঞ্জুর কাদের তার কর্মীদের নিয়ে যা করেছেন, তা শুধু আমি একা নই প্রত্যেক প্রতিনিধি স্মরণে রাখবেন। যাদের কথা বললাম তারা সবাই আমাকে দিয়েছিলেন একই সঙ্গে মানসিক সাহস ও স্বস্তি। কখনো আমাকে ভেঙে পড়তে দেননি। তাদের বাইরে আর একজনের কথা বলতেই হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আতিকুর রহমান। তিনি সেদিন খুব গঠনমূলক না হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এ সম্মেলন করা যেত না।

 

সম্মেলন করবো ঠিক হলো। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বসতে হবে। অধ্যাপক আতিককে ফোন করলাম। তিনি বললেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না এ উদ্যোগের সঙ্গে। জানতে চাইলাম কেন? বললেন, আপনারা আমাদের বাদ দিয়েই সব করছেন। অধ্যাপক ম মু নির্দোষভাবে তাদেরকে এমন তথ্য দিয়েছেন তাতে ভুল বুঝে বসে আছেন তাঁরা। অধ্যাপক আতিক আমার অনেক দিনের পরিচিত ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। সবসময় ইতিহাস সমিতির সম্মেলনে একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি।

 

তাকে বললাম, আমি ভারতে গিয়েছিলাম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে, না হলে সম্মেলন করাই যেত না। সম্মেলনের সকল কাগজপত্রে আপনাদের নামটাই আগে বসানো আছে। প্রতিনিধি আসবেন একান্ন জন, এখন কাল আমি এসে আপনাদের সঙ্গে বসে সবকিছু চূড়ান্ত করবো।
আতিক বললেন, আমাদের রেজিস্ট্রার সাহেব আপনাদের ওপর খুব বিরক্ত। তিনি থাকতে চান না। আপনি জানেন উপাচার্য আপা তাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। অধ্যাপক ম মু তাকে বলেছেন, সব সিদ্ধান্ত আপনি একা নিচ্ছেন।

 

বললাম, আপনি শুধু আমার পক্ষে থাকেন। রেজিস্ট্রার সাহেবকে রাজি করানোর দায়িত্ব প্রথমত আমার এবং পরে আপনার।
আতিক বললেন, ঠিক আছে আসেন কালকে।
ইউসুফ হাসান অর্ককে ফোন করলাম। বললাম, আপনার সহযোগিতা দরকার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। একসঙ্গে একটা সম্মেলন করতে চেয়েছিলাম। মনে হয় আমাদের কিছু ভুল হয়েছে।
অর্ক বললেন, শুধু বলেন আমাকে কী করতে হবে।
বললাম, কালকে একটা সভা আছে আপনাদের রেজিস্ট্রার সাহেবের অফিসে, আপনি থাকবেন।
অর্ক বললেন, অবশ্যই থাকবো।

 

পরদিন গেলাম কথা বলার জন্য। আতিক আর অর্ক উপস্থিত। অধ্যাপক ম মু উপস্থিত আছেন। কিন্তু মনে হলো রেজিস্ট্রার মহোদয় কিছুটা ক্ষুব্ধ। কারণ আমাদের দিক থেকে তথ্য দিতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে। রেজিস্ট্রার আবুবকর ভাইকে বললাম, আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি।
তিনি তখন বললেন, আপনাকে দেখেছি যেন কোথায়।
বললাম, আপনার মিসেস আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী।
তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। কদিন আগে আপনাদের বন্ধুদের আড্ডায় ধানমন্ডির জিং জিয়াং রেস্টুরেন্ট এ রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম।
আবু বকর ভাইর সব রাগ এককথায় জল। বললেন, আজ দুপুরে আপনাকে আমার বাসায় খেতে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু আপনার বন্ধু অনেক দিন ধরে অসুস্থ। পরে জেনেছিলাম কথাটা খুব সত্যিই, মাঝে মধ্যেই বিষণ্ণতায় ভুগতো কাকলী।

 

