
ডা. আব্দুর নূর তুষারের স্মৃতিগদ্য ‘ভাতের অভাব’
প্রকাশিত : মে ০৭, ২০২২
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আম্মা আমাকে সপ্তাহে একশো টাকা দিতেন যাতায়াত ভাতা। আর মাসে পাঁচশো টাকা দিতেন অন্যান্য খরচের জন্য। সব মিলিয়ে ৯০০ টাকা। আমার সারা মাসে যাতায়াতের টাকা লাগত তিনশো টাকা।
সরাসরি মিনিবাসে চানখারপুল বা বখশিবাজার যেতে-আসতে মীরপুর থেকে দিনে দশ টাকা। মুড়ির টিনে (বড় বাস) চড়লে ছয় টাকা। ছাত্র আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া, তিন টাকা। তাই প্রতিবার মাসের শেষ সপ্তাহের শুরুতে একশো টাকা পেলেই আমি চলে যেতাম নিউমার্কেট। হেঁটে যেতাম যাতে পয়সা বাঁচে। আর জমানো পুরো টাকা দিয়ে বই কিনতাম।
একবার বই কিনে পকেটে আছে ১২ টাকা। রিকশা করে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। রিকশাঅলা অতিরিক্ত ভাড়া চাইতে থাকায় আমি হেঁটে কলাবাগান চলে এলাম। কলাবাগান থেকে আমার বাসার রিকশা ভাড়া ছিল আট টাকা। কেন যেন কোনো রিকশাঅলা সেদিন যেতে রাজি হয় না।
আমি রাগ করে হেঁটে চলে এলাম আসাদগেট। এবার একজন রাজি হলো যেতে, কিন্তু ভাড়া তখনো বেশি। পকেটের ১২ টাকাই সে চায়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, হেঁটেই বাড়ি ফিরবো।
কলেজ গেট আর শ্যামলীর সংযোগস্থলে আসতেই দেখি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দিনমজুর কাঁদছেন আর বলছেন, আল্লাহ, তোমার দুনিয়ায় কি কেউ নাই আমারে একবেলা ভাত খাওয়ায়!
এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম। মনে হলো, তিনি সত্যি কথাই বলছেন। সকালে এসেছিলেন তুরাগ নদীর ওপার থেকে বসিলা হয়ে। দেরি হয়ে যাওয়ায় কাজ পাননি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আজকে না খেলে তো কালকেও কাজ করতে পারবো না।
উল্টোদিকের হোটেলে তাকে নিয়ে যেতে তিনি বললেন, কই মাছ দিয়ে ভাত খাবেন।
হোটেলঅলা বললো, ভাত আর কই মাছ ১২ টাকা।
পকেটের সব টাকা দিয়ে তাকে ভাত আর কই মাছ খাওয়ালাম। তিনি হাততুলে আমাকে দোয়া করলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ, আমার ভাইটার জীবনে যেন কোনোদিন ভাতের অভাব না হয়।
আমি বাকি রাস্তা হেঁটে মীরপুরে বাড়িতে ফিরলাম।
যখন এভাবে বই বা খেলনা কিনেছি, আমার পকেটে বহুদিন টাকা ফুরিয়ে গেছে। এমনকি বিদেশেও একবার এমন হয়েছিল। পকেটে টাকা নাই। থাকতে হবে আরও দুই দিন। খিদে লাগার সাথে সাথে কেউ না কেউ আমাকে খাবার সেধেছে। আমার জীবনে এখনো ভাতের অভাব হয় নাই।
সেদিন কেন এতটা পথ হেঁটেছিলাম?
এখন বুঝি, আমি নিজের ইচ্ছেয় হাঁটিনি। সেই দিনমজুরের দোয়া কবুল হয়েছিল। আমি হেঁটেছিলাম কারণ, আল্লাহ সেদিন আমার মাধ্যমে তাকে ভাত পাঠিয়েছিলেন।
তাকে আরেকবার খুঁজে পেলে আমার জন্য দোয়া করতে বলতাম। বলতাম, আল্লাহকে বলেন ভাই, আমার ভাইটা যেন প্রিয় মানুষের ভালবাসার মধ্যে মরতে পারে।