তানজিনা আক্তার দিপা

তানজিনা আক্তার দিপা

তানজিনা আক্তার দিপার গল্প ‘শৈশবের জগৎ’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

আর কয় ঘণ্টা আব্বু?
জানি না রে মা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন স্টেশনে বসে আছে অ্যানি ও তার পরিবার। গ্রামে যাবে, দাদুর সাথে ঈদ করবে। অ্যানি খুব খুশি হয়েছিল। প্রতিবারের মতো এবারও ট্রেন সিডিউল ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেট। যদিও রেলমন্ত্রী সুন্দর করে প্রতিবার বলেন, ঈদে ট্রেন চলাচল হবে নির্বিঘ্ন। হা হা হা হা!

করোনা মহামারিতে সবাই গৃহবন্দি জীবনযাপন করছে। কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না। খোলা হাওয়ায় প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারে না। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ। বন্ধুদের সাথেও কতদিন দেখা নেই। একবছর দাদুকে দেখতে যায়নি অ্যানি। তার আব্বু খুবই সচেতন মানুষ। কাজ ছাড়া একদম বের হন না তিনি। কাজে বের হলেও মাস্ক, হ্যান্ড স্যনিটাইজার, ফেস শিল্ড ব্যবহার করেন। আর পরিবারের কেউ অযথা বের হবে, এটা তিনি কখনই মেনে নেবেন না। তবে এবার দাদুমণির কান্নার কাছে হার মানলেন তিনি।

একদিন হারিয়ে যাব নামে ফেসবুকে অ্যানির একটা পেইজ আছে। সেখানে মাঝে মাঝে লেখালেখি করে অ্যানি। ফেসবুক ওপেন করে লিখতে শুরু করলো। গল্পের নাম, শুধু কি তাই! মাঝে মাঝে মনে হয়,  ফরেস্ট গাম্প মুভির ফরেস্ট গাম্প হয়ে যাই। বাস স্টপে বসে বসে মানুষকে গল্প শুনাই। মজার সব গল্প।

হাতে যাদের মরণাস্ত্র, চোখে অঙ্গীকার
সূর্যকে তারা বন্দি করবে, এমন অঙ্গীকার।
ওরা কারা, ওরা কারা, ওরা কারা!

হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমনি সিনেমায় ‘ওরা’ হলো বাঙালি বীর সেনানি মুক্তিযোদ্ধা। তবে আমাদের আশপাশে একটা ক্ষুদ্র প্রাণিজগৎ আছে। যারা দস্যুবাহিনী, বিচ্ছুবাহিনী আর জলদস্যু হিসেবে পরিচিত। ওরা হলো তারা, যাদের শৃঙ্খলার বন্ধন থেকে আপনি মুক্ত হতে চাইবেন না।

বাচ্চাটা আমাদের ফ্লোরের নিচের ফ্লোরে থাকে। মাকে যতরকম যন্ত্রণা করার, এই ভদ্রলোক করেন। দুই-তিন ঘণ্টা পর, মায়ের সহ্যের বাইরে চলে গেল মা গর্জন দিয়ে ওঠেন, আবির... তোর মুখ বন্ধ করবি? আমি আসলে তোর গলা চিপ দিমু।

এই কথা শুনে বহু কষ্টে ভদ্রলোক পাঁচমিনিট মুখটা বন্ধ রাখেন। তারপর আবার শুরু। উনার আওয়াজ না শুনলে বুঝি, তিনি অন্য রুমে আছেন। কারণ তিনি তো মুখ বন্ধ রাখার পাত্র নন। করানোকালীন লকডাউনে বাচ্চারা দিনের পর দির বাসায় বন্দি। শৈশবের সুন্দর স্মৃতি থেকে থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এই ভদ্রলোক বাসায় থাকেন, আর মা-বাবাকে জ্বালাতন করেন।

একদিন তিনি গান ধরলেন, ভালো লাগে না, ভালো লাগে না, ভালো লাগে না... তিনি চাইছেন মা শুনুক, আবার ভয়ও পাচ্ছেন। না, তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারবেন না। মা ধমক দিলে দেবে। গানটা তাকে সুরেলা গলায়ই গাইতে হবে।

ভা... আ... লো...ও
লা... আ... গে... এ... না...
মাও এবার অস্থির, আইতাছি, আইতাছি তোরে ভালো লাগামু।
একদিন বুঝলাম, মা উনাকে কান ধরিয়েছেন। আর তিনি কান ধরা মাত্র উসখুস করছেন।

