জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি রহস্যময় কবিতা

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : জুন ২৭, ২০২২

১৯৮২ সালে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছিলাম। সেই পাসটাকে পরীক্ষায় পাস না বলে জীবনযুদ্ধের ভয়াবহ একটি পর্ব অতিক্রম করা বলা যেতে পারে। কপর্দকশূন্য একটি বালক গ্রাম থেকে আত্মীয়-পরিজনহীন নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে যে দুটি বছর অতিক্রম করেছে ওই দুটি বছরের পর তার আর পড়াশুনা করার সাধ থাকার কথা নয়। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে শুধু যে রক্তক্ষরণ থাকে, শুধু যে ধ্বংস আর বিপর্যয় থাকে তা নয়, ভেতরগত এক উন্মাদনাও থাকে। ওই উন্মাদনা জয়ের, সৃষ্টির। নারায়ণগঞ্জে আমার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে, চুরমার করে, ধ্বংস করে এবং তার ভেতর থেকে তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করে। থাকা-খাওয়ার জন্য পরের বাড়িতে থেকেছি। তাও এক বাড়িতে নয়, কয়েক বাড়িতে। সেই পরেরা না-বুঝত নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, না-বুঝত আমার শিক্ষা। কারণ তারা কিংবা তাদের কোনো পূর্বপুরুষেরা কোনো দিন স্কুলের গণ্ডি মাড়ায়নি। সুতরাং এইচএসসি পাস করলাম বটে তারপর কী করবো তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমন কেউ তখন ছিল না যাকে জিজ্ঞাসা করব কী করা যায় কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ এসে বাতলে দেবে পথ। তোলারাম কলেজের কোনো শিক্ষকের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়নি যার কাছ থেকে জেনে নেব ভবিষ্যৎ করণীয়।

চিরকাল অতি স্বল্প শিক্ষিত বাবাই ছিলেন আমার শিক্ষক, আমার প্রেরণার উৎস। সুতরাং বাড়িতে গিয়ে বাবার সঙ্গে কথা হলো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কয়েক দিন থাক। একটা কিছু হবে। আমার দরিদ্র বাবাকে দশ গ্রামের মানুষ মান্য করতেন। তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, বিচারবোধ ও সাহসিকতা তাকে দশ গ্রামে অপরিহার্য করে তুলেছিল। গ্রামের মানুষেরা যে কোনো বিপদে-আপদে, উৎসবে-অনুষ্ঠানে তার কাছে আসতেন, পরামর্শ নিতেন। ফলে জন্মের পর থেকে আমরা দেখেছি, সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমাদের ঘরে, বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্ন সময়ে লোকজন লেগেই আছে। আর কেরোসিনের চুলার ওপর কেতলিতে পানি ফুটছে। বাবা পান খেতেন না, তামাক-বিড়ি-সিগারেট খেতেন না। সারা দিন চা খেতেন। দিনে পনের থেকে বিশ কাপ। আমি তার ছোট ছেলে। আমার জন্য তিনি নিশ্চয়ই একটি পথ বের করবেন। তা তিনি করবেনই। পরামর্শ আর পথ নির্ধারণ তিনি করে দিতে পারবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি জানি, টাকা দিতে পারবেন না। যেটুকু জমিজিরাত তার ছিল, বড় ছেলে রুহুল আমিনকে পড়াতে গিয়ে বেচে দিয়েছেন। এখন বিক্রি করার মতো তার কোনো জমি নেই। সংসার চলে বুদ্ধির জোরে। আর আমার প্রতি এই বিশ্বাস তার ছিল যে, একবার যদি কোথাও ভর্তি হতে পারি তা হলে বাকিটা পথ চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।

অনেক সময় তিনি নিজের জ্ঞান-গরিমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতেন না। তখন চলে আসতেন ঢাকায়। আমরা ঠিক জানতাম না, ঢাকায় কার সঙ্গে তিনি কথা বলেন, কার পরামর্শ নেন। অনেক পরে জেনেছি, এলাকায় শিক্ষিত লোকের অভাব না থাকলেও তিনি ঢাকায় গিয়ে কাশেম খানের সঙ্গে কথা বলতেন, তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। সোনার চামিচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কাশেম খান। এমন সুদর্শন মানুষ আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। ৪৭-এর পর তার পিতা কলকাতার ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসলে তারা দরিদ্র হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই পরিবারটির আভিজাত্য কোনো দিন কমেনি। তখন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা যুবক কাশেম খান বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সোনালী ব্যাংক শাখায় কাজ করার সূত্রে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তাতেই তিনি বুঝেছিলেন যে, ওই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারই সময়। তখন দেশে চারটি মাত্র সাধারণ পাবলিক বিশ্বদ্যালয় ছিল। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর। ঢাকা থেকে দুদিন পরে ফিরে বাবা আমাকে বললেন, তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে।