যাই হোক, সম্মেলন সম্পর্কে বললাম বিশ তারিখ দুপুর থেকে প্রতিনিধিরা আসবেন। একুশ তারিখ তাদের নিয়ে যাওয়া হবে প্রভাত ফেরিতে। বাইশ তেইশ চব্বিশ তিনদিন হবে মূল অনুষ্ঠান, যেমন সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বলেন এবার আপনাদের দাবি। যা বলবেন তাই। বললাম, মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী হবে বাইশ ফেব্রুয়ারি, সমাপনী চব্বিশ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধন বা সমাপনী যে কোনো একদিন আপনাদের উপাচার্য থাকবেন প্রধান অতিথি আর একদিন আমাদের উপাচার্য। আপনারা কোনদিন চান। ঠিক হলো উদ্বোধন করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর সমাপনী ঘোষণা করবেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনদিনের সেমিনারের দ্বিতীয় দিনের পুরো দায়িত্ব নেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠান হবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। দুপক্ষ মিলে যেহেতু করছি অনুষ্ঠানটা, ফলে সবগুলো বিষয় আলোচনায় আসা দরকার। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ইচ্ছা জানিয়ে দিলাম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূল আলোচক থাকবেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর সমাপনী অনুষ্ঠানে বদরুদ্দীন উমর। কেউ তাতে আপত্তি করলেন না।

 

কাজ শুরু করার পর দেখা গেল জাফরুল্লাহ ভাই নিজেই আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি নতুন নতুন সব সিদ্ধান্ত দিতে লাগলেন। নতুন সব ব্যক্তিদের নাম বলতে লাগলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচক হিসেবে। কখনো সেমিনারের সভাপতি হিসেবে। শফিক খান ভাই বিনা প্রশ্নে জাফরুল্লাহ ভাইর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আবার আমন্ত্রণপত্র ছাপছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো তাদের না মেনে নিতে পারেন। জাফরুল্লাহ ভাইকে গিয়ে একদিন বললাম, অনুষ্ঠানটা আমরা একা করছি না। ফলে তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না। জাফরুল্লাহ ভাইকে যখন এসব বুঝাতে যাচ্ছি, তখন অন্যরা বলছেন অনুষ্ঠান আমাদের। পুরো অনুষ্ঠানটা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিন্তা থেকে হচ্ছে, তিনি যা বলবেন তাই হতে হবে। মনে আছে, অধ্যাপক আতিক এসব ক্ষেত্রে জাফরুল্লাহ ভাইর অনেক ইচ্ছা মেনে নেয়ার ফলে সমস্যা ততটা হতে পারেনি। জাফরুল্লাহ ভাইর স্বৈরাচারী এক মনোভাব এ সময়ে আমার কাছে খুবই ধরা পড়ে। কিন্তু আমি তর্ক করি, অন্যরা চুপ করে থাকে। বুঝতে পারি অন্যদের এই চুপ করে থাকাটাই জাফরুল্লাহ ভাইর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি যদি সবসময় সবার দিক থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন, তাহলে নিজেই বুঝতে পারতেন তার ইচ্ছাটাই সব নয়।

 

জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে এই সময়ে তর্ক করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক সময় তিনি তর্কে যা মেনে নেন না, পরে তাই মেনে নেন। জাফরুল্লাহ ভাইর চরিত্রের দুটা উদাহরণ দিতে পারি। আদালত অবমাননার প্রথম মামলায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কদিন পর দেখি আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলায় তিনি ক্ষমা চেয়ে বসে আছেন। দ্বিতীয় মামলাটি করেছিলেন কামাল পাশা। জাফরুল্লাহ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, দ্বিতীয় মামলায় ক্ষমা চাইলেন কেন? তিনি হাসলেন। বললেন, ক্ষমা না চেয়ে উপায় আছে? দোষ তো আমারই। বিচারকদের আমি মস্তিষ্ক বিকৃত বলেছি। একজন চিকিৎসক হয়ে কাউকে পরীক্ষা না করে একথা বলতে পারি? বলো, তোমার যুক্তি কী বলে? চুপ করে রইলাম। কথা ঠিক, তিনি বিচারকদের রাগের মাথায় মস্তিষ্কবিকৃত বলতে পারেন না। ভিন্ন আর একটা ঘটনা। জাফরুল্লাহ ভাইর কাছে একজন খুব মেধাবী লোকের পক্ষে বলা হলো, তার প্রতিষ্ঠানের বড় একটি পদে তাকে বসাতে। জাফরুল্লাহ নিজেও তাকে খুব মর্যাদা দেন এবং স্নেহ করেন। কিন্তু সেই মেধাবী মানুষটি সকলের সম্মানের হলেও, ছিলেন খুব রগচটা। জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, সে খুব মেধাবী তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এক ভুল আমি দুবার করবো না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মাথাগরম কাউকে আমি ঐ পদে বসাবো না। তিনি নিজের ত্রুটিগুলোর অনেকটাই জানতেন। কিন্তু কিছুতেই রাগ সামলাতে পারতেন না। একবার নাকি বলেছিলেন, যদি আমার স্বভাবটা এমন রগচটা না হতো, আরো বেশি সাফল্য আসতো আমার জীবনে। রগচটা হাওয়ার কারণে অনেক কিছু হারিয়েছি। তিনি একবার পত্রিকার সাক্ষাৎকারে নিজের রগচটা স্বভাব সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন।