আজকে কান ধরব না। ও আম্মু, আম্মু। আজকে না। কাল কান ধরবো। তার মানে, কাল তিনি দুষ্টামি করবেন এটা কমফার্ম। এবার তিনি বাংলা সিনেমার মতো চিৎকার দিলেন, না। না। না। আজকে না।

উনার আম্মুর হাসি আসছে। মুখ টিপে টিপে বলছেন, না আজকেই, আজকেই কান ধরতে হবে।
ছেলে নাছোড়বান্দা, আম্মু, ও আম্মু, আজকে না।
শেষপর্যন্ত আম্মু হার মানলেন। কিন্তু কান ছেড়ে দেবার দশ মিনিট পর, তিনি শয়তানের টাক মাথায় ডুগডুগি বাজাতে শুরু করলেন।

একজন টকিংটম আছেন। সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় শুধু উনার মুখ বন্ধ থাকে। বাকি সময় তিনি এফএম রেডিওর মতো বাজতে থাকেন।

অ্যানি খালামনি তার মনের মতো। আমার গল্পের ঝোলা খালি হয়ে গেলেও উনার ধৈর্যের কমতি নেই। মাঝে মাঝেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা খালামনি, তুমি এত গল্প পাও কোথায়?
আমিও দমবার নই। বলি, আমার পেটে দই আর ক্ষিরের মতো গল্প জমতে থাকে। জমা শেষ হয়ে গেলে দই কেটে কেটে খেয়ে ফেলতে হয়। আমার গল্পগুলোও অল্প অল্প করে বলে ফেলতে হয়। নাহলে, অন্য গল্পগুলো জমবে কীভাবে?

আইনস্টাইনের মতো চেহারা করে তিনি বলেন, ও আচ্ছা। খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেন।
পৃথিবীর সব জীবজন্তু ইওনার খুব পছন্দ। বাসাটা আমাজন ফরেস্ট বানিয়ে রেখেছেন। ভয় হয়, বড় হয়ে তিনি টার্জেনের মতো জঙ্গলে না চলে যান। তারপরও এ্যানিমেল’স শপে গেলেই এমনভাবে তাকিয়ে থাকেন যেন, এগুলো কিনতে না পারলে তার বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই?

উনার সাথে বাচ্চা সেজে কয়বার যে আমি চিড়িয়াখানায় গিয়েছি। উনার চেয়েও অবাক হয়ে জীবজন্তু দিকে তাকিয়ে বলেছি, মাই গড! যেন জীবনে প্রথম আমি হাতি ঘোড়া দেখলাম।

তারপরও উনার এ্যনিমেল টয়সের শখ মেটে না। অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলাম। এ্যনিমেল ওয়ার্ল্ড! তিনি খুশিতে আত্মহারা। রঙিন কাগজ কেটে হাতি, ঘোড়া, শিয়াল, বাঘ, সিংহ, গাছে ঝুলে থাকা বানর, ব্যাঙ, গরিলা, সাপ, গাছপালা, ফুলপাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, বক বানিয়ে গাম দিয়ে এঁটে দিলাম দরজায়। নে বাপ, ঘুম থেকে উঠেই এবার প্রাণিজগৎ দেখতে পারবি। হা হা হা।

একদিন দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। অ্যানি খালামণি, আর দুই বছর পরে আমি সেভেন হয়ে যাব। ওয়াসি ভাইয়ার সমান। ওয়াও!
আমি বলালাম, হুম। তাই তো।
কিছুক্ষণ পরে, তিনি মুখ কালো করে আমার কাছে আসলেন। আমি জানতাম, তিনি আবার আসবেন।
আমি যখন সেভেন হব, তখন তো ওয়াসি ভাইয়া নাইন হয়ে যাবে।

লেখাপড়া নিয়ে তিনি ব্যাপক ব্যস্ত। সাতের নামতা, নয়ের নামতা, হাতে রেখে যোগ-বিয়োগ, রাইমস, সমাজ, বিজ্ঞান। কোনকালে যে আমি পড়াশুনা করেছি, উনার পড়াশুনার বাহার দেখে সব ভুলে গেছি।

স্কুলে ভর্তি হয়নি তার আবার বিজ্ঞান বই। বিজ্ঞান, আমি হয়ে যাই অজ্ঞান। তিনি পড়েন আর আড়চোখ আমাকে দেখেন। উনার উৎসাহ দেখে শেষে আপু বলেই বসলেন, অ্যানি, কিছু বল।
কী আর বলি? এত পড়াশুনা আমি জীবনে করি নাই। এত পড়াশুনা করলে কি চলে?

