জীবন এক আশ্চর্য ভ্রমণ

পর্ব ১০

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো দশম পর্ব।

২৪ এপ্রিল ২০২১ শনিবার
অফিসে বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই সময় কেটেছে আজ। অনেকে বলেন, ব্যস্ততা থাকা ভালো। তাতে একাকিত্ব ভুলে থাকা যায়। নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকা যায়। হতাশা ভুলে থাকা যায়। যাপিত জীবনের যাতনা ভুলে থাকা যায়। ফেলে আসা এক টুকরো জীবনের জন্য হাহাকার ভুলে থাকা যায়। কই, আমার তো তা মনে হয় না। শতেক ব্যস্ততার মধ্যেও ধুম করে এক ঝুম বৃষ্টির কথা মনে পড়ে আমার। কোনো কারণ ছাড়াই হীরাঝিলের মুরগির স্যুপের কথা মনে পড়ে। ধুলোমাখা এক ফুটপাত ঘুর্ণি হাওয়ার মতো ঘুরে ঘুরে মনে পড়ে। আজ বিকেল অবধি নানা কাজে ডুবে থাকলাম, তবু ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ল এইসব।

বিকেলের দিকে অফিস থেকে বের হয়ে পপুলার হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। তার আগে অফিসের গেটেই এক সহকর্মী মুন্নাফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তারও নিবাস মোহাম্মদপুরের দিকে। প্রস্তাব দিলেন, চলেন ভাই, হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে যাই। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমাকে একটু পপুলারে যেতে হবে, ভাই। বিশেষ কাজ আছে। তিনি বললেন, পপুলারে যাচ্ছেন যখন, বাদল ভাইয়ের একটু খোঁজ নিয়ে আইসেন।
বাদল ভাই আমাদের আরেক সহকর্মী। কোভিড আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক দিন যাবৎ পপুলারের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। বললাম, ও… হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাদল ভাই তো অসুস্থ শুনেছিলাম। নিশ্চয় খোঁজ নেব।

পপুলারে গিয়ে মিল্টন ভাইকে ফোন দিলাম। মিল্টন ভাই ভীষণ ব্যস্ত। ডেপুটি ম্যানেজার হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই তার ব্যস্ততা আরও বেড়েছে। ফোন রিসিভ করে বললেন, একটু বোসো। হাতে কিছু বিলের কাগজ আছে। ছেড়েই আসতেছি।
কত রোগী এখানে আসছে, যাচ্ছে। কত রোগীর স্বজন। মুমূর্ষু, মলিন মুখ। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় ভরা। জলভারে নত চোখ। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এসব দেখছি। জীবন এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জীবন এখানে সুতোর উপর দুলছে। ক্ষণিকের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর এপার ওপার চলে যাচ্ছে কত মানুষ! কদিন আগেই শুনলাম, এখানে ২৩৪জন কোভিড রোগী ভর্তি আছেন। এখন হয়তো সবগুলো বেডই কোভিড রোগীতে ঠাসা। অন্যকোনো রোগী নেই। কিংবা কে জানে, রোগীর সংখ্যা হয়তো কমতে শুরু করেছে। আমি ঠিক জানি না।

পরে মিল্টন ভাই এলে নানা গল্প গুজব হলো। হতাশার গল্প হলো, ব্যর্থতার গল্প হলো, বেদনার গল্প হলো, সান্ত্বনার গল্প হলো। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল, মিল্টন ভাই তাড়া দিলেন, তোমার না শঙ্করে ওই ডাক্তারের সাথে দেখা করার কথা। আমার মনে পড়ল, শঙ্কর এক হসপিটালে আমার ছোটবোন বসে আছে। আমার এক্ষুণি যাওয়া উচিত।

পপুলার থেকে বের হয়ে রিকশা ধরলাম। পথে যেতে যেতে দেখলাম, রাইফেল স্কয়ারের সামনে এক রিকশা চাকা ভেঙে পড়ে আছে। একটু দূরে এক সিএসজি ঘিরে উত্তপ্ত কয়েকজন মানুষ। বুঝলাম, দুর্ঘটনাটা সিএনজিই ঘটিয়েছে। এরপর জিগাতলা পেরিয়ে দেখি, একই ঘটনা। এক মোটরসাইকেল চালক আর এক সিএনজিচালক তীব্র ঝগড়ায় লিপ্ত। তাদেরকে ঘিরে কিছু উৎসুক জনতা। আমি যে রিকশায় যাচ্ছিলাম সেই রিকশাচালক বললেন, ফাঁকা রাস্তা পাইয়া সিএনজি ওয়ালারা হুঁশ হারাই ফেলছে। যারে তারে বাধাই দিতাছে।
শঙ্করে নেমে জানলাম, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ছোটবোন বাসায় চলে গেছে।

ইফতারের সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। ডুবে যাওয়ার আগে সূর্যটা মাতালের চোখের মতো লাল হয়ে উঠেছে। পশ্চিমাকাশ ছেয়ে গেছে তার মাতাল আভায়। আমার হঠাৎ মনে পড়ল জসিম উদদীনের কবিতার লাইন—
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
ওমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

ইদানীং যখন তখন লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। জীবনের কাছে, জগতের কাছে, মৃত্যুর কাছে, পরাস্থ সময় ও পৃথিবীর কাছে। যে জীবন যাপন করছি সে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার এটাই সম্ভবত সর্বশেষ উপায়—লুটিয়ে পড়া। একদিন ঠিকই লুটিয়ে পড়ব। হয়তো খুব শিগগিরই। আমার উপর দিয়ে অবলীলায় চলে যাবে দহনবোঝাই বুলডোজার। আমি চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে থাকব মমতাময়ী মাটির বুকে।

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে পড়ল, ভ্যানের উপর নানা জাতের সবজি বিক্রি করছেন একজন। এরমধ্যে লাউগুলোকে বেশ কচি মনে হলো। একটা লাউ কিনলাম। একটু আগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার কথা ভাবছিল যে মানুষটা সে এখন বেঁচে থাকার জন্য লাউ কিনে নিয়ে বাসায় যাচ্ছে। জীবন এক আশ্চর্য ভ্রমণ!
হঠাৎ মনে পড়ল, বাদল ভাইয়ের খবর তো নেওয়া হলো না। ধ্যাৎ! চলবে