 

জাফরুল্লাহ ভাই যে কোনো কারণেই হোক আমার সঙ্গে রগচটা আচরণ কখনো করেননি। যখন তর্ক করেছি তখনো না। কিন্তু একবার তিনি আমার উপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। সম্মেলন নিয়েই সেটা ঘটেছিল। সম্মেলনের সব প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো। কারণ তাদের সঙ্গে আমারই পরিচয় ছিল। কী কারণে দু একজন মনে করলেন, সেটা হবে কেন। শফিক খান ভাই আর আমি তখন সকাল থেকে গণ মুদ্রণালয়ে বসে থাকি রাত পর্যন্ত। সম্মেলনের কাগজপত্র তৈরি আর মুদ্রণের কাজ চলছে। বলতে গেলে ঢাকা থেকে আমি, শফিক ভাই সকাল ছটায় বের হই, ডা. মুহিব উল্লাহ তার নিজের গাড়িটা আমাদের দেয়, কখনো নিজেই আমাদের সঙ্গে চলে আসে সম্মেলনের কাজ দেখতে। দুই ডা. মঞ্জুই আমাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ফেব্রুয়ারির পনেরো তারিখে দুপুরের আগে জাফরুল্লাহ ভাইর ফোন, রাহমান, তুমি কোথায়? অধ্যাপক ম মু তোমায় খুঁজে পাচ্ছে না কেন?
বললাম, কাজে ব্যস্ত থাকি। তিনি আমাকে খুঁজছেন কেন?
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, প্রতিনিধিদের সব কাগজপত্র তোমার কাছে কেন? প্রতিনিধিদের সঙ্গে তুমি নাকি কাউকে যোগাযোগ করতে দিচ্ছো না। সব প্রতিনিধিদের নাকি তোমার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে?
বললাম, জাফরুল্লাহ ভাই, সেটাই স্বাভাবিক। প্রতিনিধিরা প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে এবং তাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, না সেটা স্বাভাবিক নয়। সবকিছু তুমি একা করবে না। কাগজপত্রগুলো এখনি ম মুকে দিয়ে দাও। নিজের মতো তুমি চলতে পারো না।
বললাম, এখন কাজে ব্যস্ত। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবো।
তিনি বললেন, ম মুকে সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে জানাবে।

 

জাফরুল্লাহ ভাইর শেষ নির্দেশ বা কণ্ঠস্বর আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। কারণ আমি তার দাসত্ব করছি না এখানে। জাফরুল্লাহ ভাই ফোন রাখতে না রাখতেই ম মুর ফোন, রাহমান, প্রতিনিধিদের সব কাগজপত্রগুলো আমাকে দিয়ে যান।
বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলাম।

 

