টোকন ঠাকুর গ্রেফতারে সাহিত্যিকদের প্রতিবাদ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০২০

কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুরকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর কাঁটাবন এলাকা থেকে নিউমার্কেট থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, টোকন ঠাকুর `কাঁটা` নামের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন। অনুদানের অর্থ নিয়ে ৯ মাসের মধ্যে ছবি মুক্তি দেয়ার নিয়ম থাকলেও আট বছরেও তা তিনি সম্পন্ন করতে পারেননি। এ ঘটনার পরপরই দেশের কবি-সাহিত্যিকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবাদ জানায়। সেখান থেকে কয়েকটি প্রতিবাদবার্তা তুলে ধরা হলো:

জাকির তালুকদার, কথাসাহিত্যিক
টোকন ঠাকুরকে মুক্তি দিন। সিনেমাটি শেষ করার সুযোগ দিন। আমি বলছি না, এই দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়া মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে টোকনকেও ছাড় দিতে হবে। একটা অন্যায়ের অজুহাত তুলে আরেকটি অন্যায়কে সমর্থন করার কোনো মানে হয় না। আমি শুধু বলতে চাই, ইনটেনশনটি খেয়াল করুন। টোকনের তো টাকা মেরে দেয়ার ইনটেনশন নেই। সে সিনেমাটি শেষ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

মাসখানেক আগে বলছিল করোনাকালে কোনো কাজ পায়নি। বাসাভাড়া বাকি ছয়মাসের। তারপরেই বলতে শুরু করল সিনেমা তৈরির গল্প। কীভাবে কাজ করেছে, সিনেমাটিকে ঘিরে তার কি কি স্বপ্ন আছে, বলতেই থাকল সে। আমি বলেছিলাম ৩৫ লাখ টাকায় কি সিনেমা তৈরি সম্ভব? কেন গেলেন সেই অনুদানটি নিতে? মাসুদ পথিক ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ বানানোর সময় অনুদান পেয়েছিল। কিন্তু সেই টাকাতে কাজ শেষ করতে পারা অসম্ভব ছিল। বাড়ির কয়েক বিঘা জমি বিক্রি করে সিনেমাটি শেষ করেছিল সে।

টোকনের পরিবারের বিক্রি করার মতো জমি আছে কিনা, জানি না। তবে সে সিনেমা তৈরির কাজটা শেষ করতে বদ্ধপরিকর বলেই মনে হয়েছে আমার। একটি সুযোগ তার প্রাপ্য।

কামরুজ্জামান কামু, কবি
টোকনকে অবিলম্বে থানা থেকে বাসায় রেখে আসা উচিত। সরকার সিনেমা বানানোর জন্য একজন পরিচালককে যে পরিমান টাকা অনুদান দেয়, তা দিয়ে ছবি শেষ করা যায় না। এই ধরনের অনুদান দিয়ে এদেশের গরিব চলচ্চিত্রকারদের বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার চেয়ে অনুদান না দেয়াই ভালো। এখানে ছবি তৈরি হলেই কী আর না হলেই কী!

আবু সাইয়ীদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
‘কাঁটা’ শিরোনামে সিনেমা করার কথা বলে সরকারি অনুদান নিয়েছিলেন টোকন ঠাকুর। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সিনেমা জমা দেননি তিনি। এজন্য কবি ও পরিচালক টোকন ঠাকুরের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ তছরুপের অভিযোগে মামলা করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। ওই মামলায় রোববার রাত ৮টার দিকে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ভাড়া বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাংলাদেশের মতো একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশে, যেখানে সরকারি অর্থ কখনো তছরুপ হয় না, সেখানে একজন কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালকের এহেন ঘটনায় সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবে, এটিই স্বাভাবিক। পরের লাইনগুলো আজকে আর না লিখি... আসছে কিছু প্রশ্ন... কিছু বাস্তবতা।

স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
এই সময়ের অন্যতম প্রধান কবি টোকন ঠাকুরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। না, তিনি চুরি করেননি, ডাকাতি করেননি, হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেননি। কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের ছোটগল্প ‘কাঁটা’ অবলম্বনে একই শিরোনামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন তিনি। সিনেমাটি নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই মামলায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ব্যাপারটা আদালতের, তাই টোকন ঠাকুরের মুক্তি পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যে নেই।

এমন নয় যে, টোকন ঠাকুর সরকারি অনুদানের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়ন শেষ করেছেন। বর্তমানে সম্পাদনার পর্যায়ে রয়েছে। এক কোটি ষোল লাখ টাকার ফুটেজ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে জমাও দিয়েছেন। অনুদানের বরাদ্দ ৩৫ লাখ টাকা থেকে মাত্র সাড়ে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। সাড়ে ২৪ লাখ এখনো বাকি। মাত্র সাড়ে ১০ লাখ টাকার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অথচ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি গ্রেফতার হয় না, সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকা পাচারকারী গ্রেফতার হয় না। তার মানে আইন যে সবার জন্য সমান নয়, কবি টোকন ঠাকুরকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আমাদের জানান দেয়া হলো।

