তাকওয়া: একটি ভ্রান্তি ও তা খণ্ডন

মাওলানা আকরাম হোসাইন

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০২০

শরয়ি জ্ঞানের সান্নিধ্য-বঞ্চিত এক শ্রেণির আবিদ ও যাহিদ দাবি করে, তারা কেবলই আল্লাহর জন্য ইবাদত করে। জাহান্নামের ভয় কিংবা জান্নাতের আশায় নয়। বেশ কিছু কারণে তাদের এই দাবি অসার ও ভ্রান্ত বলে প্রতিভাত হয়:

এক. তাদের এই দাবি আল্লাহর নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ জাহান্নামকে ভয় করার এবং কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ করেছেন। ঘোষিত হয়েছে, তোমরা জাহান্নামকে ভয় করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য। সুরা বাকারা: ২৪। একই সুরার ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা ভয় করো ওই দিনকে, যেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না।

সুরা আল ইমরানের ১৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ভয় করো ওই আগুনকে, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।’ অধিকন্তু মহান আল্লাহ আমাদেরকে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন সুখময় জান্নাত। কুরআনের ভাষায়, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য আছে বহু প্রাসাদ, যার উপর নির্মিত আরো প্রাসাদ, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর অঙ্গীকার। তিনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। সুরা যুমার: ২০

সুরা আল ইমরানের ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে প্রবাহিত হয় নদীনালা। সুরা যুমারের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।

দুই. এর মাধ্যমে তারা সর্বকালের অনুসৃতির রীতির বিরোধিতা করে। কারণ আমাদের রাসূলসহ পূর্ববর্তী সকল নবিব-রাসূল এবং তাদের সহচরবৃন্দ জান্নাত প্রার্থনা করতেন এবং জাহান্নামকে ভয় করতেন। পূর্ববর্তী নবিদের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতো। তারা আমাকে ডাকতো আশায় আশায় ও ভয়ে ভয়ে। আর তারা ছিল আমার প্রতি বিনীত। সুরা আম্বিয়া: ৯০

একবার জনৈক সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, আপনার ও মু‘আযের মৃদু গুঞ্জরণ বড়ই মধুর। আমি তাশাহ্হুদের পরে এই দু‘আটি পড়ি, হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে জান্নাত চাই এবং আপনারই কাছে মুক্তি চাই জাহান্নাম থেকে। এটা শুনে আল্লাহর রাসূল তাকে বলেন, জান্নাতের চারপাশেও আমরা গুনগুন করবো। মুসনাদু আহমাদ, হাদিস: ১৫৮৯৮

সফল ব্যক্তিদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই হবে সফল। সুরা আলে ইমরান: ১৮৫। সুরা মারয়ামের ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এ সেই জান্নাত, যার অধিকারী বানাবো আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মুত্তাকিরদেরকে।

তিন. তাদের এই চেতনা অজ্ঞতা-প্রসূত। অজ্ঞতা ও জ্ঞান স্বল্পতার দরুণ তারা মনে করে, আখিরাতে জান্নাতের নি‘আমতের বাইরেও বেশ কিছু নি‘আমত থাকবে; অনুরূপ জাহান্নামের শাস্তির বাইরেও বেশ কিছু শাস্তি থাকবে। কিন্তু তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে এটা সত্য যে, জান্নাতে প্রবেশের পর একজন জান্নাতির সর্বোচ্চ পুরস্কার হচ্ছে তার রবের দর্শন; অপর দিকে একজন চির জাহান্নামির সবচেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে এই দর্শন থেকে বঞ্চনা। কিন্তু এই সর্বোচ্চ নি‘আমত ও শাস্তি জান্নাত বা জাহান্নামের বাইরে, তৃতীয় কোনো স্থান থেকে ভোগ করা সম্ভব নয়।

চার. তাদের এই দাবি মানবিক চাহিদা ও বাস্তবতা পরিপন্থি। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যাদের ইবাদতের পেছনে জান্নাতের আশা এবং জাহান্নামের ভয় ক্রিয়াশীল থাকে না, তাদের ইবাদতে এক সময় স্থবিরতা চলে আসে। কেননা ভয়, আশা ও তাকওয়া ইবাদতে প্রেরণা জোগায়। দেহ-মনে স্বস্তি সঞ্চার করে। এজন্য দেখা যায়, যেসকল মুত্তাকি আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভে সক্ষম হন, তারা রাত জেগে তার ইবাদত করেন। কায়মনোবাক্যে তার কাছে প্রার্থনা করেন জান্নাতের নি‘আমত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এতে কখনো ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত হন না। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যে-বিষয়ের ভয় দেখিয়েছেন, তা একটু পড়ে দেখুন। এরপর ভাবুন, মানব-হৃদয়ে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তোমরা যদি কুফরি করো, তবে কীভাবে আত্মরক্ষা করবে ওই দিন, যেদিনটি কিশোরকে পরিণত করবে বৃদ্ধে? সুরা মুয্যাম্মিল: ১৭

পাঁচ. তাদের এই দাবি তাকওয়ার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। কারণ তাকওয়ার মূল লক্ষ্য হলো, সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎকর্ম বর্জনের প্রেরণা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বান্দা ও মহান আল্লাহর শাস্তির মাঝে আড়াল সৃষ্টি করা। আদি ইবনু হাতিম রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা এক টুকরো খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করো। সহিহুল বুখারি, হাদিস: ১৪১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৬