প্রতিনিধিদের সব কাগজপত্র, নাম ইমেইল ফোন নম্বর দুটো অনুলিপি করে একটা দিয়েছি পিএইচএ ভবনে রুম বরাদ্দের জন্য আর একটা মু মকে দিয়েছি আরো আগে। তিনি সেসব কী করেছেন তিনিই জানেন। তিনি বারবার একই কাগজ আমার কাছে চান। তিনি ইমেইল ব্যবহার করতে জানেন না। সব উল্টোপাল্টা কাজ করে সামান্য পর পর বলেন কাগজপত্র পাচ্ছেন না। প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে কথা বলে সঠিক তথ্য পান না। পরে আবার আমাকে ফোন করেন। কিন্তু জাফরুল্লাহ ভাই আসল খবর না নিয়ে অকম্মাদের কান কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন। ম মুর ফোন রেখে দিয়ে জাফরুল্লাহ ভাইকে মেইলে চিঠি লিখতে বসলাম। মনে হলো, জাফরুল্লাহ ভাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার আমি কে এবং এখানে আমার আসলে দায়িত্ব কী। চিঠিটা লিখতে গিয়ে এটাও মাথায় রাখলাম তিনি বহুকাল ধরে আমাদের বড় ভাইয়ের মতো এবং যখন উপাচার্য আর রেজিস্ট্রার সম্মেলন বাতিল করে দেবে বলেছিলেন, তখন জাফরুল্লাহ ভাইই পরম মমতায় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাইকে তো কড়া ভাষায় চিঠি লেখাই যায়। যদি আজ না লিখি কাল তিনি আরো চরম ভুল করবেন। তিনি হয়তো তখন তাঁর রগচটা স্বভাবটা আমার উপর প্রয়োগ করে বসবেন। কড়া চিঠিটা লিখে গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণ মুদ্রণালয়ে চলে গেলাম সম্মেলন কাজ শেষ করতে।

 

গণ মুদ্রণালয়ে শফিক ভাই আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে ছিলেন। সেদিন অনেক দেরি করে খেয়ে নিয়ে কাজ করছি। জাফরুল্লাহ ভাইর হাতে ততক্ষণে আমার মেইল চলে গেছে। তিনি চিঠিটা পাঠ করে মনে করলেন, আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছি এবং সম্মেলনের সঙ্গে আর যুক্ত থাকছি না। তিনি শফিক ভাইকে ফোন করলেন। বললেন, শফিক রাহমান মনে হয় সম্মেলনে আর থাকবে না। কাজটা তোমরা ঠিক মতো শেষ করতে পারবে তো? শফিক ভাই জাফরুল্লাহ ভাইর আমাকে ফোন করা আর আমার লেখা চিঠির কথা জানতেন না। তিনি জাফরুল্লাহ ভাইর কথা শুনে অবাক হলেন। বললেন, রাহমান ভাই তো আমার সামনেই বসে আছেন। জাফরুল্লাহ ভাইর পরের প্রশ্নের জবাবে বললেন, তিনি প্রুফ দেখছেন। শফিক ভাই ফোনটা এবার সরাসরি আমাকে ধরিয়ে দিলেন। আমি হ্যালো বলতেই জাফরুল্লাহ ভাই রাগত স্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, তুমি এখানে কী করছো। বললাম, যা করার তাই করছি। তিনি ফোনটা রেখে দিলেন।

 

জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে ফোনালাপ বা কথা বলা তখন বন্ধ আমার।
চারদিন পর সম্মেলন। গণ মুদ্রণালয়ের সব মুদ্রিত কাগজ জাফরুল্লাহ ভাইর কাছে চলে যায় তাঁর অনমোদনের জন্য। জাফরুল্লাহ ভাইর কাছে সব কমিটির নাম গিয়েছে। কিন্তু সবার নাম থাকলেও কোথাও আমার নাম খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি শফিক ভাইর কাছে জানতে চাইলেন, রাহমানের নাম নাই কেন কোথাও। শফিক ভাই বললেন, রাহমান ভাই বলেছেন তিনি কোনো কমিটিতে থাকবেন না। জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, রাহমানই এটার প্রধান তাহলে তাঁর নাম থাকবে না মানে? শফিক ভাই বললেন, রাহমান ভাই বলেছেন তাঁর নাম কোথাও না রাখতে। জাফরুল্লাহ ভাই জানতে চাইলেন কেন? শফিক ভাই বললেন, তা জানি না। জাফরুল্লাহ ভাইর ঘুম নষ্ট এবার। ফেব্রুয়ারি মাসের আঠারো বা উনিশ তারিখে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জরুরি সভা বসেছে সকাল বেলা। অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশী তখন দেশে ফিরেছেন। সভায় জাফরুল্লাহ ভাই ছাড়া সবাই আছেন। সভায় বিভিন্ন কথার পর মাহমুদ শাহ কোরেশী হঠাৎই বললেন, কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে সবার নাম আছে। কিন্তু যিনি এই সম্মেলনের প্রাণ সেই ডক্টর রাহমান চৌধুরীর নাম নেই। আমি বললাম, আমি চাইনি আমার নাম থাক। মাহমুদ শাহ বললেন, না না তা হবে কী করে? আপনার নাম সবার আগে থাকতে হবে। তিনি উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের দিকে তাকালেন। বললেন, রাহমান চৌধুরীকেই মূল কমিটির সমন্বয়ক বা কো-অর্ডিনেটর করে দেই। উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার দুজনেই তাতে জোর সমর্থন জানালেন। আমি আপত্তি করলাম। রেজিস্ট্রার নিজেই এবার বললেন, আপনার নাম অবশ্যই থাকতে হবে।