নতুন অধ্যায়ের উপর উনার বিজ্ঞান পরীক্ষা হলো। খাদ্য ও পুষ্টি। এসএসসি বা বিসিএস পরীক্ষা শেষ হয়েছে, ভাবসাব এমন। পরীক্ষা শেষ করে নানুর বাড়িতে এসেছেন। আমার পিছনে ঘুরঘুর করছেন। আপু বলল, এই অ্যানি শুন তো, আমরা নতুন কি শিখলাম।

উনি শুরু করলেন, প্রতিটি জীবের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। খাদ্য ছাড়া কোনো জীব বেঁচে থাকতে পারে না। খাদ্য আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে। খাদ্য আমাদের দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ করে। শুধু কি তাই...

বাপ রে বাপ, শুধু কি তাই। এত জটিল পড়া আমি জীবনে শুনি নাই। শুধু কি তাই! এত কিছু করার পরও শুধু কি তাই। এত ব্যাপক কারবার। বিশাল ব্যাপার। শুধু কি তাই!

তিনি নতুন বরের মতো লজ্জায় লাল। বাসার সবাই হাসছে। এই জনাব বইয়ের পড়া এমন তোতাপাখির মতো শিখেছেন যে, উৎসাহের সাথে আমাকে বলতে গিয়ে শুধু কি তাই এই শব্দটিও বাদ দেননি। এরপর থেকে উনার নাম, শুধু কি তাই।

তিনিও কম না। একদিন বললেন, আচ্ছা খালামণি তুমি এত কোক খাও কেন?
বললাম, আমার পাগল মন। ও পাগল মন, মন রে...
তিনিও আমার নাম দিয়ে দিলেন, পাগল মন।
জানি না আমার চেহারায় কী আছে। বাচ্চারা আমাকে দেখেই ভাবে, পাইছি আমাদের সাগরেদ।
খুব দুষ্টামি করছিল এই বক্সিং মাস্টার।
মৌসুমি আপু বলল, দুষ্টামির আর দেখছ কি? দাঁড়াও, তোমারে ওর গান শুনাই। পিচ্চিটি এসে আমাকে একনজর দেখলো।
না। আমার কাছে ওর কিছুতেই হারা যাবে না।

কেরাতে স্টাইলে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়ালো। প্রথমে গুলি যেভাবে ডিশা ডিশা ডিশা করে ছুঁড়ে, সেইভাবে হাত দুলাতে লাগলো।
গান শুরু, ট্যান ট্যানা, ট্যানা ট্যানা ট্যানা... এইবার তার মাথাও দুলতে থাকলো।

হাসতে হাসতে সবাই বেহুঁশ হবার পালা। বাচ্চাটির একটা গোপন চোখ আমার দিকে। আমিও হার মানার পাত্র নই, মুচকি একটু হাসলাম। যদিও ভেতর থেকে আমি হাসিতে ফেটে পরছি। তিনি খেলতে চলে গেলেন। আমার ভেতরের চাপা হাসি তখন আর বাঁধ মানলো না।
আসুন, আরও কিছু গান শুনি।

আমি, আমার বান্ধবী মিশু আর বন্ধু জাহিদ। ধানমন্ডি ১৯ এর স্টার কাবাবে লাঞ্চ করার জন্য বসলাম। থাই দিয়ে দেখা যাচ্ছে একজন হিরো আসছেন।
না। কারো ধার ধারেন না তিনি। নেইকনফিডেন্টের কোনো অভাব। যদিও সবেমাত্র মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হলেন। কিন্তু তাতে কি? দুই, বছর পরে তিনি একাই রাস্তা পার হতে পারবেন। যখন উনার বয়স পাঁচ হবে। আপাতত যে মায়ের কোলে না উঠে রাস্তা পার হলেন তাতেই কম কি?