১৯৮২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ২১% পাস করা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যে খুব কঠিন কিছু হবে না, সে আমি জানতাম। কিন্তু জানাটা যে সঠিক ছিল না এবং ভর্তি হওয়া যে খুব কঠিন ছিল সে আমি বুঝেছিলাম পরে। আর সমস্যা ছিল টাকার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে, একবার নয়, কয়েকবার। যে যে বিষয়ে পরীক্ষা দিতে চাই সেসব বিষয়ে দরখাস্ত করার জন্য যেতে হবে। প্রতিটি বিভাগে আলাদা আলাদা পরীক্ষা হতো। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিভাগে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কীভাবে যেতে হবে, কোথায় থাকতে হবে, কোথায় খেতে হবে, কিছুরই কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, ঠিক-ঠিকানা ছিল না। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যে পড়াশুনা করেছি তাই সম্বল। ওই সম্বলও অতি সামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি ছিল না, কোনো কোচিং সেন্টারও তখন ছিল না। ভর্তি পরীক্ষায় কী ধরনে প্রশ্ন আসে তার সঙ্গে কোনো পরিচই আমার ছিল না। সব মিলিয়ে অবস্থা মোটেই সুবিধার নয়।

তখনো ঢাকা আমার কাছে অপরিচিত একটি শহর। কলেজে পড়ার সময় আমি কখনো ঢাকায় আসিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়, কলেজের মতো একটি-দুটি বিল্ডিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কিনা, এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কলেজে দু-একজন পরিচিত সহপাঠী ছিল। পাস করার পর তাদের সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সব কিছু করতে হবে একা।

৮২-র কোনো এক সকালে শীতলক্ষা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে চাষাড়ার মোড়ে এসে বাসে উঠলাম। এখন যেমন চাষাড়ার মোড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত বাইপাস হয়েছে এবং চিটাগাঙ্গ রোড দিয়ে ঢাকার দিকে কিছুদূর এগুলেই ফ্লাই ওভারে অতি অল্প সময়ে ঢাকা পৌঁছা যায়, তখন এমন ব্যবস্থা ছিল না। লক্করঝক্কর মার্কা লোকাল বাসগুলো ফতুল্লা, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পাগলা, শ্যামপুর, মেম্বার বাড়ি, পোস্তগোলা, জুরাইন হয়ে গুলিস্তান আসতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগত। এর মাঝে কত যে মোড়-মহল্লা, হাট-বাজার, পাড়া-পল্লিতে থেমে থেমে ঢাকা অবধি পৌঁছাত তার হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়। চলার জন্য গাড়ি নাকি না-চলার জন্য, তা বোঝা কষ্টকর ছিল। হেলপার/ড্রাইভারা ভুলেই যেত যে, ঢাকা পৌঁছোতে হবে। কোনো পথিকের গাড়িতে ওঠার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে তা বুঝতে চেষ্টা করত হেলপার। কিংবা ওই পথিকের ঢাকা যাওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই, ইচ্ছাও নেই। হেলপারা চেষ্টা করত তাকেও বলে-কয়ে গাড়িতে উঠানো যায় কিনা, ঢাকায় নিয়ে আসা চলে কিনা। কাজ নেই তাতে কি। এভাবে চলতে চলতে কিংবা না-চলতে না-চলতে গাড়িটি এক সময় সত্যি যখন ঢাকায় এসে পৌঁছাত তখন যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামার শক্তিও লোপ পেত। কিন্তু শক্তি লোপ পেলে তো চলবে না। সুতরাং নতুন শক্তি সঞ্চয় করে যাত্রীগণ এমন হুড়মুড় করে, ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি করে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করতেন যেন গাড়িতে আগুন লেগে গেছে। সবার আগে নামতে না পারলে পুড়ে মরতে হবে। কিংবা ঢাকা শহর মুহূর্তের মধ্যে কোথায় চলে যাবে, এখনই নামতে হবে, নইলে সব শেষ। আমিও ওইভাবে গাড়ি থেকে নেমে বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। সেই সময় গুলিস্তানের হকাররা, টাউটরা, বাটপাররা এমন গেঁও বোকা একজনকে পেলে কী যে করে ছাড়ত তা আর এখানে না বলি। কিন্তু আমি যাব কোথায়? ভদ্রগোচের একজন পথিককে জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন দিকে? তিনি বাংলা বুঝলেন না। বললেন, ইনবারসিটি? বললাম, জি। তিনি পথ বাতলে দিলেন। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম।