 

সভায় সিদ্ধান্ত হলো দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর কমিটির কো-অর্ডিনেটর থাকবো আমি। তারপর দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দুজন আহবায়ক। মানে কোর কমিটির ছয়জন সদস্যর জায়গায় আমাকে প্রধান করে সদস্য হবে সাতজন। শফিক ভাইকে এসে বললাম, সভার সিদ্ধান্ত আমি মানি না। যদি স্মরণিকায় আপনি আমার নাম ছাপিয়ে দেন তাহলে আমি সম্মেলন ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবো। পরদিন বুঝলাম, সভার পুরো চালটা জাফরুল্লাহ ভাইর সাজানো। তিনি যা বলেছেন, তাই ঘটেছে। শফিক ভাই জাফরুল্লাহ ভাইকে বললেন, সভার সিদ্ধান্ত রাহমান ভাই মানছেন না। নাম দিতে রাজি হচ্ছেন না। জাফরুল্লাহ ভাই তখন শফিক ভাইকে বললেন, আমি যেন ঢাকায় গিয়ে সেদিনই জাফরুল্লাহ ভাইর সঙ্গে দেখা করি। শফিক ভাই জাফরুল্লাহ ভাইর বার্তা আমাকে পৌঁছে দিলেন। কিন্তু শফিক ভাইকে আমি জানালাম, আজ আমি ঢাকায় যাচ্ছি না। রাতে আজ আমাকে পিএইচএ থাকতে হবে। কারণ রাতে দুজন বিদেশী অতিথি আসবেন। শফিক ভাই আমার বার্তা পৌঁছে দিলেন জাফরুল্লাহ ভাইকে। জানিয়ে দিলেপ আমার পক্ষে ঢাকা যাওয়া সম্ভব নয় কেন?

 

সন্ধ্যার সময় খবর এলো, জাফরুল্লাহ ভাই আজ রাতে এসে পিএইচএ থাকবেন। খবরটা তিনি আমাকে জানাতে বলেছেন। কিন্তু আরো ভালো মতো খবর নিতে গিয়ে জানলাম, জাফরুল্লাহ ভাই রাতে ডায়ালাইসিস করে তারপর আসবেন। আসতে আসতে রাত বারোটা হবে। শফিক ভাইকে বললাম, কষ্ট করে এত রাতে আসবেন কেন? কাল সকালে আসলেই হয়। শফিক ভাই বললেন, আপনি ঢাকায় না গিয়ে জাফরুল্লাহকে এখানে আসতে বাধ্য করলেন। বললাম, আমি বাধ্য করলাম মানে? শফিক ভাই বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন না আপনি নাম দিতে রাজি হননি বলেই উনি রাতে আপনার কাছে আসবেন। জাফরুল্লাহকে তো আমি চিনি। নাম দিচ্ছেন না আপনি, কষ্ট পাচ্ছে জাফরুল্লাহ। যতক্ষণ আপনি নাম দেবেন না, সে শান্তি পাবে না। বললাম, জাফরুল্লাহ ভাইকে বলেন, রাতে কষ্ট করে এখানে আসার দরকার নেই। আপনি আমার নাম দিয়ে জাফরুল্লাহ ভাইকে জানিয়ে দিন।

 