স্টার কাবেব ঢুকেই তিনি এদিক সেদিক তাকালেন। কোন টেবিলে বসা যায়? আমার সাথে উনার একবার চোখাচোখি হলো। আমি নিশ্চিত। তিনি আমার পাশেই বসবেন।
মিশু আমার কানে কানে বললো, দেখছো বাচ্চাটা কত কিউট!
যাই হোক, আশেপাশের সব টেবিল খালি থাকা সত্ত্বেও তিনি এমনভাব করে আমার পাশের টেবিলে বসলেন, যেন বাধ্য হয়েই তাকে এখানে বসতে হয়েছে। তার কোনো ইচ্ছা নেই। প্রতিপক্ষ যেহেতু প্রথমেই হার মানলেন, তখন আমি আর তাকে না ঘাটাই। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?
ভালো। টুমি কেমন আছে?
আমি? আছি আর কি।
আমার বন্ধুরা মুচকি মুচকি হাসছে।
উনি পরে আছেন জিন্সের ফুল পেন্ট, চেক শার্ট আর সুন্দর একজোড়া শু। হাতে বেন টেন ঘড়ি। এখনই বড় হয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। একটুর জন্য পারছেন না। আপাতত গ্রিল আর নানই ছিঁড়ে খেতে পারছেন না।
আড্ডা জমে উঠলো। উনার আম্মু বললেন, রিফাত বাবু খুব সুন্দর গানও পারে। বাবু কিন্তু তাকে বাবু বলার কারণে একটু বিরক্ত।

আমি মনে মনে প্রস্তুত। এ যুগের ডিজিটাল বাচ্চা। গান গাইলেই কি গান আর গাইবে, লেয়লা মে লেয়লা, পাগলু...
এমন কোনো গান শুনার জন্য আমরা প্রস্তুত। সবাই কে অবাক করে দিয়ে তিনি এমন গান ধরলেন যে আমাদের সবার চোখ চড়কগাছ।
ও পাখি তুর যন্তনা
আর যে পানে সয় না...
চেয়ে দেখলাম, জাহিদের চোখ প্রায় কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। আর সবসময়ের শান্তশিষ্ট মিশু হাসতে হাসতে বেহুঁশ হবার পালা। আমি কিন্তু অনড়, শুধু এক গালে একটু হেসে রইলাম। দ্বিতীয় গান শুরু, ইকা ইকা কেন ভালো লাগে না... কোনো কাজে মন কেন বসে না... এই গানটা গেয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন।

আমি বললাম, তাইতো, ভালো লাগার তো কোনো কারণ দেখতেছি না।
সেইদিন বাসায় আসার পথে মিশু সারাটা রাস্তা হেসেছে। কিছুক্ষণ চুপ, আবার হাসি শুরু।

কমান্ডো বাহিনী রেডি। এই মিশনটা শেষ করতে পারলে তারা তরুণ অফিসার ক্যাডেট পদে উত্তীর্ণ হবে। এই কমান্ডো বাহিনীর সদস্য সংখ্যা চার আর বয়স অনুর্ধ্ব চার। সবাই ওপরে গেঞ্জি পরে থাকলেও নিচে প্যান্ট নেই।

আজ কোরবানি হবে। হবে বলি দান। চারজনের একজনকে অবশ্যই বলি দান হতে হবে। আর অন্যরা মিশনে অংশ নেবে। মিশনের নাম নেন্টু কাটা।

কোথা থেকে একটা কাঠি জোগাড় করা হয়েছে। হ্যা, এই কাঠি দিয়েই নূরের নেটুটা আজ জবাই হবে। এই নূর আমার একমাত্র ভাই আর সেলিনা আক্তারের চার মেয়ের পর আরাধনার একমাত্র পুত্র। তারই নেন্টুটা আজ কেটে ফেলা হবে।

নূরের একটু ভয় ভয় লাগছে। লাল হয়ে গেছে গাল। আবার যারা মিশনে অংশ নেবেন তারাও কিন্তু কম ভয় পাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরও পারতে হবে। কাঠি দিয়ে কতক্ষণ চেষ্টা চললো। কাঠির ঘষাতে নূরের নেন্টু একটু ছিলে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
না। কাঠি দিয়ে হবে না। ছুরি অথবা ব্লেড লাগবে। ছুরি পাওয়াটা বেসম্ভব। তবে ঝোপঝাড় থেকে একটা ভাঙা ব্লেড পেয়ে গেল তারা। আল্লাহু আকবর বলে মিশনের জন্য সবাই প্রস্তুত। তাই আল্লাহ সহায় হলেন। নূরের আম্মু কোথা থেকে দৌড়িয়ে এলো, কি করছো, কি করছো তোমরা?