পায়ে হেঁটে গুলিস্তান অতিক্রম করে ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যাম্পাসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। গুলিস্তান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এত কাছে, আমি ভাবতেই পারিনি। এখানেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমার বৃত্তান্তু শুনে সে বলল, চিন্তা কইর না, হবে অনে, চা খাও। আমি কলা-বিস্কুট খেলাম, চা খেলাম। এই বড় ভাইটি তখন রসান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। নাম সোহেল। সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে আমি বিজ্ঞান অনুষদ থেকে কয়েকটি ফর্ম তুললাম এবং তার সহযোগিতায় ফিলআপ করে জমা দিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ চলে আসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বোটানিতে টিকে ছিলাম। কিন্তু এই সাবজেক্টটি কখনোই আমার প্রিয় ছিল না। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়য়ে ভর্তি না হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেষ্টা করলাম।

ঢাকার আরেক নাম জাহাঙ্গীরনগর। সুতরাং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যে ঢাকার ভেতরেই কোথাও হবে, এ বিষয়ে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শেরে বাংলা নগরের কাছাকাছি কোথাও হবে বলেই নিজে থেকে আমি ধারণা করে নিয়েছিলাম। সব বিষয়েই মানুষের কিছু পূর্ব ধারণা তৈরি হয়। তার মনের আয়নায় একটি চিত্র তৈরি করে নেয় সে। ওই ধারণা যে ধারণাই সে কথাও ভুলে যায় সে। আমার অবস্থা হয়েছিল তাই। সুতরাং নারায়ণগঞ্জ থেকে যথারীতি গুলিস্তান গিয়ে বাসে চড়লাম। কন্ট্রাকটরকে বললাম, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। শুনে সে তো রেগে ফায়ার। আমনে এই গাড়িতে উঠছেন কিলিগা। নামেন নামেন। গাবতলি গিয়া সাভারের গাড়িত উডেন। এর মধ্যে বোদাই, কইতিগা আইছে এবং আরও গালাগাল যা করল তা আর কহতব্য নয়। কিন্তু ওইসব গালাগাল আমার কানে গেল না। আমি শুধু শুনলাম গাবতলি গিয়ে সাভারের গাড়িতে উঠতে হবে। সুতরাং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা শহরের মধ্যে অবস্থিত, আমার ভাবনার এই আর্কেটাইপ ভেঙে গেল। এখন আমাকে ভালো করে জানতে হবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় এবং কীভাবে যেতে হবে।

এই বোধ আমার ছিল যে, আদার বেপারি যেমন জাহাজের খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরও সবাই রাখে না। তখনো যে দেশের সত্তর ভাগ পরিবারে প্রথম প্রজন্ম স্কুলে যায়নি, সে দেশের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ রাখবেন তা ভাবা ঠিক নয়। সুতরাং পথচারীদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম শিক্ষিতের অবয়ব। জিজ্ঞাসা করলাম একজনকে। একদম অব্যর্থ। প্রবীণ বয়সের ওই ব্যক্তি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, সাভার পর্যন্ত যে গাড়ি যাবে তাতে উঠবে না। সাভারের পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তুমি উঠবে নয়ার হাঁটের গাড়িতে অথবা আরিচার গাড়িতে। জাহাঙ্গীরনগরের সীমানায় দুই-তিনটি স্টপেজ আছে। যে-কোনো একটিতে নেমে পড়বে। তবে প্রান্তিক মাঝামাঝি গেট। ওখানে নামলেই তোমার ভালো হবে। বুঝতে পারলাম, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভালো জানেন। তার পুত্র-কন্যা বা আত্মীয়-স্বজন নিশ্চয়ই জাহাঙ্গীরনগরে আছে।