লাভ হয়নি তাতে। জাফরুল্লাহ ভাই কিন্তু এসেছিলেন সেদিন। বহু রাতে। এসে আমাকে বললেন, দুজন অতিথি আছে তুমি আছো তাই তোমাদের সঙ্গে রাত কাটাতে আসলাম। চুপ করে রইলাম আমি । কী বলবো। জাফরুল্লাহ ভাইর বিরুদ্ধে আমার অনেক ক্ষোভ। কিন্তু যে মানুষটা আমার কড়া চিঠি পেয়ে প্রতিশোধমূলক আচরণ না করে বরং আমার রাগ ভাঙাতে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা থেকে সাভারের পিএইচএ চলে আসে তাঁর প্রতিদান দেবো কীভাবে? শত রাগ করলেও তাঁর কথা ভুলবো কী করে? জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে চিনতে পারা চারটিখানি কথা নয়। জাফরুল্লাহ একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

 

জাফরুল্লাহ ভাইর মূল সঙ্কটটা ছিল, তিনি বাংলাদেশের সব সমস্যা নিজে একা সমাধান করতে চেয়েছিলেন। শিরিন আপা দুঃখ করে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন তিনি ছিলেন এতোই কাজ পাগল যে, তাদের স্বামী স্ত্রীর অন্যরকম আনন্দের জীবন তেমন ছিল না। সমাজের সমস্যা দূর করার ঐকান্তিক আগ্রহ তাঁকে অনেক সময় স্বাভাবিক মানুষ থাকতে দেয়নি। প্রতিনিয়ত মাথার মধ্যে পরিকল্পনা ঘুরপাক খেতো, সেগুলোই আবার তাঁর কাজে বাধার সৃষ্টি করতো। এটা হলো মানব চরিত্রের এক দ্বান্দ্বিক দিক। নিজেই নিজেকে কাজের রজ্জু দিয়ে এমন ভাবে বেঁধেছিলেন, সঠিকভাবে কাজ করার জন্য যে মানসিক বিশ্রাম দরকার তা তিনি পাননি। বিশ্রাম জিনিসটা তিনি বুঝতেন না, সেটাই ছিল হয়তো তাঁর জীবনের বড় একটা দুর্বলতা। চিকিৎসক হিসেবে জাফরুল্লাহ ভাইর সেটা না বোঝাটা আমি কখনো মেলাতে পারিনি। কার্ল মার্কস পর্যন্ত মানসিক বিশ্রামের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। জাফরুল্লাহ ভাই মানুষকে চব্বিশ ঘণ্টা খাটাতে পারলেই যেন খুশি থাকতেন। তিনি সবাইকে অনেক সময় এতো কাজের চাপে রাখতেন, তা থেকে সবসময় সুফল আসতো না।

 

যখন আমি প্রতিবেশীকে জানো সম্মেলন করি, তখন অনেক বেশি টের পেলাম তিনি কারো উপর আস্থা রাখতে পারতেন না। কারো উপর সম্পূর্ণ কাজের ভার দিতে ভরসা পেতেন না। মনে করতেন, তিনি না নজরদারি না করলে মনে হয় কাজটা হবে না। তিনি এভাবেই একদিকে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভিন্ন দিকে শ্রমসাধ্য ভিন্ন ধরনের কাজকে পরিচালনা করার মতো অনেক ব্যক্তিকে রেখে গেছেন। পাশাপাশি অনেক বড় বড় কর্মের তিনি অনেক উদাহরণ তৈরি করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো, যে চিঠি আমি দিয়েছি তাঁকে, তিনি সেটা নিয়ে সামান্য জটিলতা তৈরি না করে সহজভাবে যে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। আজকের দিনে এটা বিরাট একটা গুণ। জাফরুল্লাহ ভাই তাঁর সমালোচনা করার জন্য কারো চাকরি খেয়েছেন এমন কথা শুনিনি। মুখে রাগ দেখালেও তিনি সেটা সহজভাবেই গ্রহণ করতেন। কিছু এমন ঘটনার কথা আমি জানি। সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের, আত্মবিশ্বাসের অভাবে আমরা সমালোচনা করতে ভরসা পাই না। কারণ আমাদের সমাজে সমালোচনা সহ্য করতে না পারার উদাহরণই বেশি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে যে সমালোচনা করে পার পেয়েছি, এর সামান্য অংশ তাঁর প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তাকে করলে ফল হতে পারতো ভয়াবহ। চলবে