এই ক্যাডেটদের একজন বললো, নূরকে তোফলপানি করাচ্ছি।

মুন্নি বদনাম হুয়ি
এই মুন্নি নিজেই এখন একজন ছেলে সন্তানের জননী। ছোটবেলা থেকেই আমাদের এই কাজিন আদুরে আর খানিকটা তোতলা। তিনি তার হাবলা হাবলা কথার জন্য সবসময় বিখ্যাত। ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় মুন্নির আম্মু প্রসব ব্যথায় অস্থির। মুন্নি খুব অবাক হয়ে নানুমণিকে জিজ্ঞেস করলো, আ... আম্মুর কি হয়েছে?
তোমার আম্মুর ব্যথা উঠেছে। কাউকে বলবে না কিন্তু?
কীভাবে এই পেটে গোপন কথা থাকবে, যে পেটে হাওয়া থাকাই মুশকিল?
মুন্নিদের বাসার পাশেই ছিল ছেলেদের একটা মেস। এই মেসের সকল আঙ্কেলের সাথেই মুন্নির খুব ভাব।
আ... আ... ঙ্কেল, একটা কথা আছে। কাউকে বলবেন না কিন্তু। আ... আমার আম্মুর ব্যথা উঠেছে।
মুন্নি নিজেই কথাটা সাড়া এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও খুব বিনীতভাবে সবাইকে বলেছে, কা...উকে বলবেন না কিন্তু।”
ভাইকে কোলে নিয়ে তিনি এতই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন যে, বোকার মতো বলে বসলেন, ম.ম... মনে তো হয় যেন আ... আমার পেট থেকে হইছে।

মুন্নির যখন ভাই হয়, তখন আমাদের দুই কাজিন ঊর্মি-নিশির আরেকটা বোন হয়, সুজানা। ঊর্মি-নিশিকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মুন্নি বলেছিল, তো... তোমারা মনে হয় ভা... ভাই হওয়ার জন্য দোয়া করো নাই। ম... মন খারাপ তো হবেই। তো... তোমাদের গুন্ডা ধরলে কে... কে বাঁচাবে?

যিনি গুন্ডা ধরলে ভাই বাঁচাবেন এই গর্বে গর্বিত ছিলেন, তিনি ছোট ভাইয়ের দুষ্টামিতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন বললেন, এ... এজন্য কি আল্লার কাছ থাইক্কা তো... তোরে, চা... চা... চাইয়া আনছিলাম।

মুন্নির আব্বুর পোস্টিং পাবনায় ছিল। আমাদের আর অন্য কাজিনদের সাথে মুন্নির খুব কম দেখা হতো। তাই পাঁচ-ছয় দিন বেড়ানো পরও মুন্নির পুষাতো না। চলে যাবার জন্য আন্টি ব্যাগ গুছাতে শুরু করলে মুন্নির মনে পড়তো আমার আম্মুর হাতের বিভিন্ন রান্নার কথা, আ... আন্টি, আ... আপনার হাতের ছো... ছোট ছোট, গো... গোল গোল তেলের পিঠা খাইতে ইচ্ছা করছে। আ... আম্মুকে বলেন না, আরেকটা দিন থা... থাকতে।

খুব মোটা হয়ে গেলে আমাকে দেখে মুন্নি বলেছিল, অ্যা... অ্যানি আপু, তু... তুমি তো চ... চ... চখা ছিলা। গো... গো... গোল হইলা কেমনে?

ওরা আপনাকে খালামণি বলে ডাকে, আপু বলে ডাকে, মামণি বলে ডাকে। পাপা, মামা, চাচ্চু, দাদু, নানুমণি আরও কত মন ভুলানো নামেই না ডাকে। তাদেরকে একটা সুন্দর শৈশব দিতে না পারেন, তাদের নিজস্ব সুন্দর জগৎটা কেড়ে নেবেন না।

ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে গিয়ে ফোন চার্জ দিয়ে যখন ওপেন করলো, অ্যানিতো অবাক। লাইন, কমেন্ট আর শেয়ারে ভরে গেছে তার পেইজ। লেখাটা সবই খুবই পছন্দ করেছে। অ্যানির মন আরও ভালো, কারণ দাদু তাদের সাথে ঢাকায় আসছেন। ঈদটা ভালোই কাটলো অ্যানির।