গাবতলি গিয়ে আমি আরিচাগামী একটি বিআরটিসি গাড়িতে বাঁদিকের জানালা-পাশে বসে পড়ি। অন্যান্য গাড়ির মতো এই গাড়িটি লক্করঝক্কর মার্কা নয়। বড়ো গাড়ি। পরিপাটি। সিটগুলো ফাঁকা ফাঁকা। আরামদায়ক। কন্ট্রাকটর জিজ্ঞাসা করলেন, কই যাইবেন। বললাম, জাহাঙ্গীরনগর, প্রান্তিক। তিনি আর কিছু বললেন না। এখন আর ঠিক মনে নেই কত টাকা ভাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর কোথায়? গাড়ি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ভেতরে ভেতরে আশঙ্কা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রেখে চলে যাচ্ছি না তো। এমন একটি বিপদের চিন্তা মাথায় বহন করে করে যখন বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম তখনই কন্ট্রাকটরের হুঙ্কার: জাহাঙ্গীরনগর, গেটে আইয়েন। প্রান্তিকে আমরা পাঁচ-ছয়জন নামলাম। অথচ এদের কাউকেই আমি গাড়িতে দেখিনি। কোথায় বসেছিল এরা!

গাড়ি থেকে নেমে দেখি কলাপসিবল গেটের বাইরে হাতের ডান দিকে বেশ কিছু দোকানপাট। ডানদিকেও একটি দোকান। বেশ কয়েকজন ছেলে-মেয়ে চেয়ারে বসে, ইটের স্তূপে বসে, গাছের গোড়ায় বসে চা খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। আমি অপ্রস্তুত। নবাগতে সংকোচ নিয়ে আমিও এক গেলাস পানি আর চা চেয়ে নিলাম। চা খেতে খেতে পরিবেশটা বুঝে নিতে চেষ্টা করলাম এবং এর মধ্যেই কলা ভবনের অবস্থান জেনে নিলাম। কলাপসিবল গেট অতিক্রম করে আমি বিস্মিত। রাস্তাগুলো সিরামিক ইটের তৈরি। ওই ইটের উপর কোনো আস্তরণ নেই। ইটের ফাঁকফোকর গলিয়ে সবুঝ ঘাসের সমারোহ। প্রাণ আর অপ্রাণের এমন সহাবস্থানে আমি মুগ্ধ হই। রাস্তার দুপাশে বৃক্ষরাজি। আকাশ সমান উঁচু বৃক্ষরাজির শাখা-প্রশাখা ও পত্র-পল্লব অতিক্রম করে সূর্যের যেটুকু আলো রাস্তায় এসে পড়ে সেই আলোটুকু আলো-আঁধারের মূর্ত-বিমূর্ত কত ছবি যে রাস্তার উপর এঁকে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই সব চিত্রকর্ম আবার চলিষ্ণু। গাছের ডালে বাতাসের প্রবাহ আর ধাক্কায় যে ঢেউ তৈরি হয় তার সঙ্গে একই তালে গতি পায় রাস্তার ওই আলোর ছবিগুলো, ছবির আলোগুলো। যে ঢেউ বয়ে যায় বৃক্ষরাজির উপর দিয়ে, রাস্তায়ও যেন বয়ে যায় সেই আলোর ঢেউ, ঢেউয়ের আলো। আলোর ওই ছবিগুলো যখন নড়ে তখন রাস্তাটাও যেন নড়ে, গতি পায়।