শহীদুল জহিরের মতো একজন কথাশিল্পীর গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ এত সহজ ব্যাপার নয়। টোকন ঠাকুর সাত বছর সময় নিয়েছেন। ভালো কাজ করতে গেলে বেশি সময় লাগতেই পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এটা বোঝা উচিত। টোকন ঠাকুর দেশ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাবেন না। সরকারের সাড়ে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করবেন না। চলচ্চিত্র নির্মাণ তার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করবেনই। আমরা নিশ্চিত। চলচ্চিত্র নির্মাণে এই অনুদান নিয়ে আমাদের কথা আছে। এই অনুদানে ভালো সিনেমা আদৌ নির্মাণ করা যায় কিনা, তা নিয়ে কথা আছে। মধ্য আয়ের দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। ছোটখাটো প্রকল্পে যেখানে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, সেখানে শিল্প-সংস্কৃতির খাতে বরাদ্দ এত কম কেন, সে নিয়েও কথা আছে।

সেসব কথা পরে। আগে চাই কবির জামিন। আশা করি আজ তিনি জামিনে মুক্তি পাবেন। আমরা সেই প্রচেষ্টায়।

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন, কবি
আমার জানামতে, জুনায়েদ হালিম ২০০৯ সালে অনুদান পেলেও প্রাথমিক টাকা তুলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি, এখন তিনি অনুদান কমিটির জুরি। অনুদান নিয়ে সিনেমা শেষ করেন নাই শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ও সালাহউদ্দিন জাকী। আর সিনেমার ৯০% কাজ করেও থানা হাজতে কবি টোকন ঠাকুর।  এই দেখা যায় বাংলাদেশ।

মেহেদী উল্লাহ, কথাসাহিত্যিক
জানি না, টোকন ঠাকুরের কোনো `আত্মপক্ষ সমর্থন` আছে কিনা। সময়মতো কেন দিতে পারেনি সিনেমা! শিল্পের রাস্তা কঠিন! যে একবার মাড়ায়, সে বোঝে! টাকা, সময়, আইন— সবকিছুর সমন্বয় হোক। শিল্পের জন্য শিল্প, জীবনের জন্য শিল্প শুনেছি! আইনানুগ কিছু শিল্পও আছে। যেমন, অনুদানের সিনেমা। শিল্পের সাথে নানারকম শর্ত, চুক্তিও কড়াকড়িভাবে দেখা হয়। সুযোগ থাকলে শিল্পী মানুষদের এসবে জড়ানোর আগে ভাবা উচিত। শর্ত, চুক্তি এতকিছুর ভিড়ে শিল্পটাই নাই হয়ে যেতে পারে। যদিও অনুদানে বেশ কয়েকটি ভালো সিনেমাও হয়েছে। কবির মুক্তি চাই! শিল্পেরও মুক্তি ঘটুক।

রওশন আরা মুক্তা, কবি
কবি টোকন ঠাকুরের সাথে কয়েকদিন আগে কাঁটাবনে দেখা। চলার পথে দেখা তাই কুশলের সাথে এটাও জানা গেল, তিনি ওই এলাকায় বাসা খুঁজছেন। আজকে শুনি তিনি পুলিশ কাস্টডিতে সরকারি সম্পত্তি তছরুপের মামলায়। সরকারি টাকায় বিশাল বিশাল বিল্ডিং তুলে ভাড়া দিচ্ছে লোকজন আর কবি ভাড়া বাসার পেছনে ছুটতে ছুটতে, ভুগতে ভুগতে কেন সিনেমা বানিয়ে সময়মতো জমা দিলেন না তাই তার জেল! এ জন্যেই ছবিতে টোকন ভাইকে পুলিশের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখলাম। উনার জায়গায় থাকলে আমি হয়তো হাসতে পারতাম না, তাই তাকে আমার অনেক বড় মানুষ মনে হইল। টোকন ঠাকুরকে মুক্তি দেয়া হোক!

 

রুদ্র হক, কবি ও গণমাধ্যমকর্মী
কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুরকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানাই। ‘কাঁটা’ সিনেমা নির্মাণে ওনার দীর্ঘদিনের শ্রম, সাধনা ও ডেডিকেশানের কথা আমরা জানি, অবিলম্বে রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও নির্মাতার প্রতি সহনশীল আচরণ ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক মুক্তি কামনা করছি। একদিকে কপিরাইট আইন লংঘনের কোনো শাস্তি নাই, অন্যদিকে নির্মাতার প্রতি এমন অসহনশীল আচরণের এই সময় শিল্পের জন্য ভয়াবহ দুঃসময়।