ওই আলোতে মিশে গেছে সিরামিক ইটের মেরুণ রঙের প্রবাহ। সবুজ আর মেরুণ আর ঝরা পাতার ধূসর রং মিলে-মিশে কি যে এক উচ্ছল রঙের ফোয়ার প্রতিটি ইটের চারদিকে, রাস্তার বাতাসে বাতাসে, রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজি ও আবাসিক ভবনগুলোতে ছড়িয়ে থাকছে তা থেকে কিছুতেই চোখ আর মন ফিরাতে পারছিলাম না। যে দিকে তাকাই সে দিকেই চলছে প্রকৃতির রঙের খেলা। চারদিকে চেয়ে দেখি, বৃক্ষরাজির আড়ালে-আবডালে যেসব ভবন দেখা যায়, তাও ওই সিরামিক ইটের তৈরি এবং তার মাঝে কত যে সবুজ ভূমি, কত যে ফুল-ফলের বাগান, কত যে উঁচু গাছ-গাছালি তার কোনো শেষ নেই। এই বিপুলতার মেধ্য, ঐশ^র্য আর সমৃদ্ধির মধ্যে অতি ক্ষীণ, হতদরিদ্র আমি কত যে সংশয় আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে হাঁটছিলাম তা আর কি বলব। সবাই হাঁটছিল। কারণ ভেতরে কোনো রিকসা ছিল না, অটো ছিল না, টেম্পু ছিল না। পরে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িগুলো এবং শিক্ষক ও অতিথিদের ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া কোনো সাধারণ পরিবহন চলে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসে। আল-বেরুনী হল থেকে মীর মশাররফ হোসেন হলে যেতে কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস মিস করত তা হলে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে ওই বিকল্প নিয়ে কেউ কখনো ভেবেছে বলেও মনে হয় না।
কারণ, এ ছিল পায়ে হেঁটে চলার এমন এক আনন্দিত সংস্কৃতি, যেখানে বিকল্প ভাবনার প্রয়োজন হতো না। যে কেউ নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে বলতে চলে যেতে পারত হলে। শুধু নিজের সঙ্গে নিজে নয়, সঙ্গে থাকত ঘাস, ফুল, উঁচু গাছ, পাখি, জলাশয়, আলো-ছায়া এবং অফুরন্ত নির্জনতা। কলা ভবনের দিকে কিছু দূর এগোতেই আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। রাস্তার উত্তরে আর দক্ষিণে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে জলাশয়। আকাশ আর বৃক্ষাদির প্রতিবিম্ব পড়েছে সেই জলাশয়ে। জলের নিচে আরেক পৃথিবী। জলাশয়ে ফুটে আছে পদ্মফুল, শ্বেতপদ্ম, লালপদ্ম, নীলপদ্ম। জলের উপর গভীর মমতায় শুয়ে আছে পদ্মপাতা। মৃদু বাতাসে জলে ঢেউ উঠেছে। সেই ঢেউয়ে পদ্মপাতাগুলো দুলছে। দুলছে পানির নিচের আকাশ, বৃক্ষরাজি, প্রতিবিম্বিত পৃথিবী। শাপলা-শালুক এবং আরও কত বিচিত্র জলজ উদ্ভিদ যে আপন আপন স্বভাব, সৌন্দর্য আর নির্জনতা নিয়ে জলাশয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তীরে বাঁশের একটি কঞ্চির উপর বসে আছে মাছরাঙা। গোলাপী বুকের নিচে ধূসর বাঁশের কঞ্চিটি মিশে গেছে। মাঝে মধ্যে সাদা ছোপ এবং নীল আর বেগুনীর মিশ্রণে তার পালক সাদা মেঘ কিংবা নীল আকাশ কিংবা পত্রপল্লবের গাঢ় সবুজের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সে আছে তন্ময় হয়ে। জলের ভেতরে কোনো মৎস বা মৎস সাবকের অপেক্ষায়।

এছাড়া কোথাও হাঁস, পানকৌড়ি, গয়ার, বাটান, পিপি, টিটি, বক, ডাহুক এবং আরও কত যে জলজ পাখি এই জলাশয়গুলোকে ঘিরে রাজত্ব বিস্তার করে আছে তাদের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। আর আছে প্রজাপতির জগৎ। শত-সহস্র রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে ঘাসের ডগায় ডগায়, গাছের পাতায় পাতায়। হাতের বাঁ দিকে আল বেরুনী হল রেখে আমি সোজা চলে গেলাম কলা ভবনে। সেই সময় কোনো কিছুই ভালো করে দেখার ফুরসৎ ছিল না। দরখাস্ত করতে হবে বিভিন্ন বিষয়ে। কোনো রকমে এইচএসসি পাস করা আমি অধিকাংশ সাবজেক্টে দরখাস্ত করার সুযোগ পাব না। তারপরও খুব ভালো করে দেখতে হবে, কোন কোন সাবজেক্টে দরখাস্ত করা যায়। ইতিহাস ডিপার্টেমেন্টটা তখন কলা ভবনের দোতলায়ই ছিল। ওখানে দরখাস্ত করলাম। তারপর যাব জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে। ইংরেজি বিভাগে দরখাস্ত করার যোগ্যতা নেই। প্রিয় বিষয় অর্থনীতিতেও না। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো বিষয়েই দরখাস্ত করতে পারবো না। বাংলায় পড়ে কে? বাংলা আবার পড়ার কী আছে? বাংলা পড়তে তো জানিই। সুতরাং বাংলায় দরখাস্ত করলাম না। ভূগোল বিভাগে গেলাম পায়ে হেঁটে। হাঁটা যে এত মধুর হতে পারে তা জানা ছিল না। দুই দিকে জলাশয় আর বিস্তৃত বনভূমি ছাড়া আর কিছু নেই। সিরামিক ইটের তৈরি রাস্তাগুলো সবুজ বনভূমির ভেতর দিয়ে শিল্পীর আঁকা মেরুণ রঙের আল পথের মতো কোথায় চলে গেছে! বাতাসে জলের গন্ধ, পাতার গন্ধ, ঘাসের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, মাটির গন্ধ, রোদের গন্ধ। এমন ভালো লাগার অনুভূতি ওই প্রথম। কলা ভবন থেকে ভূগোল বিভাগ খুব কাছে নয় আবার অনেক দূরেও নয়। ডান দিকে মানে পশ্চিম দিকে লাইব্রেরি আর পদার্থ-রসান বিভাগ রেখে আমি চলে গেলাম বাঁদিকে, সামান্য পুবে। ভূগোল বিভাগের স্থাপত্য সৌকর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। একদম একা একটি প্রতিষ্ঠান। ভেতরে অল্প কয়জন শিক্ষক এবং অনুপাতে তারচেয়ে অল্প শিক্ষার্থী। আমার বড়ো বোনের দেবর শাহজাহান ভাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূগোল বিভাগেরই ছাত্র, সে কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। সুতারং কারো খোঁজখবর না-নিয়ে একটি দরখাস্ত জমা দিয়ে আমি আরও একটু পুবদিকে এগোয়ে যাই। জানলাম, এটি ক্যাপেটেরিয় এবং এর থেকে সামান্য দক্ষিণে মুক্তমঞ্চ। মুক্তমঞ্চের উপরে বিস্তৃত খেলার মাঠ। আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। এই ক্যাপেটেরিয়া, এই মুক্তমঞ্চ, এই খেলার মাঠ, প্রতিটি ভূমিরূপ, প্রতিটি স্থাপনা, স্থাপনাগুলোকে ঘিরে প্রকৃতির অফুরন্ত দাক্ষিণ্য দেখে দেখে আমি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালকে আমার মনে হলো একটি রহস্যময় কবিতা।

মুক্তমঞ্চটা আমার কাছে একেবারেই অন্য রকম মনে হলো। এ ধরনের নাটমঞ্চের ধারণা কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে পরে জানতে পেরেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যান্ডস্কেপ এমন যে, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। ছোট টিলার মতো আছে কোথাও। বিস্তৃত খেলার মাঠটি বেশ উঁচু। ক্যাপেটেরিয়া ও ভূগোল বিভাগ অনেকটাই নিচুতে। ভূমির এই গড়নটিকে মুক্তমঞ্চ তৈরিতে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রাচীন কালে গ্রিক দেশে পাহাড়ের পাদদেশকে মঞ্চ এবং পাহাড় কেটে সিঁড়ির মতো বানিয়ে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা করা হতো। তখন এইসব তত্ত¡ জানার আগ্রহ ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। শুধু এই ভেবে বিস্মিত হয়েছি যে, শিশুদের কৌতূহল থেকে নির্মিত খেলনার মতো এই যে মঞ্চটি বনানো হয়েছে তার সবটুকু ঘিরে আছে প্রকৃতির মতো স্বতঃস্ফূর্ত জীবনাখ্যানের নিত্য মঞ্চায়ন অভিপ্রায়। কোনো সাজ নেই, সজ্জা নেই, আরম্ভর নেইÑ এক কথায় বলা যায় মঞ্চের একটি অংশ ঘিরে একটি দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। দর্শক সাড়িতে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম আমি। আর ভাবছিলাম, এই বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়তো হবে না, এতটা বাজে রেজাল্ট করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়া যায় না। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো তার মূল্য তো কম নয়। যে পথে এখানে এসেছিলাম সে পথ ধরেই আবার প্রান্তিকের দিকে (পরে জেনেছি, এই গেটটির নাম জয় বাংলা গেট) হাঁটতে শুরু করলাম।

ভূগোল বিভাগে যাওয়ার পথে কেন আমার চোখেই পড়েনি জানি না, এখন ফেরার পথে বাঁদিকের লেকের একদম পশ্চিম পাড়ের কচুরিপানা, ক্ষুদেপানা, শাপলা-শালুক আর অসংখ্য জলজ উদ্ভিদগুলোর সঙ্গে ভাসছে অসংখ্য অতিথি পাখি। তাদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠছে জলজ জীবন। বলাকার মতো সারি বেঁধে আকাশে উড়ে যাচ্ছ এক সঙ্গে। এবং ডানায় রোদ মেখে, গায়ে উষ্ণতা নিয়ে আবার ফিরে আসছে লেকের জলে। এই জল, এই বৃক্ষরাজি, এই অতিথি পাখি এবং এই তাদের কোলাহল ঘিরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অপার্থিব যে পরিবেশ বিরাজমান ছিল তা উপভোগের জন্য খুব বেশি মানুষ দেখিনি তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আবাসিক শিক্ষকদের পরিবারের লোকজন, কর্মচারি-কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের লোকজন এবং এখন এই ভর্তির সময়ে বহিরাগত কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের সজন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন তারা এই বিপুল ক্যানভাসের কোথায় যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নাই হয়ে আছেন তাদের দেখা পাওয়া যায় ক্বচিৎ। বিস্রস্ত ঘুরে বেড়ানো এই মানুষগুলোকে আমার এলিয়েন বলে মনে হয়। যেন এই গ্রহের লোক নয় তারা, একটি ভুল গ্রহে চলে এসেছে। তারা পথ ভুলে গেছে, হারিয়ে গেছে নিজের কাছ থেকে নিজেও। এই নতুন গ্রহে তাদের কোনো কাজ নেই। সুতরাং তারা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা মানুষগুলো মুসকিলের। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তারা হোঁচট খায়, খেই হারিয়ে ফেলে। জিগগ্যেস করলাম একজনকে, ভাই ঢাকা যাবেন? বলল সে, কী বলছেন? আমাকে বলছেন? আমি বললম, না, কিছু বলিনি, ঠিক আছে, ভালো থাকেন। আমি আবার প্রান্তিকের পথে হাঁটতে শুরু করলাম।

প্রান্তিকে গিয়ে বিস্কুট, কলা, চা, সিগারেট খেয়ে আমি যখন ঢাকার গাড়িতে উঠতে যাবো তখন দেখি খালেদ গাড়ি থেকে নামছে। খালেদ হোসাইন। সরকারি তোলারাম কলেজে পড়ার সময় হাতে গোণা যে কয়জন বন্ধু আমার ছিল, তাদের অন্যতম। ও আমাকে আর গাড়িতে উঠতে দিল না। হাত প্যাঁচিয়ে ধরল। কিছুতে ছুটে পারা যায় না এমনভাবে হাত প্যাঁচিয়ে ধরত খালেদ এবং পরে দেখেছি কফিলকে। সুতরাং তখনই আমার ঢাকায় ফেরা হলো না। ওকে সঙ্গ দিতে হবে। বাংলা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে ও দরখাস্ত করবে না। সুতরাং আমরা সোজা চলে আসলাম কলা ভবনে, বাংলা বিভাগে। আমাকে বলল, তুইও বাংলায় কর। আমি বললা, দূর, বাংলা একটা পড়ার বিষয় হলো! তুই ছড়া-কবিতা লেখস, তুই পড়। আমার দরখাস্ত করার ইচ্ছা নেই, টাকাও নেই। বাদ দে। কিন্তু খালেদ নাছোড় বান্দা। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সে আমার নামে একটি দরখাস্ত জমা দিয়ে দিল। এবং তারপর আমাকে বাংলায়ই পড়তে হয়েছে। কিন্তু সে অন্য এক অধ্যায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